E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর কাজ ৬২ শতাংশ সম্পন্ন

২০২৩ জুন ০৩ ১২:৩৪:৩২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর কাজ ৬২ শতাংশ সম্পন্ন

মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সড়ক সেতুর ৩০০ মিটার উজানে সমান্তরালভাবে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু নির্মিত হচ্ছে।

ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচল সহজ করতে যমুনা নদীর ওপর পৃথক বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, যা আন্ত:এশিয়া রেল যোগাযোগে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
সেতুটি নির্মাণ হলে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের মধ্যে রেল বন্ধন আরো দৃঢ় ও ঝুঁকিহীন হবে। এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণকালীন কিছু ঝুঁকি উঠে এসেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রমত্ত্বা যমুনার বুকে ভারি ভারি যন্ত্র বসানো হয়েছে। তারমাঝে সারিবদ্ধভাবে নদীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিটি দৃশ্যমান পিলার। উত্তাল যমুনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুকে ঘিরে যমুনার নদীর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই প্রান্তে দিন-রাত দেশি-বিদেশি শ’ শ’ প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিক বিরতহীনভাবে কাজ করছেন। কেউ পাইলিং করছেন, কেউ স্পেনের কাজ করছেন। আবার কাউকে ঢালাইয়ের কাজ করতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ৫০টি পিলারের মধ্যে ৩১টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে এবং ১৬টি পিলারে ইতোমধ্যে দেড় কিলোমিটারের বেশি স্প্যান বসানো ও ২৬টি পিলারে স্প্যান বসানোর উপযোগী করা হয়েছে। বাকি পিলারের বিভিন্ন স্তরের ঢালাইয়ের কাজ সহ অন্যান্য কাজ চলমান রয়েছে।

ইতোমধ্যে যমুনা নদীর টাঙ্গাইল অংশে ৭৬ শতাংশ এবং সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ডুয়েলগেজের এ সেতুতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। তবে শুরুতে (উদ্বোধনের ১ বছর) সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে।

দেশের অন্যতম এই বৃহৎ মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর কাজ ইতোমধ্যে ৬২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। দ্রুত গতিতে কাজ চলমান থাকলেও এখনও অনেকটা শুকনো মৌসুম থাকায় কাজে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে। ফলে, কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত ৩-৪ মাস বেশি সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্প সূত্র থেকে জানা যায়।

সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর নির্মাণ কাজের মোট ৬২ শতাংশ সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্টিল অবকাঠামোর সেতুটি চালু করা সম্ভব হবে। মেহা প্রকল্পের এ সেতুর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল হবে ১০০ বছর।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে বড় এ রেলসেতুতে মোট পিলার (খুঁটি বা পিলার) থাকবে ৫০টি। ক্রেনের সাহায্যে হ্যামার দিয়ে বসানো হচ্ছে পাইলিং পাইপ। রেলসেতুর পিলার হবে কংক্রিটের। ওপরের সুপার স্ট্রাকচার হবে স্টিলের। দেশে যেমন সেতুর পাইলিং কাজ চলমান, অন্যদিকে সুপার স্ট্রাকচারের কাজও ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে চলমান। ইতোমধ্যে সুপার স্ট্রাকচারের যন্ত্রপাতি মোলা বন্দরে এসে পৌঁচেছে। পিলারের কাজ শেষ হলেই সুপার স্ট্রাকচার এনে বসিয়ে দেওয়া হবে।

অপরদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণকালীন কিছু ঝুঁকি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অনুমোদিত ইএমপি অনুযায়ী সড়কের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রকল্প এলাকার জনগণ ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছে। আইএমএডি প্রতিবেদনে প্রকল্পের কিছু দুর্বল দিকও প্রকাশ করা হয়েছে।

এর মধ্যে রেলওয়ে সড়কবাঁধ নির্মাণে যথাযথ এবং অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি, প্রকল্পের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি, চুক্তি মোতাবেক প্যাকেজ ডব্লিউডি২-এর ল্যাবরেটরিতে মেশিনারি ও জনবল মোবালাইজ করা হয়নি, প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হয়নি, অনুমোদিত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অনুযায়ী নির্মাণকালীন সড়কের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়নি ও প্যাকেজে ডব্লিউডি২ সম্পূর্ণ ল্যাবরেটরি টেস্টিং ইক্যুইপমেন্ট শ্রেণি বিন্যাস করা হয়নি ইত্যাদি।

