E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৮ বছর আগে থানা লকআপ থেকে ডাঃ মোখলেছুর নিখোঁজ

সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ওসি এমদাদ, ফিরোজ ও এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ

২০২৪ জানুয়ারি ২৯ ১৮:৩৫:০৮
সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ওসি এমদাদ, ফিরোজ ও এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আট বছর আগে সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালির হোমিও চিকিৎসক  ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনিকে শহরের লাবনী মোড় থেকে ধরে এনে লকআপে তিন দিন আটক রাখার পর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সদর থানার দুইজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও একজন উপপরিদর্শকের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম জিয়ারুল ইসলাম সোমবার বিকেলে গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখার (সিআইডি) পুলিশ পরিদর্শক হারুণ অর রশিদের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে আগামি ২৬ মে তাদেরকে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেন।

মামলার আসামীরা হলেন, পিরোজপুর জেলা সদরের পিরোজপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ শেখের ছেলে সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ এমদাদুল হক শেখ, গোপালগঞ্জ জেলা সদরের করপাড়া গ্রামের আব্দৃল কাদের মোল্লার ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা এবং নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার পাংখাচর গ্রামের মোঃ সাঈদুর রহমানের ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক উপপরিদর্শক মোঃ হিমেল হোসেন।

মামলা ও ঘটনার বিবরনে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ঔষধ কিনতে যেয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাটের দোকান থেকে সদর থানার উপপরিদর্শক হিমেল হোসেন শহরের পারকুকরালির শেখ আব্দুর রাশেদ এর ছেলে হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে(২৭) থানায় ধরে নিয়ে যান। ৫,৬ ও ৭ আগষ্ট স্ত্রী জেসমনি নাহার রেশমা তার শ্বশুর আব্দুর রাশেদ, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপে তাকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ ও উপপরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির আল্লার দল নামে একটি জঙ্গি সংগঠণের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন ও উপপরিদর্শক হিমেল জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। টাকা না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। ৮ আগষ্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহম্মেদ, পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন (পাটকেলঘাটায় ১২০ ভরি সোনা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০২১ সালে চাকুরিচ্যুত), সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের জানিয়ে কোন লাভ হয়নি। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ সাধারণ ডায়েরী না নেওয়ায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন জেসমিন নাহার রেশমা। অবশেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন জেসমিন নাহার রেশমা। মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়।

পরবর্তীতে আদালত মাখলেছুরকে ওই বছরের ১২ এপ্রিলের মধ্যে সাতক্ষীরার বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ এর পাশাপাশি ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তকালে সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা নিখোঁজ ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি আল্লার দল নামে একটি জঙ্গী সংগঠণ করতেন বলে লিখিতভাবে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদন রিটকারির বিপক্ষে যায়।পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের বছরের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকোর্টে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লক আপ থেকে ডাঃ জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

প্রতিবেদনে তৎকালিন পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেল হোসেন হোমিও চিকিৎসক ডাঃ মোখলেছুর রহমানকে লাবনী মোড় থেকে তুলে আনা, থানা লকআপে নির্যাতন ও সেখান থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জড়িত বলে উল্লেখ করেন। থেকে জনিকে পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডাঃ জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে মহামান্য হাইকোর্ট ডাঃ জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরী নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্ল্যা ও উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ ও একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যেতে পারে বলে এক আদেশে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গার আইন সহায়তা চেয়ে না পেয়ে বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউ-েশনের চেয়ারপার্সন অ্যাড. সুলতানা কামালের সহায়তায় নিখোঁজ জনি’র বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ ২০২১ সালের ১৭ আগষ্ট সাতক্ষীরা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামী সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে জনিকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগ আনা হয়। মামলার নথিতে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের জাবেদা নকল, রিট পিটিশন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন ও পিবিআই প্রতিবেদনের ছায়ালিপি জমা দেওয়া হয়।

মামলা তদন্তে গোয়েন্দা অপরাধ ও তদন্ত শাখার কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক হারুণ অর রশীদ আসামীদের বিরুদ্ধে বাদির আনীত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে ডাঃ জনির শ্বাশুড়ি কলারোয়া উপজেলার লাঙ্গলঝাড়া গ্রামের মনোয়ারা খাতুনের জমি তৎকালিন লাঙ্গলঝাড়া ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন (বর্তমানে প্রয়াত)কৌশলে ইউনিয়ন পরিষদের নামে লিখে নেওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদ্বিরকারক হিসেবে ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনিকে শায়েস্তা করার জন্য এক কলারোয়া থানা থেকে হঠাৎ বদলী হয়ে আসা উপপরিদর্শক হিমেলের মাধ্যমে শহরের লাবণী মোড় থেকে তুলে আনা হয় মর্মে উল্লেখ করা হয়। পরবতীতে এমদাদ হোসেন ও হিমেলের পরিকল্পনায় ডাঃ মোখলেছুর রহমান থান লকআপ থেকে নিখোঁজ হন। প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী চতুর্থ ধার্য দিনে আদালত এ সমন জারির নির্দেশ দেন।

এর আগে ২০১৮ সালে উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে ৬/১৮, ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে যথাক্রমে ১৬/২০ ও ১৭/২০ বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় এমদাদ হোসেন ও ফিরোজ হোসেন মোল্লাকে চাকুরি থেকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে শেখ এমদাদ হোসেন উচ্চ আদালতে গেলে পরবর্তীতে তাকে পাবনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে নিখোঁজ ভিকটিম ডাঃ মোখলেছুর রহমানের বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ জানান, আসামীদের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ থাকলেও তার ছেলেকে জীবিত মা মৃত অবস্থায় উদ্ধার করতে গেলে আসামীদের রিমা-ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাই কোন আইনে আসামীদের সিআর মামলা থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় জিআর মামলায় বা অন্য কোন প্রক্রিয়ায় রিমা-ে নেওয়া যায় তার জন্য আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন তিনি।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বীর মুৃক্তিযোদ্ধা অ্যাড.মোসলেমউদ্দিন ও অ্যাড. ফরহাদ হোসেন বলেন, থানা লকআপে তিনদিন আটক রাখার পর ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি নিখোঁজ রয়ে গেলো। বছরের পর বছর দৌড়ঝাঁপ করে একটি সিআর মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ হলো। কিন্তু ভিকটিম উদ্ধারে আসামীদের রিমাণ্ডে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। তাই এ সংক্রান্ত আইনি ব্যাখ্যা চেয়ে তারা ঢাকার জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন বাবা ও মা তাদের সন্তানকে, স্ত্রী তার স্বামীকে ও সন্তান তার বাবাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেখতে পাবে না এটা হতে পারে না। তবে তিনি সমন জারির নির্দেশ দেওয়া পরবর্তী ওই পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৯, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test