E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পানির স্তর নামছেই, সংকটে রাজধানীবাসী

২০১৪ মে ২৪ ১৫:১৬:৫৪
পানির স্তর নামছেই, সংকটে রাজধানীবাসী

স্টাফ রিপোর্টার : শুক্রবার ছুটির দিন একটু বেলা করে ঘুমানোর প্রবণতা আছে রাজধানীবাসীর। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের সে সুযোগ নেই। আসলে ছুটির দিন বলতে কিছু নেই এখন। নেই অফিস সময়, নেই দিন-রাত।

বছরের পর বছর ধরে পানি তোলায় নেমে যাচ্ছে ঢাকার পানির স্তর। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় চারশ ফুট নিচ থেকেও পানি উঠছে না কোনো কোনো এলাকায়। আবার পানি পাওয়া গেলেও পরিমাণে কম। গভীর নলকূপে চাপ পড়ায় কোনো কোনোটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। আর তাই সরবরাহ লাইনে পানির সংকট দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন।

দশ বছর আগে পুরান ঢাকায় গ্রীষ্মে পানির সংকট থাকলেও এখন ঢাকার প্রায় সব এলাকায়ই আছে এই সমস্যা। লাইনে চাপ কম থাকায় বিশেষ করে লাইনের শেষের দিকের বাসাগুলো পানি পায় না এতটুকু। গত দুই মাস ধরে ওয়াসার কাছ থেকে গাড়িভর্তি পানি কিনে চাহিদা মেটাচ্ছে কোনো কোনো বাড়িওয়ালা।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের এক নম্বর সড়কের স্বর্ণকুঞ্জ হাউজিংয়ে পানির সমস্যা চলছে গত দুই মাস ধরে। লাইনে পানি আসে না, কোনো কোনো দিন এলেও তা পরিমাণে খুবই কম। বাকি দিন পানির গাড়ি কিনে আনতে হয়। এই গরমে গোসল, কাপড় কাঁচা, রান্না কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। ত্যক্ত-বিরক্ত স্বর্ণকুঞ্জবাসী জানে না এর প্রতিকার কী।

আবার ওয়াসার কাছে পানি কিনতে চাইলেও তা পাওয়া এত সহজ না। সকালে সিরিয়ালে নাম লিখিয়ে এলে কোনো দিন পানি পাওয়া যায় বিকাল বা রাতে, কোনো কোনো দিন পাওয়াই যায় না।

রাজধানীর উত্তরায় ওয়াসার মডস জোন-৯ এর উপসহকারী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা জানান, গরম পড়ার পর থেকেই গাড়িতে বিভিন্ন বাড়িতে পানি সরবরাহ করছেন তারা। মানুষ যে পরিমাণে পানি চায় তা সরবরাহের ক্ষমতা তাদের নেই।

এই কর্মকর্তা জানান, ২৩ মে শুক্রবার সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তাদের কাছে চাহিদা এসেছে ১৭ গাড়ি পানি। কিন্তু তারা দিতে পেরেছেন ছয় গাড়ি পানি। তিনি জানান, গাড়ি ঠিক থাকলে তারা দিনে দিতে পারেন ৩০ গাড়ি পানি। কিন্তু কোনো কোনো দিন চাহিদা থাকে ৫০ গাড়ি পানির।

গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গ্রাহকরা এত কিছু জানে না। তারা আমাদের গালিগালাজ করে। কিন্তু আমাদের কর্মীরা বসে থাকে না।’

রাজধানীর অভিজাত থেকে শুরু করে প্রায় সব এলাকায়ই আছে এই সমস্যা। কিন্তু ওয়াসা কর্মকর্তাদের দাবি রীতিমতো বিস্ময়কর। তারা বলছে, কোথাও কোথাও এক-দুইদিনের জন্য সংকট থাকলেও তা ধরার মতো নয়।

ঢাকায় পানি সরবরাহে সরকারি সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গরম এসেছে। কিছু কিছু এলাকায় সমস্যা দেখা দেবে। এটা বড় কিছু নয়। যে এলাকায় সংকট সে এলাকায় আমরা গাড়িতে করে পানি দেই। যে পরিমাণ গাড়িতে করে দেওয়া হচ্ছে তা অস্বাভাবিক নয় মোটেও।’

ঢাকার প্রায় সব এলাকায়ই পানির সংকটের অভিযোগ থাকলেও এই ওয়াসা কর্মকর্তার দাবি, তাদের তথ্যমতে পানির সমস্যা হচ্ছে দুটি এলাকায়। এর একটি মোহাম্মদপুরের মনসুরাবাদ এবং অপরটি গেন্ডারিয়ার ফরিদাবাদ। দুটি এলাকায় গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো মেরামত চলছে। এই কাজে সময় লাগবে আরও প্রায় তিন সপ্তাহ।

