E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জলবায়ু ট্রাস্টের গৃহনির্মাণ প্রকল্প : দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে হাইকোর্টে রিট

২০১৫ আগস্ট ২৮ ২০:৩৯:২৩
জলবায়ু ট্রাস্টের গৃহনির্মাণ প্রকল্প : দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে হাইকোর্টে রিট

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ ও পুনর্বাসন প্রকল্পে তালিকা প্রস্তুত, গৃহ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের কয়েকজন বাদিকে ভয় দেখিয়ে ও টাকা দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার সংক্রান্ত এফিডেফিটে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জেলা পরিষদে ডাকিয়ে এনে ও বাড়িতে বসে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলার চম্পাফুল ইউনিয়নের কুমারখালি গ্রামের শম্ভুচরণ মহালদারের স্ত্রী শোভা রাণী মহালদার জানান, কয়েক বছর আগে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় অন্যের জমিতে দিন মজুর খেটে তাকে সংসার চালাতে হয়। মেঘ ডাকলেই ঘরে জল পড়ে। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে জলবায়ু ট্রাষ্টের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে কয়েকজন বিত্তশালি চার লাখ টাকা মূল্যের ঘর পেয়েছেন। ঘুষ দিতে পারেননি বলে তিনি ঘর পাননি। বাধ্য হয়ে স্থানীয় কয়েকজন হত দরিদ্র পরামর্শ করে বাদি হয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। এতে বেজার হয়েছেন জেলা পরিষদের কর্মকর্তা, ঠিকাদার, ঠিকাদার সহযোগি ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মোজাম্মেল হক।

তিনি আরো জানান, গত ২৫ মে শুক্রবার বিকেলে তিনি উজিরপুর হাটে যান। এ সময় আশাশুনি উপজেলার কদমদহ গ্রামের মহানন্দ সরকার, চম্পাফুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন তাকে তিন রাস্তার মোড়ে ডেকে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে বলে জানান। রাজি না হওয়ায় তাকে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতেও রাজি না হওয়ায় একজন মুসলিম দিয়ে ধর্ষণ করানোর হুমকি দেওয়া হয়। এরপরও রাজি না হওয়ায় বড় মেয়ে লিপিকা ও জামাতা প্রবীর সরকারকে হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে উপায়ন্তর না দেখে রাজি হন। ২ জুলাই সকাল ৯টার দিকে একটি ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেলে করে মোজাম্মেল হক তাকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে নিয়ে যান। সেখানে মাহাবুব নামের এক কর্মকর্তা এক ব্যক্তিকে দিয়ে তার ছবি উঠিয়ে নেন। পরে তাকে কয়েকটি লিখিত নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে মটর সাইকেল ভাড়া বাবদ এক হাজার টাকা ও ১০ হাজার নগদ টাকা দিয়ে বাড়ি যেতে বলা হয়। জেলা পরিষদ কর্মকর্তারা তার স্বাক্ষর ও ছবি সম্বলিত একটি এফিডেফিট তৈরি করেছেন মর্মে তিনি জেনেছেন।

একইভাবে মহানন্দ সরকার, শাহীন হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হক গত ১৭ মে দুপুরে বাড়িতে এসে হুমকি দিলে ১৯ মে ইউপি চেয়ারমান আব্দুল লতিফকে সঙ্গে নিয়ে জেলা পরিষদে যেয়ে কর্মকর্তা মাহাবুবর রহমানের অফিসে যান কুমারখালি গ্রামের মৃত আশুতোষ মণ্ডলের ছেলে বিষ্ণুপদ মণ্ডল। পরে তার ছবি তোলার পর কয়েকটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কয়েকটি সাদা কাগজে তার কাছ থেকে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হকের মাধ্যমে এক হাজার টাকা মটর সাইকেল ভাড়া ও ঘর সংস্কার করতে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। ওই ছবি ও স্ট্যাম্প এফিডেফিড হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

একইভাবে একই ব্যক্তিগণ ১৩ জুলাই সকালে হুমকি দিয়ে পরদিন দুপুরে জেলা পরিষদে ডেকে এনে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কয়েকটি সাদা কাগজে সাক্ষর করতে বাধ্য করানো হয় বলে অভিযোগ করেন একই গ্রামের শশধর মিস্ত্রীর ছেলে কৃষ্ণপদ মিস্ত্রী। তিনিও একই পরিমাণ টাকা পেয়েছেন।

তবে মৃত হারান মণ্ডলের ছেলে বাবুরাম মণ্ডল জানান, জেলা পরিষদে যেয়ে স্ট্যাম্প ও কাগজে সই করে আসতে অপারগতা প্রকাশ করায় গত পহেলা ও ৩ জুলাই উজিরপুর বাজারে আশাশুনির কদমদহ গ্রামের ঠিকাদার সহযোগি মহানন্দ সরকার, শাহীন ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হক তার দু’ ছেলেকে হুমকি দেন। তাতেও লাভ না হওয়ায় ছেলেদের চাপে পড়ে গত ৮ জুলাই বাড়িতে বসে ছবি তুলে নেওয়ার পর কয়েকটি স্ট্যাম্প ও সাদা কাগজে স্বাক্ষর করেন তিনি। বিনিময়ে তাকে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

