E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে সরকারি কর্মকর্তার পকেটে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ!

২০১৪ নভেম্বর ০৬ ১২:৫৭:৪৮
শরীয়তপুরে সরকারি কর্মকর্তার পকেটে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ!

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুর জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ইউসুফ আলী মিয়া একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে তাকে প্রচলিত শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে শরীয়তপুরের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। অভিযোগ উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে ইউসুফ আলী মিয়া এক দিকে যেমন রাষ্ঠ্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন অপর দিকে স্বাধীনতা বিরোধী  জামায়েতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ সখ্যতা রেখে চলেছেন। অনুসসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ইউসুফের খোদ পরিবারের লোকেরাই জানেনা যে, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা।

শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নের চরমালগাও গ্রামের কালাচান বেপারী ও জয়গুন নেছার ছোট ছেলে ইউসুফ আলী মিয়া। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি সমাজ সেবা অধিদপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। তার ৩০ বছর চাকুরী জীবনের ২৭ বছর শরীয়তপুরেই কাজ করে যাচ্ছেন। এসএসসি পরীক্ষার সনদ ও সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার তালিকা অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারী। সে অনুযায়ী তার জাতীয় পরিচয় পত্র বা ভোটার আইডি কার্ডেও জন্ম তারিখ ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারী হওয়ার কথা। কিন্তু অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে সম্পূর্ন অসৎ উদ্দেশ্যে এবং নিজেকে বয়স বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাজানোর জন্যই সুবিধা মত একাধিক জন্ম তারিখ ব্যবহার করেছেন। ইউসুফ আলী মিয়া তার মূল জাতীয় পরিচয় পত্র জাল করে (টেম্পারিং করে) তাতে জন্ম তারিখ বসিয়েছেন ১ জানুয়ারী ১৯৫৪। মুক্তিযোদ্ধা ডাটা বেইজ ফরম, ধানকাটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উত্তোলনকৃত জন্ম সনদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহনের জন্য সোনালী ব্যাংকে হিসাব খুলতে পূরণকৃত তথ্য ফরম ও সোনালী ব্যাংকে জমাকৃত জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটো কপিতে দেখা গেছে ইউসুফ আলী মিয়ার জন্ম তারিখ ০১-০১-১৯৫৪। অথচ ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ডামুড্যা উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরীজীবী মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেনী ভিত্তিক তথ্য ফরম‘এ তিনি নিজে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করেছেন ১ জানুয়ারী ১৯৫৮ সাল।

ইউসুফ আলী একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান। তার এলাকার লোকজন, ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের সকল মুক্তিযোদ্ধা এমনকি তার পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, ইউসুফ আলী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেননি, তিনি ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য যায়নি, কোনদিন কোথাও যুদ্ধও করেননি। ১৯৭১ সালে তিনি ডামুড্যা মুসলিম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেনীর ছাত্রাবস্থায় দক্ষিন ডামুড্যা গ্রামে বেপারী বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে তিনি ওই বাড়িতেই ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ডামুড্যা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। কিন্ত হঠাৎ তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিভাবে অর্জণ করেছেন তা কেউ জানে না। চাকুরী ক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে অসংখ্য জালিয়াতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি বর্তমানে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের দুইটি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। গত ৮ বছর তিনি ডামুড্যা উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তার পদে রয়েছেন। একই সাথে গত ২ বছর থেকে তিনি জেলার উপ-পরিচালকের পদেও রয়েছেন।

ধারাবাহিক অপকর্মের জন্য গত ১৫ বছরে অন্তত ১০ বার ইউসুফ আলীর বদলীর আদেশ হয়েছে। কিন্তু সেই আদেশ বাতিল করে তিনি শরীয়তপুরেই থেকে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম ও অপরাধের বেশ কয়েকটি তদন্তও হয়েছে। কোন তদন্ত প্রতিবেদনই ইউসুফ আলীর টিকি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। জানাগেছে, এর পেছনে মন্ত্রনালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ব্যবহার করে বরাবরই তিনি পাড় পেয়ে গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউসুফ আলী প্রথমে ১৯৮৫ অস্থায়ী এবং ১৯৮৮ সালে স্থায়ীভাবে সমাজ সেবা দপ্তরে চাকুরীপ্রাপ্ত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নিজস্ব প্যাডে “মুক্তি সুপা/শরীয়তপুর/৫০৩৭/৮৪” নং স্মারকে তৎকালিন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাকির হোসেন খান চৌধুরী হারুন এবং এর পরের দিন অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ১৮ নভেম্বর “মুক্তি সুপা/ফরিদপুর/৪৩৮/৮২” নং স্মারকে তৎকালিন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মো. গিয়াস উদ্দিন বীর প্রতীক এর কাছ থেকে সমাজ সেবা বিভাগে চাকুরী প্রাপ্তির জন্য সুপারিশ ও প্রত্যয়ন পত্র গ্রহন করেছিলেন। একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলে জানা গেছে ইউসুফ আলী এ সকল প্রত্যয়নপত্র নিজে তৈরী করেছেন। এগুলো জাল ও ভূয়া। কারন এখানে সঠিকভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাত্র এক দিনের ব্যবধানে একই দপ্তরের দুইটি স্মারকে যথেষ্ট গড়মিল রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে ইউসুফ আলী তার বড় ছেলেকে এমবিবিএস ডাক্তারী পাশ করিয়ে সরকারী চাকরী পাইয়ে দিয়েছেন। এমনকি চাকুরী করা অবস্থায় সরকারি খরচে ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সামান্য চাকরী করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ অর্জনের কল্যানে ইউসুফ আলী শরীয়তপুর জেলা শহরে কোটি টাকা মূল্যের এক বিঘা জমি কিনে তার উপর ৪ তলা ইমারত নির্মান করেছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা ডিওএইচএস এর ২১ নং সড়কে গার্ডেনিয়া কিংডম এ্যাপার্টমেন্টের সি-৫ ফ্ল্যাটটি তার স্ত্রীর নামে অর্ধ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন বলেও জানা গেছে। তার স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যবহারের জন্য ইউসুফ আলী ঢাকায় ২৪ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি প্রাইভেট গাড়ী ক্রয় করেছেন। যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো - গ, ২৭-২৫৩৭।

