E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শীতে কাবু মানুষের একমাত্র ভরসা লন্ড্রি বাজার

২০২৪ জানুয়ারি ২০ ১৭:১০:৪৭
শীতে কাবু মানুষের একমাত্র ভরসা লন্ড্রি বাজার

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : শীতে কাবু মানুষের একমাত্র ভরসা লন্ড্রি বাজার। এই বাজারে প্রতি পিস গরম কাপড় ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ দরে হাক-ডাক দিয়ে বিক্রি হয়। শীতের প্রকোপ বাড়ায় জমে উঠেছে শীতের পুরনো পোশাক বেচাকেনা এই বাজারে। কনকনে ঠান্ডায় এই বাজারে প্রায় পক্ষকাল ব্যাপী গরম পোশাকের চাহিদা এখন তুঙ্গে। নিন্ম আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা এই গরম কাপড়ের বাজার। দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পিছনে 'লন্ড্রি বাজার খ্যাত' এই হকার্স মার্কেট এখন মুখরিত।ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে।

বিক্রেতাদের হাক-ডাক আর ক্রেতার ভিড়,বেড়েই চলেছে। সকাল থেকে রাত ১১টা পির্যন্ত বিক্রিও হচ্ছে হরদম। চাহিদা থাকায় শীতের পোশাকের দাম এবার বেড়েছে। সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করতে বেশিরভাগ ক্রেতাই পুরাতন কাপড়ের লন্ড্রি বাজার অর্থাৎ হকার্স মার্কেটেই বেশি ঝুঁকছেন। কিনছেন পছন্দের শীতবস্ত্র। বিক্রি বেশি হওয়ায় খুশি দোকানিরাও। ২০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা দামেও গোরম পোশাক আছে এই বাজারে।

প্রায় পক্ষকাল ধরে স্থায়িত্ব তীব্র শীতে কাঁপছে দিনাজপুর। ঘন কুয়াশা ও হিমেল বাতাসে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। ফলে বেড়েছে পুরাতন গরম কাপড়েরও কদর। শীত থেকে রক্ষা পেতে নিজের কিংবা পরিবারের সদস্য ছাড়াও বাড়ির গবাদিপশু গরু-ছাগল, কুকুর-বিড়ালের জন্যও কাপড় কিনতে ভিড় করছেন অনেকে।

শনিবার (২০ জানুয়ারি) দিনাজপুর জেলায় সর্বোনিন্ম তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

শনিবার সরজমিনে দেখা যায়, তীব্র শীত অনুভুত হওয়ায় অনেকে কাজ-কর্ম সেরে বিকেলে দিনাজপুর বড় ময়দানে পুরাতন কাপড়ের লন্ড্রি বাজার হকার্স মার্কেটে শীতের পোষক কিনতে আসেন। ফলে পুরাতন কাপড়ের মার্কেটে ছিলো উপচে পড়া ভিড়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সহ সব বয়সের মানুষকে শীতের কাপড় কিনতে দেখা গেছে। শুধু অল্প আয়ের মানুষেরাই নয়,কেনাকাটা করছেন মধ্যবিত্ত পরিবার সহ অনেকেই।

'লন্ড্রি বাজার' খ্যাত এই গরম কাপড়ের মার্কেটটি এক সময় বসতো দিনাজপুর আদালত পাড়ায়। তাই অনেকে বলতো কাচারি বাজার। সাধারণ নিন্ম আয়ের মানুষের আস্থার বাজার এটি। পরে দিনাজপুর ঐতিহাসিক বড় ময়দানে স্থানান্তর হয়। এখনো এই বাজারটিকে ‘কাচারি বাজার’ নামেই চেনেন অনেকে।

কাপড় ক্রয় করেতে আসা ষাটোর্ধ আজাহার আলী নামে এক ব্যক্তি দোকানিকে বলেন, "ছিঁড়া- ফাটা হোউক, এনা মোটা দেখি দেও ভাই। পিন্ধার পর যেনো জাড় পালায়। ঠান্ডায় কাঁপেছে, বাড়ির অবলা প্রাণি-গরু-ছাগল্লা। অসুখ ধরি গেইছে। দু'দিন থাকি পাতলা পায়খানা করেছে, তিনটা ছাগল। ওমাক গরম কাপড়া পরাবা হবি। ওইল্লার তন্ন্যেই কাপড়া নিবা আইছো।হামার তন্ন্যে নাহায়। একনা বাছি-বাছি দাও ভাই। ছিঁড়া- ফাটা হোউক, মোটা হইলেই হবি।"

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পলাশবাড়ী এলাকার আজাহার আলী এই লন্ড্রি বাজারে প্রতি পিস ৩০ টাকা হাক-ডাকের পুরনো কাপড়ের স্তুপ থেকে ৭ টি মোটা কাপড় বাছাই করে নিয়ে দোকানদারকে ২০০ টাকা দিলেন। ৩০ টাকা করে ৭টির মূল্য ২১০ টাকা হলেও দোকানদার বাকি ১০ টাকা চাইলেন না।

শুধু আজাহার আলী নয়, অনেকেই এই লন্ড্রি বাজারে কম দামের হাক-ডাকের স্তুপ থেকে বেছে কাপড় কিনছেন। চিরিরবন্দরের আন্ধারমুহা এলাকা থেকে কাপড় কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম জানালেন, 'ভাই কাচারিত একটু কাজ ছিলো। শেষ করি চলি আনু কাপড়ের বাজারত।যে ঠান্ডা পইছে। মোর মা আর দুইটা ছোইলের জন্যে স্যুয়েটার কিনিম।দেখি পছন্দ করেছো।মেলায় দাম চাহেছে।'

