E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রধান আসামী মাওলানা সোলায়মান গ্রেফতার

২০১৫ জুন ১৪ ২৩:৪৪:২০
শরীয়তপুরে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রধান আসামী মাওলানা সোলায়মান গ্রেফতার

শরীয়তপুর প্রতিনিধি :শরীয়তপুরের একমাত্র যুদ্ধাপরাধী মামলার প্রধান আসামী ৭১ এর কুক্ষাত রাজাকার সর্দার মাওলানা সোলায়মান মোল্যা ওরফে সোলায়মান মৌলভীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। রবিবার বিকেলে শরীয়তপুর সদর উপজেলাস্থ কাশিপুর গ্রামে তার নিজ বাড়ি থেকে তাকে আটক করা হয়।

২০১০ সালের ১১ মে শরীয়তপুর জেলা সদরের স্বর্নঘোষ গ্রামের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুস সামাদ তালুকদার রাজাকারর সোলায়মান মৌলভীকে প্রধান করে মোট তিন জনের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ দিন পর রবিবার বিকেলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল থেকে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারের কাছে ফ্যাক্স বার্তার মাধ্যমে সোলায়মান মৌলভীর গ্রেফতারী পরোয়ানা পাঠানো হলে ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সুব্রত কুমার সাহার নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার সোলায়মানকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে।

১৯৭১ সালের ২২ মে সোলায়মান মৌলভীর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক পাক সেনা ও রাজাকার মিলে শরীয়তপুর পৌর এলাকার কাশাভোগ, মধ্যপাড়া, ধানুকা ও রুদ্রকর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ শত ৭০ জন শিশু নারী পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এদিন ধর্ষন করে শতাধিক যুবতীকে। চোখ বেধে মাদারীপুর এ, আর হাওলাদার জুট মিলসে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় ৭০ জন যুবতী নারী সহ দু শতাধিক পুরুষকে। পরে তাদের অধিকাংশের ক্ষত বিক্ষত লাশ আড়িঁয়াল খাঁ নদ ও কীর্তিনাশা নদীতে ভাসতে দেখা যায়।

৭১ এর ২২ মে দুপুরের পর পাক বাহিনী আঙ্গারিয়া বাজার অতিক্রম করে কাশাভোগ তালুকদার বাড়ী ব্রীজ পর্যন্ত পৌঁছলে গরু নিয়ে বাড়ী যাওয়ারত কৃষক সামাদ শিকদার পাক বাহিনীর দল দেখে দৌড় দিলে পাক সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই প্রথম শহীদ হয় সামাদ শিকদার। এর থেকে সামান্য দুরে সম্ভু কর্মকার (কামার) লোহা দিয়ে দা, কাচি বানাচ্ছিল তাকেও সেই অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর ১০০ গজ পূর্বদিকে নাগ বাড়ীতে ঢুকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ উপেন্দ্রনাথ নাগকে গুলি করে হত্যা করে। গুলির শব্দ শুনে স্ত্রী তাবিনী বেলা নাগ (৭৫) চিৎকার করে উঠলে তাকেও ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। পাশের বাড়ীতে পালিয়ে থাকা একই পরিবারের শিবু দাস সাহা ও তার ভাই গৌরাঙ্গ সাহা, শিবু দাসের ৩ ছেলে সহ একজন মহিলাকে নির্মমভাবে ঝোপের মধ্যে পালিয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করে ও পরে ব্যানট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। এসব হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে কাশাভোগ গ্রামে। ঐ সময় রাজাকারেরা পাক সেনাদের বলতে থাকে স্যার আরও সামনে চলুন, সেখানে বেশী বেশী মালাউন থাকে।

পাক সেনারা রাজাকারদের সাথে মধ্যপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে, যেখানে শতভাগ হিন্দু লোকের বসতি ছিল। কাশাভোগের গুলির শব্দ ও মানুষের আহাজারি শুনে এই গ্রামের মানুষেরা দিগ বিদিগ জীবন বাচানোর জন্য পালাতে শুরু করে। রাজারকারদের নেতৃত্বে তখন পাক সেনারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানে পাখির মত গুলি করে মারতে শুরু করে দেয়। এসময় ৮ মাসের শিশু পুত্র কৃষ্ণকে নিয়ে একটি মাটির গর্তের ভিতর পালিয়ে থাকা রাধা রানীকে গুলি করে । রাধারানী গুলি খেয়ে ঘটনাস্থালেই মারা যায়। পরের দিন সকালে দেখা যায় রাধা রানীর ৮ মাসের শিশু পুত্রটি মাতৃ দুগ্ধ পান করা অবস্থায় মায়ের লাশের পাশে শিশুটিও মরে পরে রয়েছে। এর পরে রাধা রানীর স্বামী হরি সাহা (৫০) ও তার মা চিরবালা (৮০) কেও হত্যা করা হয়। পাক সেনাদের একটি দল ঢুকে পরে সাথী বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিক ভজনিতাই সাহার বাড়িতে। ঐ বাড়িতে ঢুকে রমনী সাহা ও তার মেয়ে সোভা রানী সহ সোভা রানীর শ্বশুর বাড়ী থেকে আশ্রয় নিতে আসা ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

