E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে জেলেদের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতি

২০১৫ মে ০১ ১২:০২:৪৩
শরীয়তপুরে জেলেদের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতি

শরীয়তপুর প্রতিনিধি :ইলিশের বেড়ে উঠা মৌসুমে জাটকা আহরণে বিরত রাখা জেলেদের বিশেষ ভিজিএফ  এর মাধ্যমে খাদ্য শস্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার। অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে সরকারের এ খাদ্য শস্য বিতরন কর্মসুচিতে ব্যাপক অনিয়ম, দলীয়করন ও স্বজনপ্রীতির নানান চিত্র।

খয়রাতি সাহায্যের অংশ হিসেবে যে চাল প্রদান করা হচ্ছে তাও খাবার অনুপযোগি। জনপ্রতিনিধিরা প্রকৃত জেলেদের বাদ দিয়ে নিজেদের অ-মৎসজীবি আত্মীয়-স্বজনদের তালিকাভূক্ত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন জেলেরা।

জেলা মৎস বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৪টি উপজেলার তালিকাভূক্ত ১৬ হাজার ২ শত ২৬টি মৎসজীবি পরিবারের মধ্য থেকে ১২ হাজার ১ শত ৯৪ জন জেলে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। নিবন্ধনকৃত জেলেরা ৪ মাস ব্যাপী প্রত্যেকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি হারে মোট প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা পাবে। এতে সরকারের খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এবছর ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ৮ হাজার ৭শত ৪৯ টি জেলে পরিবারের মধ্যে সহায়তা পাচ্ছে ৭ হাজার ৭১ জন, গোসাইরহাটে ৪ হাজার ৪ শত ৩৮টি পরিবারের মধ্যে পাচ্ছে ৩ হাজার ৭০ জন, নড়িয়া উপজেলায় ২ হাজার ১ শত ৩৯ পরিবারের মধ্যে ১ হাজার ৩ শত ৩১ জন এবং জাজিরায় ৯ শত জেলে পরিবারের মধ্য থেকে বিশেষ ভিজিএফ সহায়তা পাচ্ছে ৭ শত ২২ জন জেলে।

শরীয়তপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে পদ্মা ও মেঘনা নদীর অবস্থান। বাংলাদেশে যে কয়টি স্থানে সুস্বাদু ইলিশ উৎপাদন হয়, শরীয়তপুরের জলসীমায় অবস্থিত পদ্মা ও মেঘনা নদী তার মধ্যে অন্যতম। জেলার ভেদরগঞ্জ, গোসাইরহাট, নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলাকে বেষ্টিত করে রেখেছে পদ্মা-মেঘনা। এই প্রমত্তা নদী দ্বয়ের তীর ঘেষে বসবাস করে উল্লেখিত উজেলা গুলোর অন্তত ৩ লক্ষ মানুষ। যাদের একটা বৃহৎ অংশই সারা বছর ধরে নিয়োজিত থাকে মাছ ধরার কাজে। নভেম্বর মাস এলেই নদীতে ইলিশ ধরার উপর বাড়ে সরকারের নজরদারি। বিভিন্ন ধাপে তা চলতে থাকে জুন মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে কখনো “মা” ইলিশ না ধরা আবার কখনো ইলিশের পোনা বা জাটকা শিকার না করা। ফলে বেচারা মৎস্যজীবী দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পরতে হয় মহা সংকটে।

এ সকল আপদাপন্ন জেলেদের কথা ভেবেই সরকার ২০০৯ সাল থেকে শুরু করেছে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জাটকা আহরনে বিরত রাখা জেলেদের বিশেষ ভিজিএফ খাদ্য শস্য সহায়তা কর্মসূচি। কর্মসূচি চলে মার্চ থেকে জুন, এ চার মাস। আগের বছর গুলোতে জেলেদের দেয়া হতো পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল। ২০১৪ সাল থেকে তা উন্নীত করা হয়েছে ৪০ কেজিতে।

