E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পানি নিয়ে বিপদ আসন্ন!

২০১৫ মার্চ ২১ ১৬:১১:১৪
পানি নিয়ে বিপদ আসন্ন!

নাটোর প্রতিনিধি : জলবায়ুর প্রভাবে নাটোরসহ দেশের বৃহত্তম চলনবিল ও হালতিবিলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। টিউবয়েলে পর্যাপ্ত পানি না উঠায় দেখা দিয়েছে পানীয় জলের সংকট। অপরদিকে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইজগেট নির্মাণ, অবৈধ দখল এবং পলি দ্বারা বিল ভরাট হয়ে পড়ার কারণে এই বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদীসহ ছোট-বড় মিলে ৭৭টি নদী ও খাল পানিশূন্য হয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর গভীর নলকূপ বসিয়ে ও বোরো মৌসুমে অপরিকল্পিতভাবে পানি সেচের আওতায় বোরো ধান চাষ করার ফলেও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারন।

ফলে চলনবিলের গুরুদাসপুর, সিংড়া, আত্রাই, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, ভাংগুড়া ও চাটমোহর উপজেলার শত শত গ্রামের লাখ লাখ মানুষের নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের মানুষের পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্যে জলবায়ুর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে নদী ও খালগুলো প্রশাসনের চোখের সামনে দখল হলেও যেন দেখার কেউ নেই।
‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, চলনবিল ও হালতিবিলাঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২ টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধানত ৯টি নদী ও ১৮টি খালসহ ছোট-খাট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- আত্রাই নদী, গুড় নদী, করতোয়া, বড়াল, তুলশি, চেচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা এবং যুবজীপুর, বারনই, তেলকুপি। ১৮টি প্রধান খালের মধ্যে নবীর হাজার জোলা, হক সাহেবের খাল, নিমাইচরা বেশানী খাল, বেশানী গুমানী খাল, উলিপুর, সাঙ্গুয়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখলি খাল, বেহুলার খাড়া, বাঁকাই খাড়া, গোহালা খাল, গাড়াবাড়ী দারুখালী খাল, বিলসূর্য খাল, কুমার ডাঙ্গা খাল, জানি গাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল। চলনবিলের মধ্যেস্থ কয়েকটি ছোট ছোট বিল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, হালতিবিল, বড়বিল, খলিশা গাড়ী বিল, ধনাইর বিল, ছয় আনি বিল, বাইডার বিল, সাধুগাড়ী বিল, মহিষা হালট এর নাম দেয়া হয়। এছাড়া ছোট ছোট শত শত খাল বিল চলনবিলের অংশ হিসেবে আছে। আর নদীগুলোর গড় প্রসস্থ ছিল ১৫’শ থেকে ২ হাজার ফুট। পদ্মার স্রোতধারা এখন আর বড়াল, চিকনাই, ইছামতি, করতোয়া, পদ্মাবতী, নন্দকুজা, গুমানী ও অত্রাই নদীতে প্রবাহিত হয় না। ফলে অধিকাংশ নদী এখন ভরাট হওয়ায় কোন রকম বেঁচে আছে। সেগুলো হচ্ছে গুড়নদী, গুরনই, বারনই, নগর, বানগংঙ্গা, হুজানদী ও ভাদ্রনদী। এগুলোও এখন মৃতর মত অবস্থা বিরাজ করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব নদ-নদীগুলো দীর্ঘ দিন ধরে ড্রেজিং না করায় নদীগুলোর প্রস্থ ও গভীরতা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে বিলের বিলের নদী গুলোর প্রস্থ ও গভীরতা কমে দাঁড়য়েছে আত্রাই নদীর দৈর্ঘ্য ২’শ ৫০ বর্গমাইল, নাগর নদী ১৫’শ বর্গমাইল, বড়াল ৩২’শ বর্গ মাইল, নন্দকুজা ১৫’শ বর্গমাইল, গুমানী ১৬’শ বর্গমাইল, ভাদাই ৯’শ বর্গমাইল, বানগঙ্গা ৮’শ বর্গমাইল, গুড় নদী ৬’শ বর্গমাইল, কমলা ৭’শ বর্গমাইল, রক্তাই ৪’শ বর্গমাইল, দূর্গাদই ৫বর্গমাইল, চিকনাই ৮ বর্গমাইল, বিলসূর্য ৭’শ বর্গমাইল, তুলসীগঙ্গা ২৬’শ বর্গমাইল। এদিকে নদীর নাব্যতার সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় ১০০ থেকে ১২০ফুট গভীরতায় বৈদ্যুতিক ডিপসেলেন্ডার বসিয়ে এলাকার মানুষ পানির চাহিদা মিটাচ্ছে।
এলাকার প্রবীণ ব্যাক্তিরা জানান, খরস্রোতা নদী গুমানী, আত্রাই, গুড়, করতোয়া, বড়াল, ভদ্রাবতী, চিকনাই, বানগঙ্গা, বারনই, তেলকুপি ও চেচুয়ার অবস্থা শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। নদীর বুকে চর জেগে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব নদীর অধিকাংশ জায়গা অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় মৃত নদীতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া হালতিবিলের জিয়া খাল, পানা উল্লাহখাল সহ অন্তত ৬টি খাল এবং চলনবিলের মধ্যে নিমাইচড়া খাল, ভাসানীর খাল, হক সাহেবের খাল, উলিপুরের খাল, কিশোরখালী খাল, সা্গংুয়া খাল, দোবিলার খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাল, গোহালা খাল, গাঁঢ়াবাড়ী খাল, বিদ্যাধার খাল, দারুখালী খাল, বিলসূর্য, কুমারডাঙ্গা, কিনু সরকারের ধর, জানিগাছার জলা ও কাটেঙ্গার খালের অবস্থা নদীগুলোর মতোই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দখলদারের কারনে কোন কোন খালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। খাল দখল করে চলছে বোরো আবাদ। অধিকাংশ খালে এক ফোটাও পানি মিলছে না। ফলে চলতি বোরো মৌসুমে পানি নিয়ে কৃষকরা বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছে।
