E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

লাখো দর্শকের পদচারনায় শেষ হলো তিন দিনব্যাপী জালাল মেলা

২০২৪ এপ্রিল ২৮ ২০:২৫:২৬
লাখো দর্শকের পদচারনায় শেষ হলো তিন দিনব্যাপী জালাল মেলা

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : লোকজ নাচে গানে আলোচনায় মুগ্ধ লাখো দর্শকের পদচারনায় শেষ হলো কেন্দুয়ায় তিন দিনব্যাপী জালাল মেলা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী কেন্দুয়ার কৃতী সন্তান সুনীল কর্মকার মেলায় শেষ গান গাইলেন- “মানুষ রতন কর তারে যতন, যারে তোমার মনে চায় ভবে মানুষও রতন”।

জালাল রচিত এই গানের মধ্য দিয়েই শনিবার রাত ৩টায় শেষ হলো কেন্দুয়া বাসীর প্রাণের জালাল মেলা। শিল্পকলায় সংগীতে মরনোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত-২০২৪ আত্ম সন্ধ্যানী মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁর ১৩০ তম জন্ম দিন উদযাপন উপলক্ষ্যে কেন্দুয়া উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে তিন দিন ব্যাপী বর্ণাঢ্য জালাল মেলা গত ২৫ এপ্রিল বেলা ৩টায় “জীবন আমার ধন্য যে হায়, জনম মাগো তোমার কোলে” এবং জালাল রচিত মানুষ রতন কর তারে যতন যারে তোমার মনে চায় ভবে মানুষ রতন এই দলীয় সংগীতের মধ্য দিয়েই শুরু হয় তিন দিন ব্যাপী মেলার উদ্ভোবনী অনুষ্ঠান।

ভার্চুয়ালী জালাল মেলা ও আয়োজকদের অভিন্দন জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমী ও স্বাধীনতা পুরুষ্কার প্রাপ্ত জালাল গবেষক অধ্যাপক যতীন সরকার।

তিনি বলেন জালাল বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার কবি ও সাধক। তার রচিত গান দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি কেন্দুয়ায় জালাল একাডেমী স্থাপনের মাধ্যমে জালাল রচিত সব গান সংরক্ষনের দাবি জানান।

জালাল মেলা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্ভোবন করেন নেত্রকোণা-৩ আসনের এমপি, ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু।

তিনি বলেন ছোট বেলায় পরিবারের সকলের সাথে বসে যেভাবে বাউল গান শুনেছি সেই বাউল গানকে টিকিয়ে রাখতে সকল বাউল শিল্পীদের প্রতি আহবান জানান। ভাইসাব খ্যাত সামিউল হক ভূঞার সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন নেত্রকোণার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাফিকুজ্জামান। আলোচক হিসাবে জালাল উদ্দিন খাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরুষ্কার প্রাপ্ত নাট্যকার ও লোক সংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া। আলোচনা করেন সাবেক সচিব লেখক প্রাবন্ধিক মাসুদ সিদ্দিকী।

এছাড়া জালাল খাঁর দর্শন ও জীবনী নিয়ে আলোচনা করেন তারই দৌহিত্র লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক গোলাম ফারুক খান ও গোলাম মুর্শেদ খান।

আলোচনা শেষে সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত জালাল রচিত গান পরিবেশন করেন বাউল সুনীল কর্মকার, বাউল আব্দুস সালাম সরকার ও লোক শিল্পী পালা গায়ক আব্দুল কুদ্দুছ বয়াতী। তাদের নাচে গানে মুগ্ধ হন হাজার হাজার দর্শক।

কেন্দুয়া স্প্রাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দিন বেলা ৩টায় প্রধান অতিথির আলোচনা করেন নেত্রকোণা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সুখময় সরকার, মুখ্য আলোচক হিসাবে আলোচনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: আব্দুস সামাদ আলোচক হিসাবে আলোচনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: এইচ.এম সাইদুর রহমান, কবি পিয়াস মজিদ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় গণ সংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার আসিফ বিন আলী, সাংবাধিক বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরুষ্কার প্রাপ্ত লোক সংস্কৃতি গবেষক প্রাবন্ধিক সুমন কুমার দাশ ও দৈনিক প্রথম আলো নেত্রকোণা জেলা প্রতিনিধি পল্লব চক্রবর্তী। সন্ধ্যার পর থেকে বাউল কপি আব্দুস সালাম সরকার, ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠীর বেতার টিভি শিল্পী প্রদীপ পন্ডিত সুসেন সাহা রায়, সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা বাউল মুকুল সরকার ও উদীচি শিল্পী গোষ্ঠীর অন্ধ বাউল আলেয়া সহ অন্যান্য শিল্পীরা বাউল গান পরিবেশ করে দর্শক স্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। রাত ৮ টা থেকে জালাল খাঁর জীবনী নিয়ে জমিলা মেমোরিয়াল বিদ্যানিকেতন ছাত্র/ছাত্রীদের পরিবেশনায় নাটক “মানুষ রতন” মঞ্চস্থ হয়।