ঘাতকদের একটি দল মধ্যপাড়া দাস পারা ঢুকে মন্টু দাসের যুবতী বোন সখী বালা দাসকে তাড়া করলে সখী বালা তার দাদা, বৌদি ও তাদের ৬ মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে ঘাতকরা জানালা দিয়ে গুলি করলে সখী বালার বুকে গুলি বিদ্ধ হয়। দাদা বউদি ও শিশুটিকে বাচানোর জন্য সখী বালা গুলি খেয়েও চিৎকার করেনি। মন্টু দাস তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে পিছনের বেড়া ভেঙ্গে পালিয়ে যেতে পারলেও সথী বালা সেখানেই ঘরের ভিতর নিস্তেজ দেহ নিয়ে পরে থাকে। ঐ সময় রাজাকাররা ঐ ঘরটিতে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে সখী বালাকে সহ ঘরটিকে ভষ্ম করে দেয়। আর এই দৃশ্য দেখে রাজাকাররা বিকৃত উল্ল্যাস আর অট্ট হাসিতে ফেটে পরে। ওই দিন দাস পারার ইন্দ্রজিৎ দাস তার মা কিরন বালা দাস, ইন্দ্রজিৎ এর ৬ মাসের পুত্র অভিমুন্ড দাসকে ঘাতকরা নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে।

রাজাকার ও পাক বাহিনী সেদিন ২২মে গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার, নিপিন্দ্রনাথ পোদ্দার, শিক্ষক সুখদেব সাহা, জয়দেব সাহা, মনি কৃষ্ণ সাহা, লক্ষী চন্দ্র সাহাকেসহ ৬০-৭০ জনকে চোখ বেধে নিয়ে যায়। মধ্যপাড়া পোদ্দার বাড়ি থেকে ১০/১২ জন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে স্থানীয় নিকাড়ী বাড়ীর কাছে একটি টিনের ছাপরা মসজিদের ভেতর নিয়ে তাদের উপর পাষবিক অত্যাচর চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঐ সময় মনোহর বাজার ও রুদ্রকর এলাকায় বরিশাল ও মাদারীপুর জেলা থেকে কয়েকশত হিন্দু নরনারী নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিতে এসেছিল। ঐ সকল আশ্রয় নেয়াদের অধিকাংশ সেদিন ঘাতকদের গুলিতে শহীদ হন। যারা বেচে ছিলেন তাদেরকেও বেছে বেছে মাদারীপুর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আরও জানান মাদারীপুর থেকে আশ্রয় নিতে আসা চিত্ত রঞ্জন ডাক্তার, তার স্ত্রী ও ৩ ছেলে সহ মোট ৯ জনকে একই স্থানে ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে।

সেদিন এই ধ্বংশজজ্ঞ যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরেও রাজাকারদের ভয়ে অনেকে সত্য কথা প্রকাশ করতে সাহস পায় না। তারা জানিয়েছেন, একদিকে পাক বাহিনীর হত্যা ধর্ষন যেমন চলতে থাকে অন্যদিকে রাজাকার মুসলিম লীগের লোকজন কাশিপুর দাদপুর চরচটাং থেকে দলে দলে এসে লুটতরাজ অগ্নি সংযোগ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ মাস ধরে যেখানে সেখানে অগনিত পচা গলা লাশ পড়ে ছিল। শৎকার করার কেউ ছিল না। কুকুর শিয়ালে লাশ খেয়েছে। দূর্গন্ধে অনেক দিন পর্যন্ত কেউ এলাকায় প্রবেশ করতে পারে নাই।

প্রত্যক্ষদর্শী আবুল কালাম জানান, আমার বয়স তখন ১৪/১৫ বছর। ৭১ এর ২২ মে আমি দুপুরে দোকানে বসা ছিলাম। আমাকে দোকান থেকে ধরে নিয়ে পাক সেনারা আমাকে দিয়ে মর্টার সেল বহন করায়। তিনি জানান, পাক সেনারা মধ্যপাড়ার কয়েক জন পুরুষকে ধরে এনে কলেমা পড়ানোর নাম করে রাস্তায় শুইয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে বেধরক পেটাতে থাকে। ওই দিন মতিলাল সাহা নামে একজন নিঃসন্তান বৃদ্ধকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং এক রাজাকার চন্দ্রাই ঠাকুর নামে ৯৮ বছর বয়স্ক এক অচল বৃদ্ধকে কোলে করে এনে মাঠে বসিয়ে পাক সেনাদের দ্বারা গুলি করিয়ে হত্যা করে। অপর এক রাজাকার পাক সেনাদের কে রুদ্রকর বাবুর বাড়ির দিকে নিয়ে যায়। জমিদার প্রমথ চক্রবর্তির বাড়ির ১ শত ৫০ ফিট উচু মঠের উপর উপুর্যপুরি মর্টার সেল দিযে হামলা চালায়। কিন্তু মঠটির কোন ক্ষতি হয়নি। আজো সেটি সদম্ভে দাড়িয়ে আছে।

মামালার বাদী আব্দুস সামাদ তালুকদার বলেন, আমি বিবেকের তাড়নায় ২০১০ সালে মামলা দায়ের করেছিলাম। দীর্ঘ ৫ বছর পরে মূল আসামী গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতার করা দাবি জানাচ্ছি। আমি এই রাজাকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

(কেএনআই/এসসি/জুন১৪,২০১৫)





পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test