হালতিবিলের কৃষক কাউছার রহমান, সাদেক আলী, আফজাল হোসেন জানান, খরা মৌসুমে আগে বিলের মধ্যে খালগুলোয় পানি দেখা যেত। এখন আর চোখে পড়ে না। তাদের দাবী, পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের পাম্প দরকার হয়। এতে কৃষকদের জ্বালানি তেল ও সময় বেশি দরকার হয়। তাই বিলের মধ্যে প্রবাহিত এসব নদী ও খালের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে অবৈধ দখলমুক্ত করে যথাসময়ে সংস্কার করা না হলে আগামী দিনে পানি নিয়ে কৃষকদের বিপদে পড়তে হবে ।
সিংড়ায় মোসলেম উদ্দিন জানান, সিংড়াদহের পূর্ব তীর চিরে একটা খালহাট সিংড়া ও কাটাপুকুরিয়া মৌজা হয়ে বালোয়া-বাসুয়া এলাকায় গিয়ে চলনবিলে মিশেছে। তবে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের অর্ধেকটাই হারিয়ে গেছে। খাল ভরাট করে বাড়ি ও দোকানঘর নির্মাণ করার প্রতিযোগিতায় বাকি অর্ধেকটাও হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় এই খালে পানি ছিল, মাছও ছিল।
সিংড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুল আজিজ জানান, ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত খালের পুরোটা অটুট ছিল। এর বছর পাঁচেক পর খালের মুখে চর পড়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় দখলদারি। তার মতে, খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে চলনবিলের নদ-নদীর অস্তিত্বও।
নাটোর বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে সেচের ৮০ শতাংশ পানি সংগ্রহ করা হয়। বাকি ২০শতাংশ আসে মাটির ওপর থেকে। ভূগর্ভের পুরো পানিই বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে।
নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলায় কর্মরত কৃষি কর্মকর্তা ড. সাইফুল আলম জানান, নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়া, নদী দখল, সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়া প্রভৃতি কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটি থেকে ৩০-৩৫ ফুট গভীরেও পানির দেখা নেই। যে কারণে আরও ৮ থেকে ১০ ফুট গর্ত করে মাটির নিচে নিয়ে যেতে হচ্ছে সেচ পাম্প। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মেলে না।
পানি ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, যখন ভূগর্ভস্থ পানিতে টান পড়ে, তখন নিকটবর্তী নদ-নদীর পানিই নানা সংযোগ দিয়ে ভূগর্ভস্থ মজুদে প্রবাহিত হয়ে সে ঘাটতি পোষাণোর চেষ্টা করে। সেচ কাজে যতটুকু পানি ভূগর্ভস্থ পানি থেকে উত্তোলন করা হয়, তখন তার বেশিরভাগই অপর্যাপ্ত সেচ অবকাঠামোর কারণে বাষ্পীভূত হয়। তাই পরিকল্পিত ভাবে ভুগর্ভের পানি উত্ত্ােলন এবং খাল-বিল, নদী-নালা ও ছোট বড় জলাশয়ে পানি প্রবাহ বজায় রাখতে হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াজেদ আলী জানান, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে, উত্তোলন নিরাপদ ক্ষমতার ভেতরে রাখতে হবে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, সেচদক্ষতা বাড়াতে হবে ও পানির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল আখতার অবৈধ দখল প্রক্রিয়া ও নদ-নদীতে পানি শুণ্যতার কথা স্বীকার করে জানান, এসব সম্পত্তির কাস্টডিয়ান জেলা প্রশাসক। তাই জেলা প্রশাসন অবৈধ দখল উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকে। নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকেও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়ে থাকে। তবে বিষয়টি উর্ধোতন মহলকে পুনরায় অবহিত করা হবে।
এদিকে আজ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে নাটোরের সিংড়ায় এক আলোসভার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “পানি ও টেকসই উন্নয়ন”। স্থানীয় সাথী সংস্থার উদ্যোগে এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে।
(এমআর/পিবি/মার্চ ২১,২০১৫)



পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test