চরমালগাও গ্রামে ইউসুফ আলীদের বাড়িতে গিয়ে আপন চাচাতো বড় ভাই আনোয়ার উদ্দিন বেপারী ও বড় ভাবী মালেকা বেগম এর সাথে কথা বলে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ইউসুফ আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। সে মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলে আমরা দেখিনি । এমনকি কখনো শুনিও নাই।

একই গ্রামের আব্দুল জাব্বার মালত বলেন, ইউসুফ বয়সে আমার অনেক ছোট। আমি ৮ বারের চেষ্টায় ১৯৭১ সালে ভারত পৌছেছিলাম। সেখানে প্রশিক্ষন নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করি। তারপরেও আমি মুক্তিযোদ্ধা হিবেবে স্বীকৃতি পাইনি। আমি প্রকৃত যোদ্ধা হয়েও আজো সনদ পাইনি। তালিকাভূক্ত হতে পারিনি। সে সময়ের একজন শিশু, অমুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী কি করে সার্টিফিকেট অর্জণ করেছে তা আমার বোধগম্য নয়।

ধানকাটি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল এর সাবেক সভাপতি ডা. নুরুল ইসলাম ও বর্তমান সভাপতি ইউছুব আলী খান বলেন, ইউসুফ আলী বেপারী কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাচাই এর সময় নিময় ছিল, একজন মুক্তিযোদ্ধা কমপক্ষে তার ৫ জন সহযোদ্ধার নাম বলবে, সে ভারতে কোথায়, কার অধীনে প্রশিক্ষন গ্রহন করেছে, বাংলাদেশে কোন সেক্টরে কাহার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কার মাধ্যমে কোথায় অস্ত্র সমর্পন করেছিল তার পূর্নাঙ্গ বর্ননা দিতে। ডামুড্যা উপজেলায় ৩ বার যাচাই বাচাই হলেও ইউসুফ একবারও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমান করতে পারেনি। সে জামায়েতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ডামুড্যা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডের তিন বারের সভাপতি মো. আবুল বাশার বলেন, ১৯৭১ সালে ইউসুফ আলী ডামুড্যা মুসলিম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেনীর ছাত্রাবস্থায় আমাদের বাড়িতে লজিং মাষ্টার ছিল। সে তখন ১২-১৩ বছরের একজন শিশু। আমার চাচার ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে সে পড়াতো। পুরো মুক্তিযুদ্ধ সময়ে সে আমাদের বাড়িতেই ছিল। তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কথা একটি গল্পমাত্র। সে অবৈধ পন্থায় সনদ অর্জন করেছে। আমরা তার সনদ বাতিলের জন্য বার বার মুক্তিযুদ্ধ সংসদ ও মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছি। আমি আশা করবো বর্তমান সরকারের ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে ইউসুফ আলীর সনদ বাতিল হবে।

ধানকাটি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক পিন্টু বলেন, আমি দীর্ঘ ১৪ বছর ধানকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। আমার ইউনিয়নের ৩০ হাজার বাসিন্দার কারো কাছে কোন দিন শুনিনি ইউসুফ আলী মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সার্টিফিকেট ক্রয় করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। সে সরকারি চাকুরী করেও জামায়েতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আমি এই অমুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইউসুফ আলী মিয়া বলেন, আমি ১৯৭১ সালে মে মাসে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানের সাথে ভারতে গিয়ে ভারতের মেলাগড়ে প্রশিক্ষন গহন করেছি। মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষন শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধ করেছি ( ভারতীয় কোন্ কর্মকর্তার অধীনে তিনি প্রশিক্ষন গ্রহন করেছেন তা বলতে পারেননি)। তিনি বলেন আমার মুক্তিযোদ্ধা আইডি নং- ০৩১৫০৫০২৪৪, মন্ত্রনালয় সনদ নং- ম - ৩৭০৪, জাতীয় তালিকা নং- ৭৭, গেজেট নং- ৩৮৯ তারিখ- ২৫/০৮/২০০৫, মুক্তিবার্তা লাল বই নং- ০১১২০৩০১১২, ভোটর তালিকা নং- ১৬ এবং মন্ত্রনালয় কর্তৃক যাচাই ক্রমিক নং -১৪ । আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।একটি মহল সমাজে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করা জন্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি আব্দুস সাত্তার খান বলেন, ইউসুফ আলী সম্পর্কে আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা নিজেরা খুব গভীরভাবে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি সে একজন অমুক্তিযোদ্ধা। তার সনদ বাতিলের জন্য ইতিপূর্বেও আমরা চেষ্টা করেছি। এখন নতুন করে আবার আমরা পদক্ষেপ নেব।

(কেএনআই/এইচআর/নভেম্বর ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test