E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘এনা মোটা দেখি দেও, পিন্ধার পর যেনো জাড় পালায়’

২০২৪ জানুয়ারি ১৫ ১৮:২৩:৩১
‘এনা মোটা দেখি দেও, পিন্ধার পর যেনো জাড় পালায়’

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : ‘ছিঁড়া- ফাটা হোউক,এনা মোটা দেখি দেও ভাই। পিন্ধার পর যেনো জাড় পালায়। ঠান্ডায় কাঁপেছে, বাড়ির অবলা প্রাণি-গরু-ছাগল্লা। অসুখ ধরি গেইছে।দু'দিন থাকি পাতলা পায়খানা করেছে, তিনটা ছাগল। ওমাক গরম কাপড়া পরাবা হবি। ওইল্লার তন্ন্যেই কাপড়া নিবা আইছো। হামার তন্ন্যে নাহায়। একনা বাছি-বাছি দাও ভাই। ছিঁড়া- ফাটা হোউক, মোটা হইলেই হবি।’

সোমবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে দিনাজপুরের লন্ড্রি বাজার খ্যাত হকার্স মার্কেটে পুরনো কাপড় নিতে এসে বিড়বিড় করে বিক্রেতাকে এমনি কথা জানাচ্ছিলেন ষাটোর্ধ আজাহার আলী। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পলাশবাড়ী এলাকার আজাহার আলী দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানস্থ হকার্স মার্কেটে প্রতি পিস ৩০ টাকা হাক-ডাকের পুরনো কাপড়ের স্তুপ থেকে ৭ টি মোটা কাপড় বাছাই করে নিয়ে দোকানদারকে ২০০ টাকা দিলেন। ৩০ টাকা করে ৭টির মূল্য ২১০ টাকা হলেও দোকানদার বাকি ১০ টাকা চাইলেন না।

শুধু আজাহার আলী নয়, অনেকেই এই হকার্স মার্কেটে কম দামের হাক-ডাকের স্তুপ থেকে বেছে কাপড় কিনছেন। বিশেষ করে নিন্ম আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা এই হকার্স মার্কেট। প্রতি পিস ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ দরে হাক-ডাক দিয়ে বিক্রি করছেন, দোকানিরা।শীতের প্রকোপ বাড়ায় জমে উঠেছে শীতের পুরনো এই পোশাক বেচাকেনা। প্রায় সপ্তাহ ধরে কনকনে ঠান্ডার গরম পোশাকের চাহিদা এখন তুঙ্গে। বড় ময়দানস্থ লন্ড্রি বাজার খ্যাত হকার মার্কেট থেকে শুরু করে বড় বড় শপিংমল এবং ফুটপাতের দোকান, সব জায়গাতেই ক্রেতার ভিড়। বিক্রিও হচ্ছে হরদম। তবে চাহিদা থাকায় শীতের পোশাকের দাম এবার বাড়তি। সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করতে বেশিরভাগ ক্রেতাই পুরাতন কাপড়ের হকার মার্কেটেই বেশি ঝুঁকছেন। কিনছেন পছন্দের শীতবস্ত্র। বিক্রি বেশি হওয়ায় খুশি দোকানিরাও।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে স্থায়িত্ব তীব্র শীতে কাঁপছে দিনাজপুর। ঘন কুয়াশা ও হিমেল বাতাসে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। ফলে বেড়েছে পুরাতন গরম কাপড়েরও কদর। শীত থেকে রক্ষা পেতে নিজের কিংবা পরিবারের সদস্য ছাড়াও বাড়ির গবাদিপশু গরু-ছাগল, কুকুর-বিড়ালের জন্যও কাপড় কিনতে ভিড় করছেন অনেকে। তবে এবার গরম কাপড়ের দাম বেশি হওয়ায় অনেকে বেকায়দায় পড়েছেন।

সোমবার (১৫ জানুয়ারি) জেলায় মৌসুমের সর্বোনিন্ম তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ রেকর্ড করা হয়েছে। তীব্র শীত অনুভুত হওয়ায় অনেকে অফিস-আদালতে কাজ-কর্ম সেরে বিকেলে দিনাজপুর বড় ময়দানে পুরাতন কাপড়ের বাজার হকার মার্কেটে শীতের পোষক কিনতে আসেন। ফলে পুরাতন কাপড়ের মার্কেটে ছিলো উপচে পড়া ভিড়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সহ সব বয়সের মানুষকে শীতের কাপড় কিনতে দেখা গেছে। শুধু অল্প আয়ের মানুষেরাই নয়, কেনাকাটা করছেন মধ্যবিত্ত পরিবার সহ অনেকেই।
'লন্ড্রি বাজার' খ্যাত এই গরম কাপড়ের মার্কেটটি এক সময় বসতো দিনাজপুর আদালত পাড়ায়। তাই অনেকে বলতো কাচারি বাজার। সাধারণ নিন্ম আয়ের মানুষের আস্থার বাজার এটি। পরে দিনাজপুর ঐতিহাসিক বড় ময়দানে স্থানান্তর হয়। এখনো অনেকে এই বাজারটিকে ‘কাচারি বাজার’ নামেই চেনেন।

