E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবনে তেল অপসারণে এবার ‘আপারেশন বুম’

২০১৪ ডিসেম্বর ১৭ ১৮:০৬:২৮
সুন্দরবনে তেল অপসারণে এবার ‘আপারেশন বুম’

সুন্দরবন থেকে আহসানুল করিম : এবার সুন্দরবনে ভাসমান তেল অপসারণে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন বুম’। সুন্দরবনের শ্যালা নদীসহ আশপাশের ১৮টি খালসহ জলাভূমিতে ট্যাংকার ডুবিতে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে পদ্মা অয়েলের কাছ থেকে আনা ৫টি ৪৩২ফিট লম্বা বুম দিয়ে তুলে নেয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের জেলে-বনজীবীরা এভাবে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসান কাজের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন বুম’।

বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো সুন্দরবন সন্নিহিত বলেশ্বর নদী থেকে ৩টি ট্রলারে করে একাধিকবার কচুরিপানা এনে শ্যালা নদীসহ আশপাশের ১৮টি খালসহ জলাভূমির তেলের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব কচুরিপানায় তেল লেগে আটকে গেলে পরে তা তুলে ফেলা হবে। সুন্দরবন বিভাগ তৃতীয় দিনের মতো গাছের গোড়ায় লেগে থাকা তেল অপসারণে পাম্প মেশিন দিয়ে পানি স্প্রে করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের জনসাধারনসহ জেলে-বনজীবীরা সনাতন পদ্ধতিতে তেল আহরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী এতথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে বুধার ৪ হাজার ৬শ’লিটারসহ গত ৬ দিনে পদ্মা অয়েল কোম্পানী মোট ৬০ হাজার ৮শ’ লিটার তেল কিনেছেন বলে ঠিকাদার পদ্মা অয়েল কোম্পানীর রফিকুল ইসলাম বাবুল নিশ্চিত করেছেন।

ক্ষতির মুখে সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় বনজ সম্পদের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হবে মৎস্য সম্পদের এমন দাবী করেছে জেলে- মৎস্যজীবী ও প্ররিবেশবাদীরা। গত এক সপ্তহ ধরে সুন্দরবনের নদী খাল নিয়মিত পরিদর্শন শেষে এমন কথাই তারা বলছেন। পবিবেশবাদীদের মতে, সুন্দরবনের নদী-খালে যে প্রানের অস্তিত্ব ছিল তা এই মূহূর্তে দেখা যাচ্ছে না । ক্ষতিকর তেলের ধকল কাটিয়ে কতো পরে নদী খালে প্রানের স্পন্দন দেখা যাবে তা বলা দূরুহ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মংলা শাখার আহবায়ক নুরে আলমের মতে, জোয়ারের সময়ে শ্যালা নদীর শাখা প্রশাখায় ছোট পোনা মাছের অবাধ বিচরন নেই বললেই চলে। অথচ এই দূর্ঘটনার আগে এসকল নদীতে নৌকা নিয়ে ডুকলেই ঝাকবেধে রেনু পোনার দল ছুটে বেড়াতে দেখা গেছে। তেলের বিষক্রিয়ায় বড় জলজ প্রানীর কম ক্ষতি হলেও চরম ক্ষতির শিকার হয়েছে অসংখ্য প্রজাতির রেনু পোনা।

বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জীববৈচিত্রে ভরপুর পৃথিবীর বৃহত্তম একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। সুন্দরবনের মোট আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলো মিটার। এর মধ্যে স্থল ভাগের পরিমান ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলো মিটার ও জলভাগের পরিমান ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলো মিটার । এবনের ছোট বড় নদী খালে ছড়িয়ে রয়েছে কুমির,ডলফিন, হাঙ্গর ও নানা প্রজাতির মাছ। সমগ্র সুন্দরবনের জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল ভারানী ও নদী নালা। এই জলভাগ সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ ভাগ । লবন পানি ও নিয়মিত জোয়ার ভাটা সুন্দরবনের নদী নালার বৈশিষ্ট্য। বলেশ্বর,কুংগ-মালঞ্চ, রায়মঙ্গ, শিবসা ও পশুর ইত্যাদি প্রধান নদী সমুহ মোহনা রুপে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এছাড়া ৪৫০ টি নদী খালের মধ্যে অড়পাঙ্গাসিয়া,যমুনা, শ্যালা,চুনকড়ি, খোপেটুয়া, কটকা, অড়ুয়াশিবসা, শাকবাড়িয়া, ঝাপা, বেতমারা, মরাপশুর,হংশরাজ,বল-হড্ডা, ও কাগা নদী উল্লেখযোগ্য।

এসকল নদী ও জলরাশির সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের এক বিরাট আধার। যার উপর অসংখ্য মৎস্যজীবি তাদের জীবিকা নির্ভর করে আসছে শত শত বছর ধরে। সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের মোহানায় গড়ে উঠার কারনে মৎস্য আবাস্থললে পরিনত হয়েছিল। সমগ্র সুন্দরবনে ২১০ প্রজাতির মাছ ১৩ প্রজাতির কাকড়া, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির শামুক ঝিনুক পাওয়া যায়। ২১০ প্রজাতির মাছের মধ্যে রুপচাদা, ভেটকি, পোয়া , পাংগাস, লইট্যা, পারশে, তাপশী,মেদ, ছুরি, চিত্রা,দাতিনা, কাইন মাগুর, চিংড়ি উল্লেখযোগ্য। ২৬ প্রজাতির চিংড়ির মধ্যে বাগদা, গলদা, চাকা ১৩ প্রজাতির কাকড়ার মধ্যে শিলা কাকড়া, ৪২ প্রজাতির শামুকের মধ্যে জোংড়া, কস্তুরী ঝিনুক উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছর কেবল মাত্র সুন্দরবন থেকেই ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ ,৩ হাজার মেট্রিকটন চিংড়ি ও কাকড়া ও ৭৫০ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়ে থাকে।

