E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সিলেট সীমান্তের হালচাল

জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে ভারতীয় চোরাই গরু-মহিষ, নীরব থানা পুলিশ

২০২৩ নভেম্বর ০১ ১৬:৫৩:৫৫
জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে ভারতীয় চোরাই গরু-মহিষ, নীরব থানা পুলিশ

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : সিলেটের সীমান্তে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারি চক্র। কারণ এই সীমান্তের একধিক রুটে জৈন্তাপুর থানার ওসির নামে এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় পান চোরাকারবারি'রা। এর মধ্যে যতো গরু মহিষ পার করবেন তারা, সে অনুযায়ী প্রতিটি গরু মহিষ প্রতি গুনতে হবে পাঁচশত থেকে এক হাজার টাকা মাত্র। এর জন্য থানা পুলিশের আছে আলাদা আলাদা লাইনম্যান। আর থানা পুলিশের ওই লাইনম্যানরাই চোরাকারবারিদের থেকে টাকা নেন ও জৈন্তাপুর থানার ওসির নামে লাইন দেন। এই পদ্ধতিতে ২৭, ২৯ ও ৩১ অক্টোবরেও লাইন পান চোরাকারবারিরা। জৈন্তাপুর থানার ল্যাইম্যান, বাওয়ন হাওর গ্রামের মৃত ফরিদ উরফে গুল্লা ফরিদের ছেলে মুজিবুর রহমান মুজিব ও আব্দুল হাই নজরুলের দেয়া লাইনে অক্টোবরের ২৭ তারিখ ১০০০ থেকে ১২০০, ২৯ তারিখ ১২০০ থেকে ১৫০০ এবং ৩১ তারিখ ৮০০ থেকে ১০০০ ভারতীয় গরু মহিষ ঢুকিয়েছে চোরা কারবারিরা। এভাবে একদিন পর পর লাইন পান চোরাকারবারি'রা।

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় এই পথে ভারত থেকে দিনরাত বাণের স্রোতের মতো আসছে গরু-মহিষ, মদ, শাড়ী, চিনি, চা পাতা কসমেটিকসসহ অন্যান্য চোরাইপণ্য। হরহামেশাই ঢুকছে মাদক ও গোলাবারুদের চালান। এই চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। তারা বিজিবি ও থানা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে নিরাপদে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বারবার তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে চোরাই গরুসহ কিছু মালামাল আটক করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় মূলহোতারা। এসব তথ্য জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।

সরেজমিনে জানা যায়, জৈন্তাপুর সীমান্ত পথে মোকামপুঞ্জি আলু বাগান হয়ে ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়নের মুড়াবন্নি বিলের পাড় দিয়ে শেওলারটুক এলাকা প্রবেশ করে প্রতিদিন রাত সাড়ে ১১ টা- থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত শত-শত গরু-মহিষ জৈন্তাপুরের শেওলারটুক সংলগ্ন সুইচগ্রেইটের উপর দিয়ে শেওলা খালের পূর্ব পার্শ্বের রাস্তা দিয়ে শেওলা খালের মূখে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় লোড করে সারী নদী হয়ে নদী পথে হরিপুর,খলাগ্রাম, কাকুনাখাই এলাকায় নৌকা থেকে গরু-মহিষ গুলো আনলোড করে। সীমান্ত পেরোনোর পর কিছুটা নৌপথ ও কিছুটা সড়কপথ ধরে সিলেট শহরে প্রবেশ করেছে গরু-মহিষগুলো। কেবল এপথ দিয়েই প্রতিদিন প্রায় পাঁচশত থেকে সাতশত গরু-মহিষ অবৈধভাবে প্রবেশ করছে।

অপর একটি সূত্র বলছে, সীমান্তের ওপারের ভারতীয় টিলা থেকে দলবেঁধে নেমে আসছে গরু-মহিষ, চিনি, মাদকদ্রব্য, শেখ নাসির বিড়ি, নাসিম বিড়ি, কসমেট্রিকস বিভিন্ন ব্যান্ডের পণ্য সামগ্রী। টিলা থেকে নেমে ঝর্ণার জলে সাঁতরে গরু-মহিষগুলো প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। ওপাড়ের টিলার ওপর থেকে কয়েকজন গরু-মহিষগুলোকে এদিকে ছেড়ে দেন। এপাড়ে আরো কয়েকজন অপেক্ষা করেন গরু -মহিষ গুলোর জন্য। তারা গুণে গুণে গরু-মহিষ গুলো নিয়ে আসেন জৈন্তাপুর নির্জন এলাকায়। উপর থেকে গরু-মহিষ গুলো নিয়ে আসার সময় আশপাশে বিজিবি সদস্যরা টহল দিলেও এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের।

