E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে খাল খননে অনিয়মের অভিযোগ

২০১৫ এপ্রিল ২১ ১৬:১৩:১৯
শরীয়তপুরে খাল খননে অনিয়মের অভিযোগ

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরে বিদেশী অনুদানের অর্থায়নে বাস্তবায়িত ২৮ কিলো মিটার দৈর্ঘ্যরে তিনটি খাল খনন করা হচ্ছে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে। স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দিয়ে খাল খননের নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছেনা সিকি ভাগও। এলাকার শত শত শ্রমিককে বেকার রেখে কাজ করানো হচ্ছে স্ক্যাবেটর বা ভ্যাকু মেশিন দিয়ে। নির্ধারিত কমিটিকে  পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র এলজিইডির কর্মকর্তারা নিজেদের মনগড়া নিয়মে খাল খনন করায় ফুঁসে উঠেছে কমিটির লোকজন ।

শরীয়তপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে জেলার ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলায় প্রায় ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে তিনটি খাল খননের কাজ। জাপানী সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান জাইকার অর্থায়নে বৃহত্তর ফরিদপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ খালগুলো খনন করানো হচ্ছে। ৭৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলার দিঘল মহিষ খালি ইউনিয়নের চরচান্দা থেকে চরকুমারিয়া ইউনিয়নের মোল্যার হাট পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিমি, ৭৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ডামুড্যা উপজেলার দারুল আমান ইউনিয়নে সাড়ে ৭ কিমি নান্দ্রা খাল ও ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গোসাইরহাট উপজেলার কুচাইপট্টি ইউনিয়নে সাড়ে ১২ কিলোমিটার খাল খননের কাজ শেষ হবার কথা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে। শরীয়তপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গত তিন বছর আগে এই খাল গুলোকে জাইকা প্রল্পের আওতাভূক্ত করে দীর্ঘ দিন এর উপর সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশ বাসিন্দার মতামতের ভিত্তিতে পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি গঠন করে তাদের মধ্য থেকে হতদরিদ্র শ্রমিকদের দিয়ে খাল খনন করে নির্দিষ্ট এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কৃষি ও মৎস্য উন্নয়নসহ বহুমুখী উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদান করার কথা রয়েছে। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি এক তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিকের কাজ করার নিয়ম রয়েছে। সরেজমিন ঘুরে এই সবের কোন অস্তিত্বই চোখে পরেনি। এলাকায় শত শত শ্রমিক বেকার থাকলেও তাদের দিয়ে খাল না কাটিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তা তার দপ্তরে সকল প্রকারের কাগজ পত্র তৈরী করে শ্রমিকের নাম দেখিয়ে, প্রতি ঘন্টা ১ হাজার ৮ শত টাকা চুক্তিতে মাটি কাটাচ্ছেন ভ্যাকু মেশিন দিয়ে। খাল খননের মুল কাজে স্থানীয় শ্রমিকদের না নিয়ে ভ্যাকু মেশিন দিয়ে মাটি উত্তোলনের পর নামে মাত্র কিছু সংখ্যক স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে মাটি ড্রেসিং এর কাজ করানো হচ্ছে শেষ সময়ে।

পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির লোকেরা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের টাকা লুটপাট করে খাওয়া হচ্ছে। আর এর সাথে জরিত রয়েছে জাইকা প্রকল্পের বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরাও। গত ১৯ এপ্রিল মো. জিয়াউল হুদা ও অমল কুমার নামে জাইকার দুই জন কর্মকর্তা খাল খনন পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারা কুচাইপট্টি খাল পরিদর্শনে যাচ্ছেন এমন তথ্যের ভিত্তিতে শরীয়তপুরের কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী সেখানে অবস্থান করছিল। সংবাদ কর্মীদের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে তারা কুচাইপট্টি খার পরিদর্শনে যায়নি। পরবর্তীতে জানা গেছে, পরিদর্শনের কাজ শেষ না করেই সন্তোষজনকভাবে কাজ চলছে মন্তব্য করে প্রত্যায়ন করে গিয়েছেন।

খালের তলদেশ থেকে ন্যুনতম ৬ ফিট গভীর এবং ১২ ফিট চওড়া করে মাটি উত্তোলনের কথা থাকলেও কোথাও কোথাও মাটি তোলা হচ্ছে মাত্র ১ ফুট গভীর করে। এদিকে খাল খননের পর বৈশাখের প্রথম দিকে মৌসুমী বৃষ্টিতে খননকৃত মাটি গড়িয়ে পরে খাল ভরে যাচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। বিদেশ থেকে সাহায্য আনা সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাস্তায়িত এ প্রকল্প থেকে মানুষের কোন উপকার আসবেনা বলেও ধারণা করছেন এলাকার কৃষক ও সাধারণ মানুষ।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরকুমারিয়া গ্রামের কৃষক সিরাজ মিয়া ঢালী, চরচান্দা গ্রামের আব্দুস সোবহান মোল্যা, ফুলমালা বেগম, ডামুড্যা উপজেলার দারুল আমান গ্রামের দীন ইসলাম বেপারী, রুবেল বেপারী, গোসাইর হাটের কুচাইপট্টি গ্রামের মোজাফ্ফর হাওলাদার, চর মাইজারা গ্রামের সেকান্দার সরদার বলেন, ‘আমাদের এলাকায় যে সকল খাল খনন করা হচ্ছে তা কোন নিয়ম মেনে কাটা হচ্ছে না। আমরা জানতাম, এলাকার বেকার শ্রমিকদের দিয়ে এই খাল কাটা হবে। এখন দেখছি মেশিন দিয়ে কাটছে। মেশিন দিয়ে কেটে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র মাটি ফেলার কারনে এলাকয় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বৈষাখের প্রথম দিকে দুই দিন বৃষ্টি হওয়াতে খননকৃত বেশীরভাগ মাটি খালেই আবার গড়িয়ে পরে গেছে। এই খাল খনন এলাকাবাসীর কোন উপকারে আসবেনা’।

