E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কাপাসিয়ায় মানসিক প্রতিবন্ধীকে ডাকাত বলে চোখ উপড়ে হত্যা করে গ্রামবাসী

২০১৬ জুন ১৯ ২১:১৫:১৩
কাপাসিয়ায় মানসিক প্রতিবন্ধীকে ডাকাত বলে চোখ উপড়ে হত্যা করে গ্রামবাসী

কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি :গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামে গত ১১ জুন রাতে বিকৃত মস্তিষ্ক এক ব্যক্তিকে নয়ানগর এলাকার মিনহাজের বাড়ীতে ডাকাতির অভিযোগে জাহিদুল ইসলাম সজিব (১৮) নামে ডাকাতকে আটক করে  গ্রামবাসীরা চোখ উপড়ে ফেলে লাঠি ও বল্লাম দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তি  ঘাগটিয়া ইউনিয়নের খিরাটি উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত জাকির হোসেন মুকুলের একমাত্র ছেলে। খবর পেয়ে টহল পুলিশ সেখানে পৌঁছে ছেলেটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।  জাহিদুল ইসলাম সজিব  খিরাটি বঙ্গতাজ ডিগ্রি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।

খবর পেয়ে নিহত ওই হতভাগ্য ছেলেটির স্বজনরা থানায় গেলে পুলিশ সজিবকে অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত বলে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মরদেহ পাঠান। থানা পুলিশ পরে মর্গ থেকে শনাক্ত করে স্বজনরা মরদেহ বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে দাফন করেন।
স্বজনরা জানায়, নিহতের বাবা জাকির হোসেন মুকুল খিরাটি বঙ্গতাজ ডিগ্রি কলেজের অফিস সহকারী ছিলেন।
সজিবের দাদি শুক্করি বেগম জানান, গত প্রায় তিন মাস আগে হঠাৎ সজিবের আচরণে অসংলগ্নতা ধরা পড়ে। যেকাউকে ভয় পেত সে। প্রায়ই বাড়ির পাশে তার বাবার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকত। গুমরে কাঁদত। বেশির ভাগ সময় একা একা কথা বলত সে। এরপর ঘর থেকেই বের হত না সজিব।

সজিবের চাচা দুবাসীপ্রবাসী আনোয়ার হোসেন জানান, একমাত্র ভাতিজার এমন অবস্থা দেখে তিনি আর বিদেশে যাননি। অনেক চেষ্টা করেও তাঁরা সজিবকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে অনেক কবিরাজ ডেকে এনে বাড়িতে রেখেই সজিবের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু সুফল না পাওয়ায় তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সজিবকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার।

সজিবের মা রেবেকা সুলতানা রেবা জানান, প্রায় দুমাস আগে ওই ঘর থেকে সজিব একবার বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর পাশের আড়ালবাজার থেকে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে সজিব নিজেই ঘরের বিতর থেকে তালা বদ্ধকরে রাখত। খাবার সময় হলেই সে নিজেই খুলে দিত তালা। সজিব কারো সঙ্গে কথাও বলত না। তার থাকার ঘরে কেউ যেতে চাইলে খেপে যেত সে। অনেক খিদে পেলে খাবার চেয়ে খেত। তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে চাইলেও সজিব রাজি হত না।


গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আবদুস সালাম সরকার বলেন, ‘শনাক্ত হওয়ার পর মরদেহ নিহতের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’

যা ঘটেছিল ওইদিন : পাশের বারিষাব ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামের একটি বীমা কম্পানির কর্মকর্তা মিনহাজ উদ্দিন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে নয়ানগর জামে মসজিদে তিনি তারাবি নামাজ পড়তে যান। ওই সময় বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মাজেদা খাতুন, ছেলে শরীফ হোসেন, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হনুফা বেগম ও তাঁর ভাতিজা ইসমাইল হোসেন নাতনি সাবিনা ইয়াসমীন।

মিনহাজ উদ্দিন বলেন, মসজিদে থেকে বাড়িতে ডাকাত হানা দেওয়া খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি প্রায় ১০০ থেকে ১৫০জন গ্রামবাসী এক ডাকাতকে ধরে গণপিটুনি দিচ্ছেন।

ইসমাইল হোসেন জানান, ঘরের ভেতর থেকে তাঁর ভাগ্নি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমীন প্রথমে ডাক চিৎকার দেয়। ছুটে বাইরে বেরিয়ে উঠানে এক ডাকাতকে দেখে তিনি তখন ‘ডাকাত-ডাকাত’ বলে চিৎকার করেন। ওই সময় ডাকাতটি বাড়ির গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। চিৎকারে পাশের বাড়ি থেকে তাঁর মামা হারুন-অর রশীদ ছুটে গিয়ে বাড়ির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ করে গোয়ালঘরে ওই ডাকাতকে বেদম পিটুনি দেন।

খিরাটি বঙ্গতাজ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আওলাদ হোসেন জানান, সজিব ছিল খুবই মেধাবী ছাত্র। কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় ফরম পূরণ করা হয়নি তার।

