E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কার্কশিড কাগজের এক জাদুকর রুবেল মাহমুদ

২০১৬ মে ৩০ ২০:৩৩:৩৭
কার্কশিড কাগজের এক জাদুকর রুবেল মাহমুদ

রাজীবুল হাসান,শ্রীপুর(গাজীপুর) প্রতিনিধি:টগবগে চির উদ্যোমী এক যুবকের নাম রুবেল মাহমুদ। সারাক্ষণ মেতে থাকেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। নতুন কিছু সৃষ্টির নেশায় কখন যে রাত কেটে যায় কিংবা দুপুর গড়িয়ে বিকেল-সন্ধ্যা নামে তা টেরও পান না।

নির্ঘুম থেকে থেকে তাঁর দু ’ চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। এভাবে সাধনা করতে করতে রুবেল এখন দক্ষ এক কারিগর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন এলাকায়। মুহূর্তের মধ্যে তিনি তৈরি করতে পারেন স্ট্যার্চু অব লিবারিটি ,তাজমহল, স্মৃতিসৌধ কিংবা যে কোন মহা মানবের অবিকল প্রতিকৃতি। আর এ সব তৈরি করতে তিনি ব্যবহার করেন শুধুমাত্র কার্কশিড কাগজ।

ব্যতিক্রমধর্মী এই ভাস্কর শুধু নিজের ভালো লাগা থেকে একের পর এক কার্ক শিড দিয়ে নির্মাণ করে চলছেন তার প্রিয় স্থাপনা কিংবা প্রিয় মনীষীর প্রতিকৃতি। এর জন্য তার নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনার বারতোপা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন খানের ছেলে রুবেল মাহমুদ খুব ছোট বেলা থেকেই নতুন কিছু সৃষ্টি করার নেশায় বিভোর থাকতেন।তখন থেকেই তিনি নানা রকম জিনিস তৈরি করতে থাকেন।প্রশংসা কুড়াতে থাকেন শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধবের। সহপাঠীরা যখন বিভিন্ন রকম স্কুল ব্যাগে করে বই নিয়ে স্কুলে যেতো,তখন রুবেল বাঁশ দিয়ে বিশেষ ধরণের এক বাহন তৈরি করে সেটার মধ্যে বই নিয়ে স্কুলে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের মতো হতে স্কুল ফাঁকি দিতেন না, প্রায় সময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে তৈরি করতেন বিশেষ আকর্ষণীয় এক ধরণের ধনুক। আর সেই ধনুক দিয়ে পাখি শিকার করে করে তার শৈশব কেটেছে। বাঁশ দিয়ে ঘোড়ার চাকা তৈরি কিংবা বোতলের সাহায্যে বোমা বানানো ছিল তার প্রবল নেশা। বিভিন্ন কিছু সৃষ্টির নেশায় তার পড়াশোনাও বেশি দূর এগোয়নি।

বারতোপা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও গাজীপুর ক্যান্টনন্টে বোর্ড কেেলজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর ২০০৬ সালে চাকরির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান সিঙ্গাপুর। কিন্তু যার রক্ত কণার ভেতর সৃষ্টির উন্মাদনা গর্জন করে তিনি অন্তত সব কিছু করতে পারলেও ধরাবাধা নিয়মের মধ্যে কোন চাকরিতে স্থায়ী হতে পারেন না। তিন বছর চাকরি করার পর ফিরে আসেন দেশে। প্রতিষ্ঠা করেন মৈত্রী ক্ষুদ্র সমবায় সমিতি নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

একবার রুবেল তার এক প্রকৌশলী বন্ধুকে তার একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে উপহার দেন । কিন্তু প্রকৌশলী সেই বন্ধু রুবেলের সামনেই সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নানা রকম বিদ্রুপ করতে থাকেন । বন্ধুর এই আচরণ তাকে প্রবলভাবে আহত করে। নতুন উদ্যোমে শুরু করেন তার সৃষ্টির খেলা। আর এর জন্য বেছে নেন কর্কশিড কাগজ। এই কাগজ যেন রুবেলের কথা শুনে। তিনি কর্কশিড দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তৈরি করে ফেলেন মহাত্মাগান্ধী, রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল ,লালন ফকির, হাসন রাজা,কবি শামসুর রাহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহা কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , জিয়াউর রহমানের অবিকল প্রতিকৃতি।