নারায়ণগঞ্জ এবং রাজধানীর ১১টি অঞ্চলে ভাগ করে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। ঢাকা মহানগরীতে দিনে ২২৫ কোটি লিটার পানির চাহিদা আছে বলে জানিয়েছে ওয়াসা।

ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গরমে চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বাড়লেও আমাদের পানির সংকট নেই। রাজধানীর পানির ৭৮ ভাগই টিউবওয়েলে উত্তোলন করা হয়। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। তাই টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন করা যাচ্ছে কম। বৃষ্টি হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

ওয়াসার দাবি আর বাস্তবতা ভিন্ন

ওয়াসার দাবি পানি সরবরাহ ঠিক আছে। কিন্তু ফার্মগেট, আদাবর, মিরপুর-২, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পানি সংকটে বাসিন্দাদের নাকাল হতে দেখা গেছে।

তারা টাকা দিয়েও ওয়াসার এক গাড়ি পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা ঢাকা ওয়াসার কাছে একাধিকবার অভিযোগ করার পরও সংকট নিরসনে উদ্যোগী হচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

গরম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, দক্ষিণ মনিপুর, কাফরুল, কল্যাণপুরেও পানির সমস্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দা। কোথাও পানি নেই, কোথাও পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। মিরপুর ২ নম্বর সেকশন সংলগ্ন কাজীপাড়ায় ৩ মাস ধরে পানি সংকট চলছে। মিরপুর ১৪ নম্বর এলাকা সংলগ্ন বৌবাজার এলাকায় পানির কল খুললে ময়লার সঙ্গে কেঁচোও আসছে। মাঝেমধ্যে পানি আসছে না।

ইস্কাটন গার্ডেন, গোপীবাগ, পেয়াদাপাড়া, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির এক নম্বর সড়ক, নবোদয় হাউজিং, উত্তরা ও গুলশানের কিছু অংশে পানির সমস্যার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পেয়াদাপাড়া, ওয়ারী ও বনগ্রাম এলাকায় ওয়াসার পানিতে ঝাঁঝালো গ্যাসের দুর্গন্ধ আসছে। এই পানি দিয়ে হাত, মুখ ও গোসল করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। গা থেকে দুর্গন্ধ আসে।

নেমে গেছে পানির স্তর

রাজধানী এবং নারায়ণগঞ্জে পানি তোলার জন্য গভীর নলকূপ আছে ৬৭০টি। বছরের পর বছর ধরে এসব নলকূপ দিয়ে পানি তোলা হলেও মাটির নিচের পানির স্তর পূরণ হয় খুবই কম। কারণ নগরীতে জলাশয় কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। আর নিচু এলাকা ভরাট করে তোলা হয়েছে আবাসন। কংক্রিটের কারণে পানি চুইয়ে নিচে যেতে পারে না।

বিএডিসির সব শেষ গবেষণা বলছে, ঢাকায় পানির স্তর এখন গড়ে ২১০ ফুট নিচে। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০ ফুট নিচে। প্রতি বছর এই স্তর নামছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়তে পারে। তাই সংস্থাটি সরকারকে ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।

এই গবেষণাটি বেশ কয়েক বছর আগের করা। এখন পানির স্তর নেমেছে অনেক বেশি। কোথাও কোথাও ওয়াসার গভীর নলকূপে আগের মতো পানি উঠে না।

জানতে চাইলে পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে ভূগর্ভস্থ পানির বদলে মাটির ওপরের পানি ব্যবহারের কথা বলে আসছি। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা পরিকল্পনা ঠিকই নেয়, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয় না।’

পরিকল্পনা আছে, বাস্তবায়ন নেই

ওয়াসা বলছে নগরীর পানি সংকটের সমাধান কেবল একটি-দুটি বছরের পরিকল্পনা নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি ও স্থানীয় সমাধানের জন্য কাজ চলছে। পদ্মা নদী থেকে পানি এনে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার জশলদিয়া পানি শোধনাগার স্থাপন করা হচ্ছে। ২০০২ সালে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও অর্থসংস্থান করতে না পারায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। ২০১৬ সালের জুনে এ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

এর বাইরে মেঘনা থেকে ১০০ কোটি লিটার পানি আনার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মেঘনার এই পানি আসবে সায়দাবাদ পানি শোধনাগার দিয়ে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

দূরের নদীগুলো থেকে পানি আনলেও ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালু নদীর পানি আরও বেশি করে ব্যবহারের আপাতত কোনো পরিকল্পনা ওয়াসা করতে পারছে না। কারণ অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যরে কারণে এই চারটি নদী এত দূষিত হয়ে পড়েছে যে, এর পানি পরিশোধন করলে খরচ পোষায় না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এই নদীগুলো যেকোনো উপায়ে রক্ষায় সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগেও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে একই ধরনের নির্দেশনা এলেও এবার সরকার বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি আন্তরিক বলে নিশ্চিত করেছে সরকারের সূত্রগুলো।

(ওএস/এটিআর/মে ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test