শেষ দিন ২৭ এপ্রিল সকাল ১১ টা থেকে পূর্ব ময়মনসিংহের মালজোরা বাউল গান ও জালাল খাঁ বিষয়ে মুখ্য আলোচক হিসাবে আলোচনা করেন লেখক ও গবেষক আলী আহাম্মদ খান আইয়োব আলোচক উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর নেত্রকোণা জেলা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান খান, কবি সরোজ মোস্তফা, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় নেত্রকোণার সহকারী অধ্যাপক সফিউল্লাহ, সাংবাধিক ছড়াকার ও লোক সংস্কৃতি গবেষক সঞ্জয় সরকার ও কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গীতিকার নাট্যকার, মোঃ নুরুল ইসলাম। বিকাল ৩ টা থেকে শুরু হয় জালাল গীতি পরিবেশনা। নেত্রকোণা বাউল সমিতির সভাপতি বাউল উমেদ আলী ফকির, সাধারণ সম্পাদক ফকির চান, পল্লী বাউল হবিল সরকার, বাউল শেফালি সহ প্রায় বিশজন শিল্পী বাউল গান পরিবেশ করেন। এছাড়া সাধক আব্দুল মজিদ তালুকদারের ছেলে কন্ঠ শিল্পী আবুল বাশার তালুকদার ও অন্যান্য শিল্পী বৃন্দ বাউল গান পরিবেশ করেন। প্রতিদিনই নাচে গান পরিবেশন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন ইউ.এনও ইমদাদুল হক তালুকদার।

তিন দিন ব্যাপী মেলা উপলক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন সার্বজনীন পেনশন স্কীমের হেলফ ডেস্ক স্থাপন করে এবং কেন্দুয়া উপজেলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে জালাল উদ্দিন খাঁ স্মরনে ১৩০ তম জন্মদিনকে স্মৃতি হিসাবে রাখার জন্য প্রচন্ড তাপদাহে জালাল মেলায় আগত দর্শকদের হাতে ১৩০টি গাছের চারা তুলে দেন।

শেষ দিন গানের ফাঁেক ফাঁকে আলোচনায় বাউল সুনীল কর্মকার বলেন দীর্ঘ ৪০ বছরের মধ্যেও এরকম একটি মেলার আয়োজন কেন্দুয়াতে হতে দেখিনি। এবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের নেতৃত্বে সহ-কমিশনার ভূমি ও অফিসার ইনচার্জ মোঃ এনামুল হক পি.পি.এম তিন দিন ব্যাপী জালাল মেলার আয়োজন করে প্রমাণ করে দিয়েছেন আমরাও পারি। এরকম মেলা প্রতি মাস প্রতি বছর করার দাবি করেন লোক শিল্পী আব্দুল কদ্দুস বয়াতী ও বাউল আব্দুস সালাম সরকার সহ মেলায় আগত নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নান্দাইল ময়মনসিংহ, মদন ও খালিয়াজুরী ও কেন্দুয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বাউল শিল্পীরা।

সমাপনী দিনে সভাপতির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, সকলের দাবির প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে উপর মহলে যোগাযোগ করেছি জালাল সংগীত ও সুর শুদ্ধভাবে পরিবেশন ও সংরক্ষনের জন্য কেন্দুয়ায় একটি “জালাল একাডেমী” স্থাপন করা হবে। এছাড়া জীবিত থাকা অবস্থাতেই বাউল সুনীল কর্মকারকে যথাযথ মূল্যায়ন করে উপযুক্ত পদকের ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

তিনি চারণ সাংবাদিক হিসাবে পুরুষ্কার প্রাপ্ত সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মার দাবির প্রেক্ষিতে “জালাল উদ্দিন খাঁ পদক” চালু করার ঘোষনা দেন। জালাল মেলা উপলক্ষ্যে ভাব তরঙ্গ নামে একটি স্মরনিকা প্রকাশ করা হয়। মেলায় আগত কবি পহেলী দে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন মেলা মানেই কোনো পুন্য সামগ্রী বেচা কেনার মেলা নয় মেলা মানেই মানুষে মানুষে মনের মেলা প্রাণের মেলা ও সংস্কৃতির মেলা।

(এসবিএস/এএস/এপ্রিল ২৮, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test