E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জাজিরায় ফুল থেকে সংগৃহিত মধু রপ্তানী হচ্ছে ভারতে 

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ১৩ ১৫:৪৭:৪৫
জাজিরায় ফুল থেকে সংগৃহিত মধু রপ্তানী হচ্ছে ভারতে 

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরের জাজিরায় হাজার হাজার বিঘা জমির ধনিয়া ও কালোজিরা জাতিয় মশলার ফুল থেকে মধুু সংগ্রহ করে স্বাবলম্বি হচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলের শত শত মৌ চাষি। তাদের সংগৃহিত মধু ভারতে রপ্তানী করে মাত্র দেড় মাসে তারা আয় করে নিচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি মৌমাছির পরাগায়নের ফলে বাড়ছে মশলার ফলন, এতে লাভবান হচ্ছে কৃষকরা। তবে মধুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছে মৌয়ালীরা।

শীতের কুয়াশাকে পেছনে ফেলে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার কৃষি জমিগুলো সেজেছে এখন মশলা ফুলের ধবধবে সাদা রঙে। শরীয়তপুর-ঢাকা মহা সড়কে জাজিরা টিএন্ডটি মোড় ছারলেই সোঝা ২২ কিমি ব্যাপী কাঠালবাড়ি ফেরিঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে যে দৃশ্য সকলের নজর কাড়ে তা অবাক করার মত। দেখা যাবে রাস্তার পাশে, ঝোপে-ঝাড়ে, ক্ষেতের কিনারে, মরা খালের মাঝখানে কিছু দুর পর পরই ২ফিট দৈর্ঘ্য, দেড় ফিট প্রস্থ আর দেড় ফিট উচ্চতার শত শত কাঠের তৈরি বাক্স ২/৩ ফিট পর পর সাড়িবদ্ধ ভাবে সাজানো রয়েছে। এগুলো সব মৌচাষের বাক্স। এখানে নিউপ্লাস, বুরুট ও সুপার নামের তিন ধরনের বাক্স রয়েছে। নিউপ্লাসের মধ্যে থাকে রানী মৌমাছি, ইংরেজী বুরুট শব্দকে বলা হয় বাচ্চাঘর এবং সুপার সাইজের বাক্সকে বলা হয় হানি চেম্বার বা মধুর থলে। এই বাক্সগুলোর মধ্যে ৬-১৬ টি ফ্রেম বা মৌমাছি থাকার প্লেট বসানো রয়েছে। এই প্লেটগুলোর মধ্যে তিন ধরনের অষ্ট্রেলিয়ান মেলিফেরা জাতের মৌমাছি রাখা হয়েছে। রানী, পুরুষ ও শ্রমিক জাতের মৌমাছিরা একইসাথে অবস্থান করে এই বাক্সে। শুধু শ্রমিক মাছিরা ঘুরে ঘুরে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ৪ শত হেক্টর জমিতে ধনিয়া ও কালোজিরার আবাদ করা হয়েছে। জাজিরা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে এবছর সাতক্ষিরা, ঝিনাইদাহ, মানিকগঞ্জ, খুলনা, যশোর, টাঙ্গাইল, নড়াইল, সিরাজগঞ্জ ও রংপুর অঞ্চল থেকে অন্তত ২ শত ৮০ থেকে ৩ শতটি ভ্রাম্যমাণ মৌচাষির দল এসেছে। তাদের প্রতিদলে ৩ থেকে ৭ জন করে মৌ শ্রমিক রয়েছে। প্রতি ছোট দলে ৮০ থেকে ১০০টি বাক্স এবং বড় দলে ১’শ ৫০ থেকে ২’শ ৫০টি করে বাক্স বসিয়ে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করছে। ২০০৮ সাল থেকে এ অঞ্চলে মৌচাষিরা ভ্রাম্যমান মৌ চাষের কাজ করছে। জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধু সংগ্রহের কাজ শুরু হয় আর চলে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সময় পর্যন্ত। দেড় মাসে কমপক্ষে ৪ বার মধু তোলা যায়।

মৌয়ালীরা এবছর জাজিরা থেকে ১২০ থেকে ১ শত ৪০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ধনিয়ার আবাদ গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় লক্ষমাত্রা ছারিয়ে যাবে বলে ধারনা করছে সংশ্লিষ্টরা। জাজিরা উপজেলায় এবছর অন্তত ৩০ হাজার বাক্স স্থাপন করে চলছে মধু সংগ্রহ। একেকটি বাক্স থেকে মৌসুমে ন্যুনতম ৬ কেজি করে মোট প্রায় ১ শত ৮০ মেট্রিক টন মধু আহোরিত হবে। যার বাজার মুল্য হবে কমপক্ষে সাড়ে ৩ কোটি টাকা।