ইউপি সদস্য সেলিম প্রধান বলেন, আমি আধা ঘণ্টা পর ইঞ্জিনচালিত একটি রিকশাভ্যান (টমটম) ব্যবস্থা করে দিলে পুলিশ ওই রিকশাভ্যানে তুলে সজিবকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ওই গ্রামের মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে ওষুধ ব্যবসায়ী আবদুল বাতেন বলেন, আটক হওয়ার সময় ওই তরুণের হাতে কালো পলিথিনে মোড়া দুমুঠো মুড়ি ও ছোলা ছিল।

এসআই সেন্টুচন্দ্র সিংহ বলেন, আমি ওই রাতে তরগাঁও, বারিষাব ও কড়িহাতা ইউনিয়ন এলাকায় টহল দায়িত্বে ছিলাম । থানার ডিউটি অফিসার মুঠোফোনে আমাকে রাত সাড়ে ১০টায় ডাকাত হানা দেওয়াসহ এক ডাকাতকে ধরে গণপিটুনি দেওয়ার খবর জানালে আমি ওই এলাকায় যাই।আমি গিয়ে আটক হওয়া ডাকাতকে রক্তাক্ত নিস্তেজ অবস্থায় দেখতে পাই। পরে আমি কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই।

নিহত জাহিদুল ইসলাম সজিবের বাড়িতে এখন আহাজারি : কাপাসিয়া সদর থেকে খিরাটিবাজারের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। খিরাটিবাজার থেকে উত্তর দিকে সিংগুয়া সড়কে এক কিলোমিটার দূরে খিরাটি উত্তরপাড়া গ্রাম। বাঁ পাশে ওই সড়ক থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে সজিবের বাড়ি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, একমাত্র ছেলের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে পাগলপ্রায় নিহত সজিবের মা রেবেকা সুলতানা রেবা। বাড়ির উঠানে কপালচাপড়ে বিলাপ করছিলেন সজিবের দাদি শুক্কুরি বেগম। থেমে থেমে চিৎকার দিয়ে ওঠছিল সজিবের ছোট বোন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুবাইয়া জাহান শশী। ছয় বছর বয়সী আরেক বোন ইসরাত জাহান নিশি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ওই ঘরটির দিকে; যে ঘরে থাকত তার বড় ভাই।

কান্নায় ভেঙে পড়ে নিহত সজিবের মা রেবেকা সুলতানা রেবা বলেন, আমার ছেলে পাগল ছিল এটা গ্রামের সবাই জানত। এত মেধাবী একটা ছেলে পাগল হয়ে যাওয়ায় গ্রামের মানুষজন কতই আফসোস করেছেন। তার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন, মানত করেছেন। আর এই ছেলেটাকেই ডাকাত বলে কী অবর্ণনীয় নির্যাতন করে মারা হল।

সজিবের মানসিক ভারসাম্য হারানোর বিষয়টি জানত গ্রামের সবাইঃ

গ্রামের প্রায় সবাই জানতেন সজিবের মানসিক ভারসাম্য হারানোর বিষয়টি। পাশের এমএ মজিদ বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক প্রতিবেশী শাহজাহান বলেন, খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল সজিব। প্রায় আড়াই মাস ধরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হত।

ঘাগটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য কফিল উদ্দিন বলেন, ‘মেধাবী একজন ছাত্র হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি গ্রামের সবারই জানা। অনেকে ওই ছেলেটার জন্য দোয়া করেছেন।

ওই ঘটনায় দুটি মামলা :

ঘটনার পরদিন রাতে ওই বীমা কর্মকর্তা মিনহাজ উদ্দিন বাদী হয়ে কাপাসিয়া থানায় ৭ থেকে ৮জন অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাতকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেন্টুচন্দ্র সিংহ। হত্যাকান্ডের ঘটনায় এসআই সেন্টুচন্দ্র সিংহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০০ থেকে ১৫০জন গ্রামবাসীকে আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান মিয়া। ওই মামলায় জাহিদুল ইসলাম সজিবকে অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত বলে বিবরণে উল্লেখ করা হয়। আর দুটি মামলায় সজিবের বয়স দেখানো হয়েছে ৩৫ বছর।

পুলিশের বক্তব্য :
সজিবসহ ৭ থেকে ৮জন সশস্ত্র ডাকাতদল হানা দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সেন্টুচন্দ্র সিংহ বলেন, গণপিটুনিতে নিহত ওই ডাকাত ছাড়া অন্য কোন ডাকাতকে কেউ দেখেনি। নিহতের সঙ্গে আরো কেউ ছিল কিনা তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

অপরদিকে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহজাহান মিয়া বলেন, গণপিটুনিতে নিহত ডাকাতের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে লোকমুখে শুনছি, এটা নাকি পাগল ছিল। বিষয়টি বুঝতে পারছি না।

কাপাসিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘নিহত ডাকাতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গাজীপুরের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


(এসকেডি/এস/জুন ১৯,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test