E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

চাঁদপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে

২০১৪ মে ০৮ ১৮:৫৬:২১
চাঁদপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে

চাঁদপুর প্রতিনিধি : চাঁদপুরের এক শ্রেণীর ভূমিদস্যুদের টার্গেটে পড়েছে রেলওয়ের দৃষ্টিনন্দন ২টি লেক, পুকুর ও চাঁদপুরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এরা লেক, পুকুর ও শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণে মাস্টার প্ল্যানের কথা বলে নিরীহ ও সরল প্রকৃতির লোকজনের কাছ থেকে আগাম পুঁজি সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় নেমেছে।

আর এদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ইন্ধনদাতা হচ্ছেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) অফিসে কর্মরত ভূমি বিভাগের অসাধু এক কর্মকর্তা, কিছু কর্মচারী, লাকসামে কর্মরত কানুনগো এবং চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত সিআরবিতে কর্মরত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কিছু অর্থলিপ্সু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। চাঁদপুর থেকে ভোরে মেঘনা আন্ত:নগর ট্রেনযোগে ভূমিদস্যু ও তাদের প্রতিনিধিরা চট্টগ্রামে ডিআরএম অফিস ও সিআরবিতে যায় এবং সারাদিন নানা তদবির, ফন্দি ফিকির করে আবার বিকেল ৫টায় রওনা দিয়ে চাঁদপুর পৌঁছে।

ঘন ঘন চট্টগ্রামে যাতায়াতের মধ্য দিয়ে এসব ধান্দাবাজ ভূমিদস্যুরা পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং খুব সহসাই রেলওয়ের জায়গায় মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারার আশ্বাস ও সম্ভাবনার কথা বলে পকেট ভারী করার চেষ্টা চালায়। এদের এ চেষ্টায় প্রধান ইন্ধনদাতা হিসেবে ডিআরএম অফিসে কর্মরত সহকারী বিভাগীয় ভূমি কর্মকর্তা (এডিইও) এমএ বারী, লাকসামে কর্মরত কানুনগো আব্দুল হালিম ও জনৈক অফিস পিয়ন হাশেমের অপতৎপরতা এখন অনেকের মুখে মুখে। এরা ভূমিদস্যুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে চাঁদপুরের রেল ভূমি দখলে ইন্ধন দেয়।

কিন্তু পরবর্তীতে পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলে এবং অভিযোগ দায়ের হলে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন মহলের চাপে তারা নিজেরাই দখলমুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে নিজেদের সাফাই নিজেরাই গায়।

চাঁদপুর শহরের মিশন রোডের দক্ষিণ পাশে রেললাইন সংলগ্ন রেলওয়ের বিরাট জলাশয় ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জোরপূর্বক নির্বিঘ্নে ভরাট করার মধ্য দিয়ে রেলওয়ের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশের কথা বিশ্বস্ত সূত্রে এখন ছড়িয়ে পড়ছে। রেল কর্তৃপক্ষ ভূমিদস্যুদের উক্ত জলাশয়টি ভরাট করার পূর্ণ সুযোগ দিয়ে অবশেষে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখির প্রেক্ষিতে অনেকটা ঠেকে গিয়ে গাছাড়া দিয়ে উঠেছে। নিয়েছে কিছু ব্যবস্থা।

এমতাবস্থায়ও ভূমিদস্যুরা মিশন রোডের পাশে অবস্থিত রেলওয়ের দৃষ্টিনন্দন লেকটি (যা মনু হাজী নামে এক ব্যক্তির মৎস্য চাষের আওতাধীন) এবং বঙ্গবন্ধু সড়ক ও ফায়ার সার্ভিস অফিসের দক্ষিণে অবস্থিত রেলওয়ের লেকটিতে মার্কেট নির্মাণের মাস্টার প্ল্যান রেল কর্তৃপক্ষ ব্যাকডেট দিয়ে পাস করেছে বলে প্রচার করে পুঁজি সংগ্রহের গোপন চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ভূমিদস্যু চক্রটি চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থানটিতেও মার্কেট নির্মাণের মাস্টার প্ল্যান রেল কর্তৃপক্ষ পাস করেছে বলে এবং মাস্টার প্ল্যানের চিত্র দেখিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে দোকান বরাদ্দ দেয়ার নাম করে অর্থ সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। এরা বর্তমানে চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বাইতুল আমিন জামে মসজিদের পেছন থেকে শুরু করে কয়েকটি মাছ চাষের পুকুর কমার্শিয়াল লাইসেন্স এনে ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ করবে বলে একটি সমিতির ব্যানারে বিভিন্ন জনকে দোকান বরাদ্দের লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিষয়টি রেলমন্ত্রী, রেল ভবন পর্যন্ত গড়ালেও এডিইও, কানুনগোসহ চট্টগ্রামে কর্মরত অসাধু কিছু রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে প্রয়োজনীয় দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণের পর্যায় থেকে পেছনে পড়ে রয়েছে। মিশন রোডের দক্ষিণ পাশের জলাশয়টি যে প্রক্রিয়ায় ভরাট হয়েছে উপরোক্ত পুকুরগুলোও সে প্রক্রিয়ায় ভরাটের স্বপ্ন দেখছে এবং আস্ফালন করছে একটি সমিতির ব্যানারে সংগঠিত কিছু ভূমিদস্যু। এ নিয়ে স্থানীয় আদালতে একটি নিষেধাজ্ঞার মামলাও চলমান রয়েছে।