একইভাবে মহানন্দ সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন বাড়িতে এসে সাতজন সই করেছে , তুমি কেন করবে না, ভাল চাইলে সই করে দাও ধরণের কথা বলতে বলেতে ১৫ জুন দুপুরে জোর করে ছবি উঠিয়ে নেন কুমারখালি গ্রামের মৃত ভদ্রকান্ত মহালদারের ছেলে বিশ্বনাথ মহালদারের। পরে কয়েকটি কাগজপত্রে টিপ সহি করিয়ে নেন। পরে তাকে জেলা পরিষদের গৃহ সংস্কার প্রকল্পের আওতা থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হলো বলে জানানো হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আশাশুনি উপজেলার কদমদহ গ্রামের মতিলাল সরকারের ছেলে আওয়ামী লীগ কর্মী শুক্রবার বিকেলে মহানন্দ সরকার সাংবাদিকদের জানান, তিনি দলীয় সক্রিয় কর্মী হিসেবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হকের সহযোগির ভূমিকা পালন করে থাকেন। টাকা দিয়ে বা হুমকি দিয়ে নয়, নিজেদের এলাকার স্বার্থে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য কয়েকজন বাদিকে অনুরোধ করেছিলেন মাত্র। সে অনুযায়ি তারা মামলা তোলার আবেদন করেছে।

চম্পাফুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, হুমকি-ধামকি বা টাকা দিয়ে কারো কাছ থেকে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করানোর অভিযোগ ঠিক নয়। ঘর দেওয়ার না করে অাইনজীবী তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে মামলা করেছেন জানতে পেরে তারা স্বেচ্ছায় মামলা প্রত্যাহারের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।

জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহাবুবর রহমান শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানান, জেলা পরিষদের মধ্যে টাকা দিয়ে কারো কাছ থেকে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া বা ছবি তোলার ঘটনা ঠিক নয়। বাদিপক্ষরা স্বেচ্ছায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ ইউনিট স্থানীয় সরকার বিভাগের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সচিব দুস্থ, গরীব, আর্থিক অসচ্ছল ও ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীন পরিবার সমূহের জন্য সরকারি খরচে ৪০০টি গৃহ নির্মাণের ঘোষণা দেন। তালিকা তৈরি ও গৃহনির্মাণে প্রথম থেকেই অনিয়ম ও দূর্ণতির অভিযোগে আশাশুনি উপজেলার তৎকালিন মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার সরদার হাফিজুর রহমান ওই বছরের ১৪ আগষ্ট হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। রিট পিটিশনটি খারিজ হলেও দু’ সাংসদ ও জেলা প্রশাসককে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠণের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একপর্যায়ে গত বছরের ৯ আগষ্ট সাংসদ স.ম জগলুল হায়দার ও সাংসদ অ্যাড. মুস্তাফা লুৎফুল সাহেবের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ৪৫টি ঘর তৈরি ও বণ্টনে অনিয়মের অভিযোগ সম্বলিত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। এ নিয়ে আদালতে আরো একটি রিট পিটিশন বিচারাধীন রয়েছে।

গত ৬ মে কুমারখালি গ্রামের অসহায় ভূমিহীন বিশ্বনাথ সরকার, বিষ্ণুপদ মণ্ডল, অঙ্কুর বালা মণ্ডল, বাবুরাম মণ্ডল, কৃষ্ণপদ মিস্ত্রী, শোভা মহালদার, তপন মণ্ডল, ধীরেন্দ্রনাথ ইসু ও তাপস মণ্ডল রিট পিটিশনে বাদি শ্রেণিভুক্ত হন। এতে জেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্টরা প্রথম দু’ রিট পিটিশনের তিনজন বাদির কাছ থেকে মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত এফিডেফিড করিয়ে নিয়ে আদালতের সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হন বলে দাবি করেন বাদিপক্ষের আইনজীবীরা। গত ৭ মে বিকেলে হামলা করা হয় রিট পিটিশনকারিদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. সত্য রঞ্জন মণ্ডলের কুমারখালির বাড়িতে। এরপর ওই মহলটি ৬ মে রিট পিটিশনের নতুন নয়জন বাদিকে দিয়ে হুমকি ধামকি ছাড়াও আর্থিক প্রলোভন দেখিয়েূ মামলা প্রত্যাহারের চেষ্টা অব্যহত রাখেন। এমনকি কোন প্রকার আলাপ না করে দু’জন সাংসদের না বলা কথা বিবৃতি হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

(আরকে/পি/অাগস্ট ২৮, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test