চিরিরবন্দরের আন্ধারমুহা এলাকা থেকে কাপড় কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম জানালেন, 'ভাই কাচারিত একটু কাজ ছিলো। শেষ করি চলি আনু কাপড়ের বাজারত। যে ঠান্ডা পইছে। মোর মা আর দুইটা ছোইলের জন্যে স্যুয়েটার কিনিম।দেখি পছন্দ করেছো। মেলায় দাম চাহেছে।'

বীরগঞ্জ উপজেলার সুজালপুর থেকে আসা আকলিম খাতুন জানালেন, 'তিনজন এক সাথে আইছি,গরম কাপড় কিনিবার বাবত। আত্মীয়র বাড়িত বেড়াবা আইছনো। যাবার বেলায় এন্না ঘুরি যাছি। যদি ভালায় ভালায় কিছু পাওয়া যায়। দেখিনো। দুটা কিনিওছি। আরো দেখেছি।এবার মেল্লায় দাম। তারপরও কম দামেরলা বাছি বাছি নেছি।'

দিনাজপুর হকার মার্কেট সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানালেন, এবার গাইডের দাম খুবই বেশি। তারপরও বেশি টাকায় গাইড কিনে পোষাচ্ছেনা। অনেক ছিড়া-ফাটা বের হচ্ছে। যা হাক-দিয়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ নিজে অথার পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর জন্য নিচ্ছে আবার কেউ নিচ্ছে গরু-ছাগল, কুকুর, বিড়ালকে পড়ানোর জন্য। এবার বেচা-কেনা ছিলোনা। ক'দিন থেকে শীত বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে বেচা-কেনা। ভালোই হচ্ছে। আর ক'দিন এভাবে শীত থাকলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।

শুধু হকাস মার্কেট নয়, রেল ঘুমটি থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সড়ক পর্যন্ত শীতের গরম পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে ওইসব ফুটপাতের দোকানগুলোতেও।

বিভিন্ন সাইজের সোয়েটার, জ্যাকেট, কানটুপি, মাফলার, শাল, ট্রাউজার, ফুলহাতা গেঞ্জি ও হুডিসহ বিভিন্ন শীতের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে এসব ফুটপাতেও। সাইজ অনুযায়ী দামও আলাদা। এক-দেড়শ টাকা থেকে শুরু করে আটশ’ টাকা দামের পোশাক মিলছে এসব দোকানে গরম পোষাক। এছাড়া হাত মোজা, কানটুপি ও ছোটখাট শীতের পোশাক মিলছে ১০০ টাকার ভেতরেই।

ফুটপাতের ক্রেতা আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের ক্রয়সীমায় মোটামুটি সবরকম পোশাকেই ফুটপাতে পাওয়া যাচ্ছে। শপিংমলগুলোতে কেনাকাটার চেয়ে ফুটপাতে কেনাকাটা ভালো এবং সাশ্রয়ী।’

দোকানি মনোয়ার হোসেন বলেন, বিক্রি শুরু হয়েছে কম্বলের,তাই প্রতিবারের মতো আমি এবারও কম্বল তুললাম দোকানে। বিক্রি ভালো হচ্ছে। মানভেদে বিভিন্ন কম্বল ১৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

জেলার বিরল উপজেলা থেকে ছেলের জন্য শীতের কাপড় কিনতে আসা শাহজাদা বলেন, এবছর বেশ ঠান্ডা। নিজের জন্য কোনমতে চলে গেলেও ছেলের জন্য একটি নতুন জ্যাকেট লাগবে। গার্মেন্টস্ এর দোকানগুলোতে যে দাম তাতে আমাদের মত গরীব মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাই এখানে এসেছি।

শহরের মালদহপট্টি থেকে শীতের কাপড় কিনতে আসা সবিতা বলেন, স্বামী সামান্য দিনমজুরের কাজ করে। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চালানোই মুস্কিল। যে শীত তাতে শীতের কাপড় না হলেই নয়। এখানে কম টাকায় পাওয়া যায়, তাই এখানেই এসেছি।

মেয়রে জন্য শতীতের কাপড় কিনতে আসা রাজেকুল বলেন আমি প্রতিবারে এখান থেকে আমার পরিবারের জন্য শীতের কাপড় কিনি এখানে কম দামে ভালো মানের কাপড় পাওয়া যায়।