বনবিভাগ সুন্দরবনের এ বিপুল পরিমান মাছ সংরক্ষণে পশ্চিম এবং পূর্ব ও দক্ষিন সুন্দরবনের ১৮টি খালে সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে । এক কথায় যাবে বলা হয় মাছের অভয়শ্রম। বিপুল পরিমান এমৎস্য সম্পদ দেশের আভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী হয়ে আসছে। সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় দেড় লাখ লোক নিযুক্ত রয়েছে।

বিপুল এ সম্পদের আধার এখন হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে । গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের অভায়াশ্রম শ্যলা নদীর মৃগমারী এলাকায় অয়েল ট্যাংকার ডুবির কারনে দগদগে ক্ষত নিয়ে দাড়িয়ে আছে সুন্দরবন। বন ও জলজ প্রানীর যে প্রভুত ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হতে চলেছে। বনের বৃক্ষরাজিতে ফার্নেস অয়েল লেগে বিবর্ন হতে শুরু করেছে । নদী খালে দেখা মিলছে না ভেসে বেড়ানো রেনু পোনার ঝাক,তেলের বিষক্রিয়ায় অনেক ঘুরেও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না পারিযায় পাখির।

স্বস্তি ফিরেছে বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে। পশুর নদীর পাশে গড়ে তোলা সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের এই প্রজনন কেন্দ্রের চৌবাচ্চায় নদী থেকে পানি তুলতে হয়। নদীর পানিতে তেল ভাসতে থাকায় পানি তোলা যায়নি কেন্দ্রটিতে। এক বার পানি তোলায় ৭টি কুমিরের বাচ্চার মুখে ক্ষত দেখা দেয়। এর ফলে কয়েক দিন পানি পরিবর্তন করতে না পারার ফলে প্রজনন কেন্দ্রের কুমির ছানাগুলোকে মলমূত্রের মধ্যে বসবাস করতে হয়েছে। হরিণ ও বানরকে পানির কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে।

জোয়ার ভাটার টানে ও বনবিভাগের তেল অপসারণ অভিযানের কারণে নদীর পানি তেলমুক্ত হওয়ায় আবারও আগের মতো প্রজনন কেন্দ্রে নদীর পানি তোলা সম্ভব হয়েছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুর রব। তিনি জানান, প্রজনন কেন্দ্রে নতুন করে পানি তুলতে পারায় স্বস্তি বিরাজ করছে।

২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট একর জমির ওপর বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি কুমির নিয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়।

করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ১৮টি চৌবাচ্চায় চার মাস থেকে ছয় বছর বয়সী মোট ২৫৫টি লবণ পানির কুমির, ৪৬টি হরিণ, ৩টি বানর, করমজল ঘাটেই সুন্দরবনের একটি মানচিত্র (এই মানচিত্রে একনজরে সুন্দরবনকে দেখা যায়), বাঘ-হরিণের কঙ্কাল, কুমিরের নমুনা ডিম, কুমিরের মাথাসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন নমুনা রয়েছে বলে তিনি জানান। এ পর্যন্ত এখানকার কুমির ৫৭৪টি ডিম দিয়েছে। যার মধ্যে ৩৫৭টি বাচ্চা হয়েছে। এখান থেকে ৮৭টি কুমির বনে ছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পার্কে কুমির সরবরাহ করা হয়েছে।করমজলে কাঠের তৈরি টাওয়ার আছে। যেখানে উঠে সুন্দরবনের বিশাল এলাকা সহজে দেখা যায়।

এদিকে জোয়ার-ভাটার টানে সুন্দরবনের নদী-নালা-খালে যাতে তেল আরো ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য বাঁশ, কাঠ ও পলিব্যাগ ব্যবহার করে বুম (পানির ওপর ভাসমান বাঁধ) তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীতে ভাসমান উদ্ভিদ এবং তীরে গাছের গোড়া, পাতা ও কা-ে লেগে থাকা তেল অপসারণে সোমবার থেকে তিনটি পাম্প মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌকায় মেশিন বসিয়ে নদী থেকে পানি তুলে মোটা পাইপ দিয়ে তা গাছপালার গায়ে ছিটিয়ে তেল পরিষ্কারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অন্য জায়গা থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে জোয়ারের সময় সেগুলো শ্যালা নদীসংলগ্ন খাল-নালায় ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পরে ভাটি থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাছগাছালির গোড়া এবং নদীতীরে লেগে থাকা তেল মুছে নিয়ে ভাটিতে নামছে কচুরিপানাগুলো। সব মিলিয়ে তেলে বিবর্ণ সুন্দরবনে প্রাণ ফেরাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন স্থানীয় ২শ’ মানুষ ১শ’ নৌকা নিয়ে।

(একে/এএস/ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test