গত বছর জেলেদের তালিকা প্রস্তুতে গ্রহন করা হয় বিশেষ পদ্ধতি, যাতে বাদ পরে অসংখ্য প্রকৃত জেলে। তালিকায় নাম উঠে আসে প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধিদের নিকটজন সহ দলীয় লোকজনের। মার্চ মাস থেকে ভিজিএফ এর চাল দেয়ার কথা থাকলেও এবছর মার্চের চাল দরিদ্র মানুষ পেয়েছে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। সরেজমিন ঘুরে কয়েকটি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, ৪০ কেজির স্থলে গরীব মানুষেরা পাচ্ছেন ২৫-৩০ কেজি চাল। চেয়ারম্যান- মেম্বারদের উপস্থিতিতেই এভাবে ১০-১৫ কেজি চাল কম দেয়া হচ্ছে হতদরিদ্রদের। এর পর যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে তার অধিকাংশই মেয়াদ উত্তীর্ণ- খাবার অনুপযোগী, পঁচা চাল।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া, দক্ষিন তারাবুনিয়া, সখিপুর, চরসেন্সাস, কাচিঁকাটা ইউনিয়ন, গোসাইরহাট উপজেলার আলাওলপুর, কুচাইপট্টি ও কোদালপুর ইউনিয়নের জেলে আজিজুল হক, শাহজালাল বেপারী, আব্দুল হক তাঁতি, সোহরাব হোসেন, আলী আহমদ, আবুল বাশার, ইউনুছ আলী, রেহানা বেগম, রতন সরদারসহ অসংখ্য জেলে ও জেলে পরিবারের সদস্যরা বলেন, সরকার আমাদের ৪ মাস ঘরে বসিয়ে রেখে মাছ ধরতে নিষেধ করেছে। বিনিময়ে মাসে আমরা মাত্র ১মন চাউল পাই। সেই চাউল চেয়ারম্যান মেম্বাররা তিন ভাগের একভাগ রেখে দেয়। আমরা গরীব বলে আমাদের পচাঁ চাউল দেয়। মাপে কম দেয়। প্রতিবাদ করলে নানা গঞ্জনা সইতে হয়। তারা আরো বলেন, জেলেদের তালিকা করা সময় অনেক আসল জাউল্যা (জেলে) কে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তাদের আত্মীয় স্বজন ও দলের লোকদের নাম বসিয়েছে।

উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ মোল্যা বলেন, খাদ্য গুদাম থেকে আমাদের মাপে কম দেয়া হয়। প্রতিটি বস্তায় ৪-৫ কেজি চাল কম থাকে। আমাদের চাল পরিবহনের জন্য সরকার কোন খরচ বহন করেনা। এছারাও অনেক আনুসাঙ্গিক খরচ রয়েছে, সে কারনে জেলেদের কিছুটা চাউল কম দেয়া হয়।

আলাওলপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বেপারী বলেন, খাদ্য গুদাম থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ, খাওয়ার অনুপযোগি পঁচা চাল সরবরাহ করা হয়। এই চাল দরিদ্র জেলেদেরকে বিতরণ করতে গিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

গোসাইরহাট উপজেলা মৎস কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ বলেন, জেলেদের তালিকা প্রনয়নের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সে সময়ে কোন অনিয়ম হলেও হতে হতে পারে। এ জন্য মৎস বিভাগ দায়ি না। চাল বিতরনেও কিছু অনিয়ম দেখা যাচ্ছে এবং চালের গুনগত মান ভালো না। আগামী বছর থেকে প্রতি বস্তায় ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আমরা সুপারিশ করবো।

শরীয়তপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী গোলাম কিবরিয়া বলেন, সরকার কখনো খাবার অনুপযোগি চার গুদামে সংগ্রহ করেনা এবং সরবরাহও করেনা। জনপ্রতিনিধিরা গুদাম থেকে চাল নেয়ার ৩-৪ সপ্তাহ পরে তা জেলেদের মধ্যে বিতরণ করে। এ সময়ের মধ্যে চালের গুনগত মান খারাপ হলে তার দায় খাদ্য বিভাগ বহন করবেনা।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস বলেন, জেলেদের খাদ্য সহায়তা নিয়ে দূর্নীতি সম্পর্কে কোন অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধি ও জাটকা সংরক্ষন করতে সরকারের গৃহিত প্রল্পের উপর নজরদারী বৃদ্ধি করে দরিদ্র মানুষের সাথে প্রতারনা বন্ধের পাশাপাশি জেলেদের সচেতন করার উপর জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শরীয়তপুরের বিশিষ্টজনেরা।


(কেএনআই/এসসি/মে০১,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test