E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবনে সার বোঝাই জাহাজ ডুবি : তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন

২০১৫ মে ০৮ ২১:০৬:৪৬
সুন্দরবনে সার বোঝাই জাহাজ ডুবি : তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন

বাগেরহাট প্রতিনিধি:বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের ভোলা নদীতে মঙ্গলবার সারবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় গঠিত বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এসময় তদন্ত কমিটির প্রধান খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ড. সুনীল কুমার কুন্ডুসহ দলের ৭ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। তারা ওখানকার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও কিছু আলামত সংগ্রহ করেছেন। এদিকে, ডুবে যাওয়া রাসায়নিক পটাশ সারবাহী জাবালে নূর জাহাজটি ৪দিনেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

বিআইডব্লিউটিএ শুরু করেনি জাহাজ উদ্ধার অভিযান। ড্রেজার নিয়ে দু’দিন ধরে গলিত সার অপসারণের চেষ্টা সফল হয়নি। এদিকে ওযার্ল্ড হ্যারিটেজ এবনে একের পর এক জাহাজ ডুবির ঘটনায় সুন্দরবন বিভাগ আবারও অভিযুক্ত করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, আমরা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে একের পর এক চিঠি দিয়েও সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে পারেনি। এর ফলে একের পর এক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভোলা নদী-খালে পটাশ সার মিস্্িরত পানিতে একাকার হয়ে মাছ শুন্য হয়ে পড়ায় জেলেদের জালে ৪দিন ধরে মাছ পড়ছেনা। সুন্দরবনের নদী খালের উপর নির্ভরশীল কয়েক শ’জেলে পরিবার পড়েছে বিপাকে।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ড. সুনীল কুমার কুন্ডু বলেন, ডুবে যাওয়া জাহাজটি কিভাবে উদ্ধার করা হবে তা জেলা প্রশাসন নির্ধারণ করবে। তবে, প্রক্রিয়া চলছে। জাহাজের মধ্যে কিছু পরিমান গলিত সার রয়েছে তা পলি পেড়ে আটকে গেছে। পটাশ সার পানিতে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, জাহাজ ডুবির কারণে ওই স্থানে পলি পড়ে উচু হচ্ছে। এটি দ্রুত উদ্ধার না হলে পলিতে ধীরে ধীরে ওই নৌ-চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘটনাস্থলে আসা বিআইডব্লিউটিএ’র ঢাকা অঞ্চলের ডেপুটি ডাইরেক্টর মো. ফজলুর রহমানের বলেন, জাহাজটির মাঝখান থেকে একেবারে তলা পর্যন্ত ফেটে গেছে। জাহাজের বডি খুবই পুরনো। এককথায় বডি ফিটনেস একেবারেই নাজুক। সেকারনেই মাঝখান থেকে তলা পর্যন্ত ফেটে যায়। জাহাজ চলাচলের মূল চ্যানেল থেকে ডুবে যাওয়া জাহাজটির দুরত্ব প্রায় ২ হাজার ফুট। সেখানে ভাটি সময় পানি থাকে মাত্র ৩-৪ ফুট। আর জোয়ারের সময় সেটি তলিয়ে যায় ও প্রচন্ড ¯্রােতের কারনে উদ্ধারকারী জাহাজ তার কাছাকাছি যেতে পারবে না। জাহাজের মালিকের চাচা নূরুল হকের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ডুবুরিদের সাথে তারা যোগাযোগ করে জাহাজটি দ্রুত উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। জাহাজের মালিক আমিনুল ইসলাম বাবুল শুক্রবার বিকেল মুঠোফোনে জানান, শনিবার তারা বসে সিদ্ধান্ত নিবেন কিভাবে জাহাজটি উদ্ধার করা যায়। ইতোমধ্যে ঢাকা, খুলনা ও বরিশালের ডুবুরি দলের সাথে কথ হয়েছে। জাহাজ ডুবিতে তার প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান। শরণখোলার ইউএনও মোহাম্মদ অতুল মন্ডল জানান, ড্রেজার নিয়ে দু’দিন ধরে গলিত সার অপসারণের চেষ্টা সফল হয়নি। এখন আরেকটু উন্ন প্রযুক্তির ড্রেজার খোঁজার চেষ্টা চলছে। জাহাজটি দ্রুত উদ্ধার করা না গেলে ওই নৌ-চ্যানেলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

দায়ী নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় :