সিলেটের কাস্টমস ও ভ্যাট কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত কখনো বৈধভাবে বাংলাদেশে গরু-মহিষ রফতানি করে না। তবুও বাংলাদেশের হাট-বাজার গুলোতে ভারতের গরু-মহিষে সয়লাব হয়ে যায়। এগুলো আসে কিভাবে? গরু চোরাচালানে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিজিবি) স্থানীয় দায়িত্বশীলদের সম্পৃক্ততা না থাকলে ভারতীয় গরু আসতে পারতো না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যদিও বিজিবি বারবার তা অস্বীকার করে আসছে।

তাছাড়া, গরু-মহিষগুলো নানান উপায়ে বাংলাদেশে করায় চোরাকারবারিরা। পাচারকারীরা সীমান্ত বাহিনী বিজিবির নজর সরাসরি এড়াতে ছোট ছোট গাড়ি ব্যবহার করে। রাতের বেলা এ চক্রটি মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই-বদরপুরের জাতীয় সড়কের পাশের বিভিন্ন বাড়িতে গরু-মহিষসহ মালামাল পৌঁছে দেয়। সেখানে হাত বদলের দায়িত্বে থাকেন স্থানীয় কিছু খাসিয়া যুবক। পাচারকারী দল এ জন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি বাড়ি ব্যবহার করে। টাকার বিনিময়ে এসব বাড়িতে গরু-মহিষসহ বিভিন্ন পণ্য রেখে নম্বর লাগিয়ে দেয়। পরে মোবাইলের মাধ্যমে চোরাকারবারিদের জানিয়ে দেয়া হয় গরু ও মহিষের নম্বর। এরপর বিএসএফের টহল একটু ঢিলেঢালা হলেই গরু-মহিষের গলায় ও মুখে রশি বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশে পৌঁছামাত্র দাঁড়িয়ে থাকা থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয় দানকারীরা নম্বর দেখে দেখে দ্রুত সরিয়ে নেয় ওই গরু-মহিষগুলো। এভাবেই চলে মেঘালয় ও জৈন্তাপুর সীমান্ত পথে ভারতীয় গরু-মহিষ ও পণ্য চোরাকারবারিদের রমরমা ব্যবসা।

এ ব্যাপারে বিজিবি-৪৮ ব্যাটালিনায় শ্রীপুর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নায়েব সুবেদার মোঃ হাবিব’র সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জৈন্তাপুর সীমান্তের আলু বাগান, মোকামপুঞ্জি দিয়ে ভারতীয় গরু-মহিষ পাচার হয় বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কোন বিশ্বস্ত সূত্র আমাদেরকে তথ্য দিলে, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবো। কিন্ত শেওলারটুক এলাকার সুইচগেটে গিয়ে আমরা পরু-মহিষ আটক করতে গেলে আমাদের উর্ধ্বতন অনুমতি ছাড়া যেতে পারবোনা। চোরাই পণ্য সীমান্ত এলাকা অতিক্রম হয়ে যওয়ার পর দেশের পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলায় নিয়জিত অন্যান্য বাহিনী চোরাকারবারীদের ধরতে বিশাল অবদান রাখতে পারেন।"

এদিকে সূত্র বলছে, জৈন্তাপুর থানার ওসি তাজুল ইসলাম দেশের আইন শৃঙ্খলায় নিয়জিত অন্যান্য শাখাকে তার থানা এলাকায় চোরাচালান ও মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে নিরুৎসাহিত করেন। তার দাবি তিনি একাই একশো! ওসি তাজুলের অনুমতি ছাড়া জৈন্তাপুর থানা এলাকায় ডিবি, সিআইডি ও র্যাব অভিযানে গেলে তিনি নাখোশ হন! সম্প্রতি জৈন্তাপুর থানা এলাকায় সিআইডি পুলিশের উপর দুর্বৃত্তের হামলার ঘটনায় জৈন্তাপুর থানার সাথে গভীর সখ্যতা আছে এমন সিন্ডিকেটের হাত থাকতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতেও দাবী জানান তারা।

এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, "ওই হামলায় নাজমুল নামে এক সিআইডি কর্মকর্তার হাত ভেঙে গেলো, এবং সিআইডি পুলিশ পরিদর্শক আব্দুল আওয়ালসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হলো, জৈন্তাপুর থানা পুলিশ এতোদিনে কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারলো না। এর থেকে বড় প্রমাণ আর কি আছে? এমনকি গ্রেফতার করার কোন প্রকার তৎপরতাও চোখে পরেনি।অপারগতায় সিআইডির মামলাটি তিনি সিআইডিতেও হস্তান্তর করতে পারতেন, তাও তিনি করছেন না। বরং স্থানীয় একটি বাজারে উক্ত মামলার একাধিক আসামীর সাথে জৈন্তাপুর থানার ওসিকে গল্প করতে দেখেছে স্থানীয় জনগণ।"

উক্ত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জৈন্তাপুর থানার ওসি মোঃ তাজুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে একাধিক মেসেজ পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

(আরআই/এসপি/নভেম্বর ০১, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test