E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বগুড়ার শাখারিয়া ইউনিয়নের মায়েদের বন্ধু 'মাতৃত্বকালীন ভাতা'

২০১৪ নভেম্বর ১৪ ১৮:১৩:৩২
বগুড়ার শাখারিয়া ইউনিয়নের মায়েদের বন্ধু 'মাতৃত্বকালীন ভাতা'

বগুড়া প্রতিনিধি : হঠাৎ করেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৪ মাসের শিশুকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মিনা খাতুন। বুকের দুধও পাচ্ছে না শিশুটি। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে আর্থিক দৈন্যতায় হতাশায় ছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার শাখারিয়া ইউনিয়নের জঙ্গলপাড়া গ্রামের কাফি-মিনা দম্পতি। এমন বিপদে তাদের বন্ধু হয়েছিল মাতৃত্বকালীন ভাতা।

ব্যাংক থেকে ৩ মাসের ভাতা হিসেবে ১০৫০টাকা পেয়েছেন মিনা। এ টাকায় তার শিশুর চিকিৎসা আর খাদ্য নিশ্চিত হয়েছে।বারুইপাড়া গ্রামের রেবা খাতুনের মাতৃত্বকালীন ভাতার টাকার উপকারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। প্রসবের সময় সন্তান সুস্থ হলেও অপুষ্টির কারনে শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্বামী হারুন গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকের কাজ করেন। হাসপাতালে স্ত্রীর প্রসবের সময় জমানো অর্থ ফুরিয়ে ফেলেছেন। তারপর মা ও শিশু বাড়ীতে ফিরলে ব্যয় বাড়ে তাদের। এসময় আশীর্বাদ হয়ে আসে মাতৃত্বকালীন ভাতার টাকা।জানা যায়, দরিদ্র মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায় উন্নত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ বৃদ্ধি এবং সন্তান প্রসব ও প্রসবোত্তর সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচি গ্রহণ করে। ২০০৭ সালে দারিদ্র মানচিত্র অনুযায়ী সারা দেশে ৩০০০টি ইউনিয়নে ১৫জন করে দরিদ্র গর্ভবতী মহিলা নির্বাচন করে ৩০০টাকা করে মাসিক মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়।

২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্যক্রম শুরু হলেও শাখারিয়া ইউনিয়নে ২০০৮-২০০৯ সালে এই কার্যক্রম শুরু হয়। সে বছর ইউনিয়নের ১৫জন গর্ভবতী দরিদ্র নারীর জন্য সরকার প্রায় ৫৪হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। মাসিক ৩০০টাকা ভাতা হিসেবে স্থানীয় ব্যাংক থেকে তিন মাসের এককালীন ৯০০টাকা করে বিতরণ করা হয়। ভাতাভোগীরা দুই বছরে ১লাখ ৮হাজার টাকা সহায়তা পান। পর্যায়ক্রমে ২০১৩/২০১৪ অর্থবছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে ইউনিয়নের ৩৬ জন মা ৩৫০ টাকা করে এই ভাতা সুবিধা পেয়েছেন। যা বর্তমান অর্থবছরে ৪৭জনে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৩৮ জন হত দরিদ্র মা এই ভাতা থেকে উপকৃত হয়েছেন। ভাতাভোগিদের তালিকা প্রনয়ণের জন্য উপজেলা নির্বাহি অফিসারকে সভাপতি ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে উপজেলা মাতৃত্বকালীন ভাতা কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে শাখারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি ও একজন এনজিও প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রয়েছেন। উপজেলা মাতৃত্বকালীন ভাতা কমিটি ভাতা ভোগীদের চূড়ান্ত বাছাই ও ভাতা বিতরণ কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করে থাকে।

শাখারিয়া গ্রামের মাতৃত্বকালীন ভাতার সুফলভোগী আলেয়া বেগম জানান, তার স্বামী দিন মজুর। অভাব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। যেখানে পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। সন্তান পেটে আসলে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর একটা কার্ড পান তিনি। তিনি বলেন, তার স্বামীর তখন কাজ ছিল না। ঘরে টাকাও নাই। কিন্তু সন্তানের খাবার আর ওষুধ কেনার জন্য টাকা দরকার। তখন ব্যাংক থেকে ১০৫০ টাকা পাই। তখন এই সামান্য টাকা আমাদের অনেক বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। গোপালবাড়ি গ্রামের তৌফিকের স্ত্রী রিমা আক্তার জানান, চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের পরিবারের আর্থিক দৈন্যতার কথা জানতেন। গর্ভবতি হওয়ার পরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলাম। চিকিৎসা ও ঔষধের জন্য টাকার প্রয়োজন হয়। চেয়ারম্যানের কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য গেলে তিনি আমাকে মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড করে দেন। সেখান থেকে ২বছর ধরে মাসে ৩৫০ টাকা করে ভাতা দিয়েছে। সন্তান প্রসব ও পরবর্তিতে সন্তান লালনে এই টাকা খুব উপকারে এসেছে। গোপালবাড়ি গ্রামের ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, বর্তমানে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যের ধারণা শুধুমাত্র মাতৃস্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মাতৃস্বাস্থ্যের যতেœর বিষয়টি শিশু ও কিশোর-কিশোরীসহ যে কোন বয়সের নারী ও পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। গর্ভবতী মায়েদের চাহিদা পূরণের বিষয়টি মানবাধিকার ও নৈতিকতার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কীয় বলে এসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে গর্ভবতী মা ও শিশু মৃত্যু হার হ্রাসে সহায়ক হয়েছে।

শাখারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান সফিক বলেন, এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র মায়েরা মাতৃত্বকালীন আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি মাতৃদুগ্ধ পানের উপকারিতা, গর্ভাবস্থায় উন্নত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ, প্রসব ও প্রসবোত্তর সেবা বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ সম্পর্কিত তথ্যাদি, যৌতুক, তালাক, বিবাহ ও জন্ম নিবন্ধন বিষয়ে সচেতন হবার সুযোগ পায়। মাতৃত্বকালীন ভাতা ভোগীর সংখ্যা ও ভাতার অর্থ দ্বিগুন করার সুপারিশ করে তিনি বলেন, শিশু খাদ্য ও ঔষধের মূল্য দিন দিন উর্ধ্বগতির জন্য এই সামান্য টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা পুরন অসম্ভব। এজন্য ভাতার অর্থ ওি ভাতা ভোগীর সংখ্যা দ্বিগুন করা প্রয়োজন। সদর উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তানজিমা আক্তার বলেন, শাখারিয়া ইউনিয়নে ইতিমধ্যে শুরু থেকে ১৩৮জন হত দরিদ্র নারী মাতৃত্বকালীন ভাতার সুফল পেয়েছেন। সদর উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা আব্দুর রহীম বলেন, নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের সহায়তা প্রদানের জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা কর্মসূচী মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি যুগান্তকারি পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে নারীর নিরাপদ মাতৃত্ব যা নারীর মৌলিক মানবাধিকার। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের অজ্ঞতা এবং অসচেতনতার কারণে প্রতি বছর প্রসবকালীন সময়ে অনেক মা ও শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্টির মধে এ মৃত্যুর হার প্রকট। এই অবহেলিত জনগোষ্টিকে সাহায্য করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এর নিজস্ব তহবিল হতে দরিদ্র মায়েদের সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রোগ্রামটি চালু করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ভাতার চাহিদা অনেক বেশি হলেও তার তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল। এক্ষেত্রে আরো বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন বলে সরকার ভাতা গ্রহীতা ও টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


(এএসবি/অ/নভেম্বর ১৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test