স্থানীয় শ্রমিক বাদ দিয়ে স্কেবেটর দিয়ে মাটি কাটানো বিষয়ে জানতে চাইলে ভেদরগঞ্জের চরচান্দা খাল খনন কমিটির সদস্য মোয়াল্লেম হাওলাদার বলেন, এই এলাকায় মাটি কাটার কোন শ্রমিক না থাকায় এবং দ্রুত কাজ শেষ করার জন্যই স্কেবেটর দিয়ে খাল খনন করছি।

অপর দিকে, ভেদরগঞ্জের চরচান্দা এলাকার মাটি কাটার শ্রমিক রতন মোল্যা, বিল্লাল হোসেন বাঘা, গোসাইরহাটের কুচাইপট্টি ভিমখিল এলাকার শ্রমিক সরদার জান শরীফ ও শাহজালাল সরদার বলেন, ‘ আমাদের এলাকায় শত শত মাটি কাটার শ্রমিক আমরা বেকার বসে আছি। আমরা এক সময় জানতাম এই এলাকার লেবার দিয়েই এই খালগুলির মাটি কাটানো হবে। এখন দেখছি আমাদের বাড়ির কাছে, চোখের সামনেই মানুষ বাদ দিয়ে ভ্যাকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছে। অফিসের লোকেরা সাতক্ষিরা ও জামালপুর থেকেও শ্রমিক ভাড়া করে এনেছিল, তারা কয়েকদিন কাজ করার পর পালিয়ে গেছে। আমাদের দুঃখ একটাই, নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারলাম না’।

তিনটি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোসাইরহাটের কুচাইপট্টি খাল খনন কমিটির সভাপতি আবুল কালাম মুন্সি ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদেরকে নামে মাত্র কমিটির কর্মকর্তা করা হয়েছে। আমাদের কোন পরামর্শ অফিসারেরা শুনেনা, আমাদের কিছু জিজ্ঞেসও করেন না । খাল খননের আগে জানতাম এলাকার শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হবে। আড়াই মাস যাবত কাজ শুরু হয়েছে। শুনেছি প্রকল্প কর্মকর্তা (সিপিও) মফিজুর রহমান খুলনার জনৈক শওকত হোসেনের সাথে মাত্র ৩৮ লক্ষ টাকায় চুক্তি করে ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকার খাল খন করাচ্ছেন ২টি ভ্যাকু মেশিন দিয়ে। খাল কাটার অনিয়ম সম্পর্কে বার বার এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারকে তাগিদ দিলেও তারা তাদের মন গড়া কাজ করে যাচ্ছেন। এই খাল কাটায় মানুষের কোন উপকার হবেনা, উল্টো সরকারের কোটি কোটি টাকা পানিতে যাবে’।

কুচাইপট্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার দরিদ্র মানুষের উপকার ও উন্নয়ন করার জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে সাহায্য আনেন। সেই টাকা সরকারি কর্মকর্তারা এভাবে লুটে পুটে খেলে বিদেশের কাছে একদিকে যেমন দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হবে অপর দিকে ভবিষ্যতে সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। (সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানেরা এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার কারনে তারা কোন মন্তব্য করেননি)।

প্রকল্পের মুল কর্মকর্তা (সিপিও) মফিজুর রহমান স্পস্টই জানিয়ে দিলেন, নারী শ্রমিক কাগজে-কলমে থাকবে কিন্তু বাস্তবে থাকার কোন দরকার নেই। শতভাগ কাজ যে ভাবে আদায় করা সম্ভব সেভাবেই করা হচ্ছে। এরপরেও তিনি জানালেন, সম্পূর্ন শর্ত মাফিক, শতভাগ নিয়ম মেনেই খাল খননের কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

শরীয়তপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মো. মাহবুব হোসাইন বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। যতটুকু জেনেছি কোন কোন কমিটি গঠন নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কারণে একটু বিলম্বে খাল খননের কাজ শুরু হওয়ায় দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য স্কেবেটর ব্যবহার করা হচ্ছে।

বৃহত্তর ফরিদপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, যেখানে স্থানীয় মানুষের কাজ করার সুযোগ রয়েছে সেখানে তারা এই প্রকল্পের কাজ করবে। তিনি আরো বলেন, ন্যুনতম ৬ ফিট গভীর করে ডিজাইন মত খাল খনন করতে হবে। যাতে সব মৌসুমে খালে পানি প্রবাহ থাকে এবং কৃষক সঠিক ভাবে সেচ কাজ পরিচালনা করতে পারে। পাশাপাশি এই খালে মৎস্যজীবিরা মাছ চাষ করে বাঁচতে পারে।

(কেএ্নআই/পিবি/ এপ্রিল ২১,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test