ধূতি পরিহিত , গায়ে চাদর, ডান হাতে একটা থলে আর বাম হাতে বাঁশের লাঠির সমন্বয়ে মহাত্মাগান্ধীর প্রতিকৃতিটি স্থানীয় সকলকে মুগ্ধ করেছে বলে জানান তারই সহপাঠী লুৎফর সিকদার। তার হাতে তৈরিকৃত জাগ্রত চৌরঙ্গীটিও অসাধরণ হয়েছে। শুধু তাই নয় ঐতিহাসিক স্থাপনা তৈরিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। যেমন তিনি তৈরি করেছেন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, তাজমহল, স্ট্যার্চু অব লিবারিটি কিংবা সপ্তম আশ্চর্যের সব গুলো। বানিয়েছেন জাতীয় জাদুঘর,জাতীয় সংসদ ভবন , বাঁশের কেল্লা, ষাট গম্বুজ মসজিদ। তিনি বিভিন্ন আকৃতিতে তৈরি করেছেন আগ্রার তাজমহল। এক টুকরো কাঠের মধ্যে শুধু দেশলাইয়ের কাঠি ব্যবহার করে একটি তাজমহল বানিয়েছেন। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট তাজমহল বলে তার দাবি। যে কোন পানীয়’র বোতলের মুখোর মধ্যে সেটা রাখা যায়। খালি চোখে তাজমহলটি ভালোভাবে দেখা না গেলেও আতশী কাঁচ দিয়ে তাজমহলটি অসম্ভব রকম ভালো দেখায়। মুগ্ধ করে যে কোন মানুষকে। ইতিমধ্যে রুবেলের কিছু ভাস্কর্য উচ্চ মূল্যে কিনে নিয়েছেন তার ভক্তরা। আবার পছন্দের মানুষকে দু ’ একটি উপহারও দিয়েছেন। রুবেল মাহমুদ প্রায় সময়ই কী এক ধ্যানের মধ্যে মশগুল থাকেন। যখন কিছু তৈরি করতে ভালো না লাগে তখন সৃষ্টি করেন অসাধারণ নানা পঙক্তি। এবারের মেলায় তার ‘ রক্তক্ষরণ’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। বইটিতে রয়েছে আশিটি কবিতা। এদেশের মাটি,জল, নদী, প্রকৃতিই তার কবিতার উপজিব্য বিষয়। তিরিশ বছরের বুবেল মাহমুদের শিক্ষক বিশিষ্ট ছড়াকার জয়নুল আবেদীন স্বপন বলেন‘ অসম্ভব রকম মেধাবী রুবেল মাহমুদ খুব ভালো ছাত্র না হলেও তার মধ্যে সৃষ্টির উন্মাদনা কাজ করেছে সব সময়। সারাক্ষণই সে কিছু না কিছু সৃষ্টির নেশায় ডুবে থাকে। মানুষ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার সৃষ্টি সব সময়ই চিরস্থায়ী বলে মনে করেন রুবেল মাহমুদ । এই সৃষ্টিকর্ম দিয়ে রুবেল চিরস্থায়ী হতে চান। তিনি বলেন, সময়ৈর স্রোতে হয়তো আমি হারিয়ে যাবো, কিন্তু একটি শিল্পকর্মও যদি টিকে থাকে কিংবা মনে রাখে মানুষ তবেই আমার জন্ম সার্থক হবে। কার্কশিড দিয়ে তৈরি করা সমস্ত ভাস্কর্য দিয়ে ছোট করে হলেও একটা জাদুঘর তৈরির ইচ্ছে তাকে তাড়িত করছে বলে জানান তিনি। এই সকল সৃষ্টিকর্ম নিয়ে খুব শীঘ্রই একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হব বলেও ইচ্ছে পোষণ করেছেন কার্কশিডের এই জাদুকর।





(আরএইচ/এস/মে ৩০,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test