বীরগঞ্জ উপজেলার সুজালপুর থেকে আসা আকলিম খাতুন জানালেন, 'তিনজন এক সাথে আইছি,গরম কাপড় কিনিবার বাবত। আত্মীয়র বাড়িত বেড়াবা আইছনো। যাবার বেলায় এন্না ঘুরি যাছি। যদি ভালায় ভালায় কিছু পাওয়া যায়।দেখিনো। দুটা কিনিওছি। আরো দেখেছি।এবার মেল্লায় দাম। তারপরও কম দামেরলা বাছি বাছি নেছি।'

দিনাজপুর হকার মার্কেট সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানালেন, এবার গাইডের দাম খুবই বেশি। তারপরও বেশি টাকায় গাইড কিনে পোষাচ্ছেনা। অনেক ছিড়া-ফাটা বের হচ্ছে। যা হাক-দিয়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ নিজে অথার পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর জন্য নিচ্ছে আবার কেউ নিচ্ছে গরু-ছাগল,কুকুর,বিড়ালকে পড়ানোর জন্য।

এবার বেচা-কেনা ছিলোনা। ক'দিন থেকে শীত বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে বেচা-কেনা। ভালোই হচ্ছে। আর ক'দিন এভাবে শীত থাকলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।'

শুধু হকাস মার্কেট নয়, রেল ঘুমটি থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সড়ক পর্যন্ত শীতের গরম পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে ওইসব ফুটপাতের দোকানগুলোতেও।

বিভিন্ন সাইজের সোয়েটার, জ্যাকেট, কানটুপি, মাফলার, শাল, ট্রাউজার, ফুলহাতা গেঞ্জি ও হুডিসহ বিভিন্ন শীতের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে এসব ফুটপাতেও। সাইজ অনুযায়ী দামও আলাদা। এক-দেড়শ টাকা থেকে শুরু করে আটশ’ টাকা দামের পোশাক মিলছে এসব দোকানে গরম পোষাক। এছাড়া হাত মোজা, কানটুপি ও ছোটখাট শীতের পোশাক মিলছে ১০০ টাকার ভেতরেই।

ফুটপাতের ক্রেতা আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের ক্রয়সীমায় মোটামুটি সবরকম পোশাকেই ফুটপাতে পাওয়া যাচ্ছে। শপিংমলগুলোতে কেনাকাটার চেয়ে ফুটপাতে কেনাকাটা ভালো এবং সাশ্রয়ী।’

দোকানি মনোয়ার হোসেন বলেন,বিক্রি শুরু হয়েছে কম্বলের, তাই প্রতিবারের মতো আমি এবারও কম্বল তুললাম দোকানে। বিক্রি ভালো হচ্ছে। মানভেদে বিভিন্ন কম্বল ১৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

জেলার বিরল উপজেলা থেকে ছেলের জন্য শীতের কাপড় কিনতে আসা শাহজাদা বলেন, এবছর বেশ ঠান্ডা। নিজের জন্য কোনমতে চলে গেলেও ছেলের জন্য একটি নতুন জ্যাকেট লাগবে। গার্মেন্টস্ এর দোকানগুলোতে যে দাম তাতে আমাদের মত গরীব মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাই এখানে এসেছি।

শহরের মালদহপট্টি থেকে শীতের কাপড় কিনতে আসা সবিতা বলেন, স্বামী সামান্য দিনমজুরের কাজ করে। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চালানোই মুস্কিল। যে শীত তাতে শীতের কাপড় না হলেই নয়। এখানে কম টাকায় পাওয়া যায়, তাই এখানেই এসেছি।

মেয়রে জন্য শতীতের কাপড় কিনতে আসা রাজেকুল বলেন আমি প্রতিবারে এখান থেকে আমার পরিবারের জন্য শীতের কাপড় কিনি এখানে কম দামে ভালো মানের কাপড় পাওয়া যায়।

দোকানদার রহমত আলী বলেন, 'প্রচন্ড শীত আসায় মানুষ কাপড় কিনতে আসছে। কিছুটা ভালো ব্যবসা হচ্ছে। তবে ক্রেতারা কেনার থেকে অকে কম দাম বলছে। আমাদের সারা বছর এখানে বেচাকেনা হয়না তোমন একটা শীতের দুই থেকে তিন মাস একটু ভালো বেচাকেনা হয় তা দিয়ে আমারা সারা বছর চলি।'

আরেক দোকানদার মোয়াজ্জেম জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে একটু কাস্টোমারের ভীড় বাড়ছে। এখানে সর্বনিম্ন বিশ টাকা থেকে বিভিন্ন দামের মাল পাওয়া যায়। ভীড় অনুযায়ী বিক্রি কম, কয়েকদিন থেকে বেচা-বিক্রি মোটামুটি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত:মাঘের তীব্র শীতে কাঁপছে দিনাজপুর। কয়েকদিন ধরে চলছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে বেড়েছে কুয়াশার দাপট। হিমেল বাতাসে আর শীতে কাবু মানুষ ও প্রাণিকুল। ঘটেছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন। চরম দূর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। কামাই-রোজগার কমে গেছে তাদের। গরম কাপড়ের অভাবে অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শরীরে উষ্ণতা নিচ্ছেন।
আর সাধ্যের মধ্যে থাকায় অনেকে ছুঁটছেন, লন্ড্রি বাজারে গরম কাপড় ক্রয় করতে।

(এস/এসপি/জানুয়ারি ২০, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test