বাজারে খুচরা এই মধুগুলো তারা আড়াই শত থেকে ৩’শ টাকা করে বিক্রি করে। পাইকারী বিক্রি হয় দেড় শত থেকে ২’শ টাকায়। বাংলাদেশের প্রান কোম্পানী, আয়ুর্বেদী ফার্মাসী, হামদর্দ ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপ এই মধুগুলো তাদের নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে ক্রয় করে থাকে। এ বছর ভারতের ডাবর কোম্পানী ও মুনডাজ এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড এর প্যানাসিয়া হানি বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টন মধূ আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।

মৌচাষিরা জানালেন এক সময় এ অঞ্চলের কৃষকেরা মৌচাষকে তাদের ফসলের জন্য ক্ষতিকারক মনে করে বাধা প্রদান করতো। এখন তারা সহায়তা করছে। মৌচাষ করে তারা স্বাবলম্বি হওয়ার কথাও বললেন। কিন্তু মধুর ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তাদের। স্থানীয় কৃষকরা এখনো অনেকে মৌচাষের নেতিবাচক দিক বিবেচনা করলেও কৃষি বিভাগের পরামর্শের কারনে বেশীরভাগ ধনিয়া ও কালোজিরা চাষি এর ইতিবাচক দিকটি এখন বুঝতে পেরেছেন।

জাজিরার সেনেরচর ইউনিয়নের আবু আলেম মোল্যা, গোপালপুরের আব্দুল মজিদ, মুলনা ইউনিয়নের কুদ্দুস তালুকদার ও দবির উদ্দি মাদবর, বিকে নগরের সেকান্দার ঢালী প্রত্যেকে তারা এবছর ৫ থেকে ৮ বিঘা করে জমিতে ধনিয়ার আবাদ করেছেন। তারা বলেন, আগে আমরা ভাবতাম সমলা ক্ষেতের পাশে মৌচাষ করলে ফসলের গোটা ছোট হয়ে ফলন কমে যায়। তাই মৌচাষে বাধা দিতাম। কৃষি কর্মকর্তরা আমাদের ভুল ধারনার অবসান ঘটিয়েছেন। মৌচাষের কারনে পরাগায়ন বৃদ্ধি পেয়ে এখন ফসলের ফলন অনেক ভালো হচ্ছে।

মৌচাষ বিশেষজ্ঞ সাতক্ষিরার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের দেশের মধু অনেক উৎকৃষ্ট। রাশিয়ার স্ট্রবেরী ফুলের মধু বাংলাদেশী টাকায় প্রতি কেজি ১ হাজার ৪ শত টাকা থেকে ১ হাজার ৭ শত টাকায় বিক্রি হয়। তারচেয়ে ও বাংলাদেশের মধুর পুষ্টিগুন অনেক বেশী। কালোজিরার এক কেজি মধুতে ৩৩ হাজার কিলো ক্যালোরী আছে বলে তিনি জানান। এছাড়াও মধুতে আয়রন, জিংক, পটাসিয়াম, ফসফরাস, হিমোগ্লোবিন ও প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম রয়েছে। ভারতের ডাবুর কোম্পানী যে মধু এখন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করছে, সে মধুই আবার আমাদের দেশে রপ্তানী করে বছরে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাবে। কিন্তু আমারা ন্যায্য দাম পাচ্ছিনা। আমরা মধুর ন্যায্য মূল্য এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দাবী করছি।

ঝিনাইদাহ জেলার হাজী জালাল উদ্দিন, সাতক্ষিরা জেলার শ্যামনগর থানার ইয়াসিন আলী ও গাজীপুর জেলার মৌচাষি কাজী মুনির হোসেন বলে, আমরা ৫/৭ বছর থেকে জাজিরায় এসে ধনিয়া ও কালো জিরার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছি। স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগ আমাদের অনেক সহায়তা করছে। এবছর মশলার আবাদ বেশি হওয়া এবং আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা যাবে। আমরা ভারতীয় দুইটি বিক্ষাত কোম্পানীর কাছে মধু বিক্রি করছি। কিন্তু এখনো আমরা মধুর ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

বাংলাদেশ মৌচাষি কল্যান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মধু রপ্তানী কারক এবাদুল্লাহ মো. আফজাল হোসেন বলেন, গত বছর থেকে বাংলাদেশের উৎপাদিত মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারতে রপ্তানী করা হচ্ছে। এ বছর ভারতের ডাবুর ও প্যানাসিয়া কোম্পানীর কাছে ৫ হাজার মেট্রিক টন মধু রপ্তানী করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহিত মধু রপ্তানী করে আমরা জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করতে পাবো।

জাজিরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মসলা ক্ষেতের পাশে মৌচাষে কোন ক্ষতি হয় না বরং এতে ফসলের ফলন ভালো হয়। এবছর জাজিরায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়া ও কালো জিরার আবাদ হয়েছে। মৌচাষের কারনে পরাগায়নের শতভাগ নিশ্চয়তা থাকায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ফলন হবে। এতে কৃষক ানেক রাববান হবে।

(কেএনআই/এএস/ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test