এক্সিট প্ল্যান হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্যাকেজ ভিত্তিক এক বছর সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সেতু ও যাবতীয় ভৌত অবকাঠামো হস্তান্তর করা হবে। নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে এই সেতু এবং ভৌত অবকাঠামোর ডিজাইন লাইফ ১০০ বছর সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। বিদ্যমান প্রকল্পের প্যাকেজ বাস্তবায়নে ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল চুক্তি সই হয়। প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশে মেঘনা, মেঘনা-গোমতি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় তাদের জনবল ও যন্ত্রপাতি প্রকল্প সাইটে মোবালাইজ করা সহজ হয়।

নির্দিষ্ট সময়ে যন্ত্রপাতি মোবালাইজ করতে ২০২১ সালের ২১ মার্চ কাজ শুরু করা হয়। সেতুর পাইল ড্রাইভিংয়ের জন্য প্যাকেজের ক্রেন, বার্জ, ওয়াটার জেট, হ্যামারসহ প্রয়োজনীয় মালামাল ও যন্ত্রপাতি মিয়ানমার থেকে প্রকল্প সাইটে মোবালাইজ করার পরিকল্পনা ছিল। এরই মধ্যে মিয়ামারে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় নির্দিষ্ট সময়ে যন্ত্রপাতি মোবালাইজ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীসময়ে তা সিঙ্গাপুর থেকে মোবালাইজ করা হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হয়।

আইএমইডি’র সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী- ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি, নকশার কাজ শেষ। বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এখন সেতুর মূল অংশের কাজ চলছে। স্টিল অবকাঠামোর এ সেতুতে দুইটি লাইন থাকবে। পারাপারের জন্য কোনো ট্রেনকে তাই অপেক্ষা করতে হবে না। ট্রেন চলতেও পারবে সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে। এই সেতু ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংযোগ তৈরি করতেও সহায়তা করবে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ১০ম ও শেষ চালান বুধবার(১৭ মে) মোংলা বন্দরে পৌঁছেছে ।

বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর স্টিল পাইপ স্ট্রাকচারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে নোঙ্গর করেছে বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি সান ইউনিটি। বুধবার সকালে বন্দরে পৌঁছানোর পর পানামার পতাকাবাহী এ জাহাজ পণ্য খালাস শুরু করেছে।


জাহাজটিতে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ১৬৯ প্যাকেজে এক হাজার ৫৪৮ মেট্রিক টন যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন মালামাল রয়েছে। সেতুর খালাসকৃত পণ্যগুলো বার্জে নামানো হচ্ছে। পরে সেগুলো যমুনা নদী পথে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাছে পৌঁছে যাবে। জাহাজটি মোংলা বন্দরে নোঙ্গর এর পর ২-৩ দিনের মধ্যে জাহাজ থেকে মেশিনারি পণ্য সম্পূর্ন খালাস করা সম্ভব হবে। এই নিয়ে সর্বমোট ৩৫টি জাহাজে বোঝাই করে আসা বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ৮২ হাজার ৩২৫ মেট্রিক টন মেশিনারিজ পণ্য মোংলা বন্দর দিয়ে খালাস করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, প্রকল্পের কাজ ৬২ শতাংশ শেষ। দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করা যাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পন্ন হবে। এরই মধ্যে ১৫টি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে কিছু মালামাল নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে প্রকল্পের একটি প্যাকেজের কাজ পিছিয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ, ক্রস বর্ডার এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ট্রাফিকের বর্ধিত চাহিদা বিবেচনায় রেখে নির্বিঘ্নে নিরবচ্ছিন্ন রেল চলাচল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিদ্যমান সড়ক সেতুর ৩০০ মিটার উজানে যমুনা নদীর ওপর আরেকটি ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক সম্পন্ন ৪ দশমিক ৮০ কিমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু ও প্রায় ৭ দশমিক ৬ কিমি ডাবল লাইন সমন্বিত রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ অ্যামবাঞ্চমেন্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। জাইকার ঋণসহায়তায় প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।

প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলসেতুটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম সংশোধনীর পর সেতু প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন থাকবে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বা চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দেবে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা- যা পুরো প্রকল্পের ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

(এসএএম/এএস/জুন ০৩, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test