একের পর এক জাহাজ ডুবির ঘটনায় সুন্দবনের অস্তিত্ব নিয়ে টান পড়ার জন্য দায়ী নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। এমনই দাবী সুন্দরবন বিভাগের। বারবার তারা চিঠি দিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে সুন্দরবনের ডলফিন অভ্যায় আশ্রমের বুক চিরে এই রুট দিয়ে সব ধরনের জাহাজ চলাচল বন্ধ করার কথা বললেও তারা কানে নেয়নি। পলি পড়ে ঘষিয়াখালী-মংলা আন্তজার্তিক নৌ চ্যানেলটি ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের বুক চিরে সুন্দরবন বিভাগের কোন অনুমতি না নিয়েই এই বিকল্প রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু করে। সুন্দরবন বিভাগের আপত্তি উপেক্ষ্য করে প্রতিদিন এই বিকল্প রুট দিয়ে প্রায় দু’শতাধীক লাইটারেজ জাহাজ ও কার্গে ভ্যাসেল চলাচল করায় এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, একের পর এক চিঠি দিয়েও আমরা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে পারেনি। এর ফলে একের পর এক দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সুন্দরবন।

সংকটে এখন সুন্দরবনের সম্পদ:

সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশ অংশে স্থল ভাগের পরিমান ৪ হাজার ১শ ৪৩ বর্গ কিলোমিটার। আর ৪শ ৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জল ভাগের পরিমান ১ হাজার ৮শ ৭৪ বর্গ কিলোমিটার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুন। মানুষের কারনে সুন্দরবনের আয়তন আজ এখানে এসে ঠেকেছে। সুন্দরবনে রয়েছে ৩শ ৩৪ প্রজাতির গাছপালা, এ উদ্ভিদকুলের ৭৩ ভাগই হচ্ছে সুন্দরী গাছ, ১৬ ভাগ গেওয়া। ১শ ৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিনসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩শ প্রজাতির পাখি। বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, ইলিশসহ ২শ ১০ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সম্পদের হিসাব করা কঠিন। সুন্দরবনে দৃশ্যমান সম্পদের পরিমান ১শ’ ৫৮ কোটি ৯ হাজার ৮শ ৭ পয়েন্ট ৮০ বিলিয়ন টাকা। জীব বৈচিত্র্যের কারনে পর্যাটদের কাছে সুন্দরবন হচ্ছে প্রকৃতির অপর বিশ্বয়। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে ওর্য়াল্ড হ্যারিটেজ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষনা করে। সুন্দরবনের এ সম্পদের সবটাই এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক হিসাব মতে, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জের ভোলা-নন্দপাড়া নদী থেকে শ্যালা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদী পর্যন্ত মাছসহ জলজ প্রানীসহ ডলফিনের অভ্যায় আশ্রম এখন চড়ম অস্তিত্ব সংকটে।

এডিবির সুপারিশ আমলে নেয়নি সরকার :

সরকারের উদ্যোগে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২০০২ সালে এক গবেষনায় সুন্দরবনের তেলসহ অন্যান্য দূষনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দেয়। ওই গবেষনায় সুপারিশ করা হয় সুন্দরবনের সাম্ভব্য তেলসহ অন্যান্য দূষন রোধকল্পে বনকর্মীদের প্রশিক্ষন, তেল দূষন মোকাবেলায় পরিকল্পনা ও প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহন করাসহ সুন্দরবন বিভাগ, মংলা বন্দর, কোষ্টগার্ড, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সম্বনয়ে আপদকালীন সময়ের জন্য আগাম সম্মনিত পরিকল্পনা কাঠামো গোড়ে তোলাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এমনকি ২০০৩ সালে দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলে তেল দূষন মোকাবেলায় পরিকল্পনা সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। এতকিছুর পরও সরকার সুন্দরবনে তেলসহ অন্যান দূষন রোধকল্পে বাস্তব কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। যে কারনে সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল ও ভোলা নদীতে সার বোঝাই জাহাজ র্দূঘটনা রোধ করা যায়নি।

কয়েক শ’ জেলে বেকার :

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোল রেঞ্জ এলাকায় বাগেরহাটের জেলেরা এখন নদী খালে মাছ শিকার করতে না পারায় জীবিকা নির্বাহ করা কয়েক শ’ জেলে পরিবার বেকার সময় পার করছেন। ভোলা নদী-নদীর খালে পটাশ সার মিস্্িরত পানিতে একাকার হয়ে মাছ শুন্য হয়ে পড়ায় জেলেদের জালে ৪দিন ধরে মাছ পড়ছেনা। সুন্দরবনের নদী খালের উপর নির্ভরশীল এসব জেলে পরিবারকে অর্ধাহারে অনাহারে কাটাতে হচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর জেলেদের উদ্বেগ বাড়ছে। তবে বনবিভাগ বলছে এই অবস্থা সাময়িক। আগামী ৪-৫দিনের মধ্যে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে জেলেরা আবার নদী খালে মাছ শিকার করতে পারবে বলে দাবী করেছেন বন বিভাগ। সুন্দরবনের শরণখোল রেঞ্জ সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোল উপজেলার খুড়িয়াখালী, গাবতলা, তাফালবাড়ী, উত্তর ও দক্ষিণ সাউথখালী, চাল রায়েন্ধ, লাকুড়তলা ও রাজৈর এলাকার জেলেদের সঙ্গে কথা হলে কয়েক শ’ জেলেদের বর্তমান অবস্থার কথা জানান তারা। ##

(একে/এসসি/মে০৮,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test