দোকানদার রহমত আলী বলেন, 'প্রচন্ড শীত আসায় মানুষ কাপড় কিনতে আসছে। কিছুটা ভালো ব্যবসা হচ্ছে। তবে ক্রেতারা কেনার থেকে অকে কম দাম বলছে। আমাদের সারা বছর এখানে বেচাকেনা হয়না তোমন একটা শীতের দুই থেকে তিন মাস একটু ভালো বেচাকেনা হয় তা দিয়ে আমারা সারা বছর চলি।'

আরেক দোকানদার মোয়াজ্জেম জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে একটু কাস্টোমারের ভীড় বাড়ছে। এখানে সর্বনিম্ন বিশ টাকা থেকে বিভিন্ন দামের মাল পাওয়া যায়। ভীড় অনুযায়ী বিক্রি কম, কয়েকদিন থেকে বেচা-বিক্রি মোটামুটি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত: মাঘের শুরুতেই তীব্র শীতে কাঁপছে দিনাজপুর। কয়েকদিন ধরে চলছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে বেড়েছে কুয়াশার দাপট। হিমেল বাতাসে আর শীতে কাবু মানুষ ও প্রাণিকুল। ঘটেছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন। চরম দূর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। কামাই-রোজগার কমে গেছে তাদের। গরম কাপড়ের অভাবে অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শরীরে উষ্ণতা নিচ্ছেন।

দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আসাদ জানিয়েছেন, 'আজ সোমবার (১৫ জানুয়ারি) জেলার তাপামাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়া রেকর্ড করা হয়েছে। আদ্রতা ৯৭ শতাংশ এবং বাতাসের গতি ০০ নটস। গতকাল রবিবার জেলায় তাপমাত্রা ছিলো ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ তা এক ডিগ্রি বাড়লেও হিমেল হাওয়া এবং বয়ে যাওয়া মৃদু শৈতপ্রবাহে কমেনি শীতের তীব্রতা।'

শীতের প্রকোপে বেড়েছে শীতজনীত রোগ। হাসপাতালগুলোতে রোগি সামলা হিমসিম খাচ্ছেন, নার্স এবং চিকিৎসকরা।

দিনাজপুর জেলা সিভিল সার্জন এএইচএম বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, 'তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শীতজনিত রোগ আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এ জন্য শিশু ও বয়স্কদের ঠান্ডা থেকে দূরে রাখাসহ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে শিশু ও বয়স্কদের বের না হওয়াই ভালো।'

দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলছেন, এই সময়ে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যাগুলোই বেশি দেখা যায়। যেমন কাশি, অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, সাময়িক জ্বর, কোল্ড অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এ সময় বাতাসে ধুলাবালি বেশি থাকায় অনেকে অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা যায়।

বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের কাশি, কোল্ড অ্যালার্জির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঠিক সময়ে সনাক্ত করা না গেলে সেটা অনেক সময় নিউমোনিয়াতেও রূপ নিতে পারে।তাই এই সময়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বয়স্ক এবং শিশুদের বাইরে নেয়া যাবেনা। উষ্ণতায় রাখতে হবে।

দিনাজপুর জেলা ভেটেরিনারি অফিসার ড. আশিকা আকবর তৃষ্ণা জানায়, এ সময় গরু ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য গবাদি পশুপাখির নানা রকমের রোগবালাই হয়ে থাকে। গবাদি পশুপাখির শীতকালীন কিছু কমন রোগ হয়। একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

এই শীতকালীন সময়ে গরুর এফএমডি ক্ষুরারোগ এবং ছাগলের পিপিআর হয় বেশি। ক্ষুরারোগ একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। দুই ক্ষুরওয়ালা সব প্রাণীই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া এ রোগের শিকার হয় বেশি। বাতাসের সাহায্যে এ রোগের ভাইরাস দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাদলা রোগ গরুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। ক্লস্ট্রিডিয়াম শোভিয়াই নামক ব্যাকটিরিয়া জীবাণু এ রোগের প্রধান কারণ-

এদিকে দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দেবাশীষ চৌধুরী জানিয়েছেন, 'শীত নিবারণে জেলার তেরো উপজেলার ১০৩ টি ইউনিয়ন ও নয়টি পৌরসভার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৬২ হাজার ৩৮০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। জেলার চাহিদা অনুযায়ী আরো ৫০ হাজার পিস কম্বল এবং শিশুদের গরম কাপড় চেয়ে সোমবার (১৫ জানুয়ারি) ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে বিশেষ চাহিদা পাঠানো হয়েছে।'

(এস/এসপি/জানুয়ারি ১৫, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test