E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফসলের মাঠে চলে নৌকা-ট্রলার

২০১৫ জুলাই ১৫ ১৪:৩২:৪২
ফসলের মাঠে চলে নৌকা-ট্রলার

কলাপাড়া থেকে মিলন কর্মকার রাজু : বৃষ্টি হলে ওরা কাঁদে, জোয়ার হলে ভাসে। প্রতিটি ঝড়-জলোচ্ছাসে ভেসে যায় একটু একটু করে তোলা ছোট্ট কুঁড়েঘর ও তাঁদের স্বপ্ন। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। এ কারণে সর্বত্র জনসংখ্যা , মানুষের সহায়-সম্বল ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও কমছে শুধু এ দুর্যোগ কবলিত এলাকায়। এ চিত্র কলাপাড়ার চাড়িপাঁড়া গ্রামের মানুষের।

রাবনাবাদ নদীর ভাঙ্গন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগে সরকারি হিসাবে এ গ্রামের মতো কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের চার হাজার ২২৯ টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে দিগুন পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে এখন ছিন্নমূলের মতো জীবন যাপন করছে। গত সাত বছরে এ ছিন্নমূল পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের পূনর্বাসন কিংবা নদীভাঙ্গন রোধে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ।

এ গ্রামের মতো অন্তত রামনাবাদ, আন্ধারমানিক নদীর করাল গ্রাসে প্রতিটি জোয়ারে ভাসছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া, ধুলাসার, নীলগঞ্জ ও মহীপুর ইউনিয়নের অন্তত ৪০ টি গ্রামের মানুষ। স্রোতের টানে মানুষ ভেসে বেড়ালেও তাদের আর্তনাদ কেউ শুনছে না।

লালুয়ার ৪৭/৫ পোল্ডারের বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা গত পাঁচ বছর ধরে। ডালবুগঞ্জ ক্লোজারের কারনে গত দেড়মাস ধরে জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে প্রায় ২০ টি গ্রামের মানুষ। ভেঙ্গে গেছে মহীপুরের নিজামপুর বেড়িবাঁধ। আগুনমুখা নদীর ঢেউয়ের তোড়ে এখন বিলীন হওয়ার পথে দেবপুর বেড়িবাঁধ। সরেজমিন পরিদর্শনে এ দুর্গত এলাকা ঘুরে শোনা যায় মানুষের কষ্টের আর্তনাদ। দূর্গত এলাকার মানুষ বেঁচে আছে ঠিক যেন দুর্ভিক্ষের ছবির মতো।

চাড়িপাড়া গ্রামের হালিমা বেগম। রাবনাবাদ নদীর ঢেউয়ের তোড়ে তিন ভেঙ্গে ভেসে গেছে তাঁর বসতঘর। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে অন্যের জায়গায়। তিনি বলেন, তিনবার ঘর গাঙ্গে ভাইঙ্গা গ্যাছে। আর কয়বার ঘর তুলুম হইয়া কন। নিজের তো কোন জায়গা নাই। যা আছিলো সব ওই নদীর মধ্যে। এ্যাহন অন্যের জায়গায় ঘর উডাই, আর বর্ষা হইলে ভাঙ্গে। আর কতো মোরা ভাসমু কন।

ছোট পাঁচনং গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুফিয়া। গত একমাসেও স্কুলে যেতে পারেনি। কালভার্টসহ নাওয়াপাড়া বাঁধ ভেঙ্গে পড়ায় এখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। ছোট্র একটি ডিঙি নৌকায় করেই এপার-ওপার যেতে হয় হাজারো মানুষকে। বাঁধের ভাঙ্গা অংশে একটি বাঁশের সাঁকো দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাঁকোটি এতোটাই নড়বড়ে যে প্রতিদিনই ৩০/৪০ জন শিশু-বৃদ্ধ খালে পড়ে আহত হয়। সুফিয়া বলেন,দ্যাহেন বাড়ির ডাই এ্যাহন পানির মধ্যে। রাস্তা ঘাট সব তলাইন্না। স্কুলে যামু ক্যামনে। এই গ্রামের কেউই বইষ্যাকালে স্কুলে যাইতে পারে না।

সৈয়দগাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গাজী আবদুস সোবাহান বলেন, বর্ষাকালে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে না বললেই চলে। এই এলাকাটাই এখন চরের মতো। বৃষ্টি হলেই সব ডুবে যায়। জোয়ারে তলিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, রাস্তা। শিক্ষার্থীরা আসবে কিভাবে।

ডালবুগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আঃ সালাম শিকদার বলেন, ডালবুগঞ্জ ক্লোজারের কারনে গোটা এলাকাই ডুবে আছে। একই অবস্থা নিজামপুর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ডুবে থাকা পাঁচটি গ্রামের। কিন্তু দূর্গত মানুষের সহায়তায় তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না।

নাওয়াপাড়া গ্রামের জনি জমাদ্দার বলে, আমাগো আর নিজ ঘরে থাহা হইবে না। জোয়ার হইলে ঘর ছাড়তে হয়, তাই আগে থেইক্যাই এইহানে ঘর তুলছি। তার মতো অন্তত তিন শতাধিক পরিবার বাঁধের বিভিন্ন স্লোপে আশ্রয় নিয়েছে।

লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, এখন এলাকার যে অবস্থা তাতে ভবিষতে লালুয়া ইউনিয়নটিই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। মানুষ যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তা চোখে দেখা যায় না। আর ওই দুর্গত ১০ টি গ্রামের মানুষের ঈদও হবে না এবার।

লালুয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী আফরোজা ইয়াসমিন বলেন, এখন রাস্তাঘাটের যে সমস্যা তাঁতে গর্ভবর্তী মহিলারা ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে আসতে পারছেন না। বহু শিশু অপুষ্টি জনিত রোগে ভুগছেন। কিন্তু তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না।

কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, তারা দূর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাঠিয়েছেন। আশাকরি বর্ষা মৌসুম শেষে এই ভাঙ্গা বাঁধগুলো মেরামত করতে পারব। কারণ বর্ষায় বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করলে আবার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

(এমকেআর/এএস/জুলাই ১৫, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test