এ দিকে লাকসাম-চাঁদপুর শাখা রেললাইনের ব্রিজের তলদেশ দিয়ে আবারো আনলোড (ভরাট) ড্রেজার পাইপ স্থাপন করছে ভূমিদস্যুর আরেকটি অংশ। তারা চাঁদপুর শহরতলীর মৈশাদী হতে শাহতলীসহ রেলপথের বিভিন্ন স্থানে ৬/৭টি ড্রেজার পাইপ সংযোগ বসিয়েছে। এর আগে রেললাইন বোরিং করে একই প্রক্রিয়ায় ভরাট কাজ চালিয়ে নেয়ার সময় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে এবং কিছু ড্রেজার পাইপ জব্দ করে। সে ড্রেজার পাইপ অল্প ক’ দিনের মধ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে পুনরায় অবৈধ পন্থায় ভরাট এবং দখল কাজ চালাচ্ছে। এখানেও অসাধু রেল কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়, প্রধান প্রকৌশলী পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে চট্টগ্রাম বরাবর আবেদন করে এসব ড্রেজার পাইপ বসানো হয়েছে বলে ভরাট কাজে জড়িতরা এলাকায় প্রচার করছে। অপরদিকে রেলওয়ের পুকুর-জলাশয়, ডোবা কৃষি লীজ এনে সেখানে মৎস্য চাষ করা হচ্ছে। কৃষি লিজের অন্তরালে রেলওয়ের জায়গা ভরাট করে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও কর্তৃপক্ষ এখানেও অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ায় সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে।

সূত্রটি আরো জানায়, রেলওয়ের জায়গা কৃষি লীজ পাওয়া সহজ। উপরোক্ত রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে অনেকে কৃষি লীজ এনে সেখানে মৎস্য চাষ করছে। এ প্রক্রিয়ায়ও রেলের অনেক সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে এবং সেখানে দোকানপাট, ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জলাশয় ভরাট আইনত দ-নীয় অপরাধ। জলাশয় ভরাট বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৬-এর ঙ ধারার লঙ্ঘন। যার শাস্তি প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদ- বা অনধিক দু’ লাখ টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-। প্রতিটি অপরাধের জন্য অন্যূন ২ বছরের কারাদ- অনধিক ১০ বছর কারাদ- বা অন্যূন দু’ লাখ টাকা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

এ প্রথম চাঁদপুরে রেলওয়ের জলাশয় ভরাট করায় পরিবেশ অধিদপ্তর শহরের মিশন রোডের দক্ষিণ পার্শ্বে ভরাটকৃত জায়গার উপর সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুরের কর্মকর্তা আরেফিন বাদল জানান, যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে বায়ূম-ল উত্তপ্ত হচ্ছে। জলাশয় ভরাটের কারণে এর দীর্ঘ মেয়াদী বিরূপ প্রভাব পড়বে। এ কারণে জলাশয় ভরাট না করতে জনগণকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আইনের ব্যাখ্যা তুলে ধরে সেখানে নোটিস টানিয়েছেন। জানা যায়, চাঁদপুর রেলওয়ের শ’ শ’ একর ভূমি, একাধিক লেক, অসংখ্য পুকুর, জলাশয় এবং ডোবা-নালা একশ্রেণীর ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে যেভাবে বে-দখল হয়ে যাচ্ছে তাতে চাঁদপুরের পরিবেশ ভারসাম্য হারাতে পারে এমন আশঙ্কার কথাই জানিয়েছেন এখানকার পরিবেশবাদী ব্যক্তিবর্গ বা সচেতন মহল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ স্বার্থে রেলওয়ের দৃষ্টিনন্দন লেক, পুকুর, জলাশয়গুলোকে দখলের হাত থেকে রক্ষা করে চাঁদপুরের পরিবেশ সংরক্ষণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ চাঁদপুর পৌরসভা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ স্থানীয় প্রশাসনকে না জানিয়ে ভূমিদস্যুদের দখল প্রক্রিয়ায় সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হাসান মো. শামসুদ্দোহা জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের মনমতো এসব করছে। তারা পৌরসভার অনুমতি দূরে থাক, কোনো কিছু জানানোরও প্রয়োজন মনে করছে না। তিনি দখল প্রক্রিয়া বন্ধে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় এবং আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক (রেলভবন ঢাকা) মুঠোফোনে বলেন, রেলওয়ের জায়গা সামনে যাতে দখল না হয় সেজন্যে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবাদী সুশীল সমাজ এবং সাংবাদিকদের সহযোগিতা চাইছি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম-এর জিএম মো. মুকবুল আহমেদ জানান, এক থেকে দেড় একর রেলওয়ের জলাশয় অন্যায়ভাবে ভরাট করায় একজন প্রকৌশলীসহ রেলওয়ে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চাঁদপুর রেলওয়ের জলাশয় ভরাট করার জন্য কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি বলেও তিনি জানিয়েছেন। চাঁদপুর রেলওয়ে থানা (জিআরপি) অফিসার ইনচার্জ সুভাষ কান্তি দাস জানান, রেল লাইনের ১০ ফুটের বাইরে জিআরপি পুলিশের কোনো ক্ষমতা নেই। রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘর-টর তুলে ফেলানোর পর ওসির কাছে আসে। তখন কিন্তু আদালতের নির্দেশ ছাড়া দখল ভাংতে পারি না।

(এমজে/এটি/মে ০৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test