E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নৌকা চালিয়ে আসে স্কুলে

২০১৬ জুন ২২ ১৩:৪৩:৫৩
যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নৌকা চালিয়ে আসে স্কুলে

পিরোজপুর প্রতিনিধি : অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব! যে বয়সে বাবা-মা অথবা স্বজনদের হাত ধরে স্কুলের যাওয়ার কথা, সে বয়সে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশুরা  রোদ-ঝড়-বৃষ্টিকে সাথী করে নিজেরাই নৌকা বেয়ে যাচ্ছে তাদের বিদ্যাপিঠে । যে কোন সময় আছে জীবন হারানোর ভয়। তবুও ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয় তাদের।

এভাবেই অজানা শঙ্কা নিয়ে নাজিরপুর উপজেলার ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছোট-ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের বার মাসই বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে।

উপজেলার দেউলবাড়ী দোবড়া ইউনিয়নের ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যাতায়াতের কোন সড়ক যোগাযোগ নেই। এর মধ্যে ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আর মাদ্রাসা ৩টি। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীদের বছরের ১২ মাসই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহিম গাজী বলেন, ‘এখানকার শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়েই নৌকায় করে বার মাস স্কুলে আসে। অনেক সময় নৌকা ডুবে যায়। তবে বিলাঞ্চল হওয়ায় শিশুরা সাঁতার জানে, এ কারণে হতাহতের ঘটনা খুব একটা নেই।’ এতো গেল বর্ষাকালের চিত্র, কিন্তু যখন শীতকাল অসে তখন এ সকল খালে পানি থাকে না।

তখন শুরু হয় ভিন্ন সমস্যা। এসময় জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে দেয়া হয় স্কুলের সময়সূচী। অর্থাৎ- খালে জোয়ার এলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় এবং জোয়ার শেষ হবার আগে অথবা পরবর্তী জোয়ারে তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। পরবর্তী জোয়ার পেতে অনেক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা ও বিলাঞ্চল হওয়ায় এখানে স্কুল ফিডিং এর কোন কার্যক্রমও নেই। ফলে দরিদ্র শিশুরা ক্ষুধা নিয়ে ক্লাস করে।

ফলে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে না। তাই ফলাফলও ভালো হয় না। আর এ কারণে উপস্থিতি যেমনি কম, তেমনি ঝরে পড়ার হারও বেশি। গত রবিবার বেলা ১১টায় উপজেলার ৩৬নং পদ্মডুবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের মাঠে খেলা-ধুলা করছে। কোন শিক্ষককে তখন পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমীরণ রায়ের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বছরের ১২ মাসই নৌকায় করে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়। এখন ভাটার কারণে খালে পানি না থাকায় নৌকা নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। জোয়ার আসলেই তিনিসহ অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসবে। নিয়ম না থাকলেও জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে শীত মৌসুমে বিদ্যালয় চালাতে হয়।

এ দিন বিকেল ৩টায় উপজেলার ১১নং উত্তর গাওখালী আমভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে ছুটির ঘন্টা বাজছে আর শিক্ষার্থীরা ছুটা-ছুটি করে বিদ্যালয়ের সামনের খালে রাখা ছোট-ছোট নৌকায় উঠছে। তাড়াহুড়ো করে নৌকায় ওঠার কারণ জানতে চাইলে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোকুল চন্দ্র বেপারী জানান, খালে ভাটা হয়েছে। পানি শুকিয়ে যাবে। তাই ১ ঘন্টা আগে স্কুল ছুটি দেয়া হয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা বাড়ি যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে নৌকায় উঠছে। ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সৃষ্টি বড়ালের সাথে কথা বলতে চাইলে সময় নাই বলে জানায়, বাড়ি যেতে হবে, পানি শুকিয়ে গেলে নৌকা নিয়ে আর বাড়ি যাওয়া যাবে না।

পাশেই ত্রিগ্রাম সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কথা হয় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের সাথে। তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি কম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমিও অনেক কষ্ট করে স্কুলে আসি, যা না দেখলে বোঝানো যাবে না। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকা পানিতে ডুবে থাকে, নৌকা ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকে না। শীত মৌসুমে খালে পানি থাকে না। তখন অবস্থা আরো খারাপ হয়। জোয়ার-ভাটা দেখে স্কুলে যেতে-আসতে হয়। আবার নৌকা কিনে স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থা অনেকের নেই। অনেক সময় যে জায়গায় স্কুল সেখানে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য কোনো নৌকাও পাওয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে অনেক শিশু বর্ষায় স্কুলে যেতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চায় না।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাষ্টার মো: ওয়ালী উল্লাহ জানান, তার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বিলাঞ্চল হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ কম। তাই অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নৌকায় করে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শিক্ষায় উন্নতি করতে পারছে না। বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে ও চলমান রয়েছে। পুরো ইউনিয়নকে সড়ক যোগাযোগের আওতায় আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কৃষ্ণপদ সরকার বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিলাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এ কারণে স্কুলে উপস্থিতিও কম।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: তবিবুর রহমান বলেন, ‘বিলাঞ্চলের শিক্ষা বহু কষ্টের। তবে বর্তমান সরকার যেভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে, তাতে এ সমস্যা বেশী দিন থাকবে না।

(এআরবি/এএস/জুন ২২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test