E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আগৈলঝাড়ায় মাসে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকার কুচিয়া রপ্তানী

২০১৬ আগস্ট ২০ ১৫:০৮:৪০
আগৈলঝাড়ায় মাসে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকার কুচিয়া রপ্তানী


আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ১২ কোটি টাকার কুচিয়া রপ্তানী হচ্ছে বিদেশে। কুচিয়া চাষে ভাগ্য ফিরেছে পাঁচ শতাধিক লোকের। মৎস্য অধিদপ্তর ও সাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে আগৈলঝাড়ায় কুচিয়া চাষে ৩৬ কোটি টাকা ব্যায়ে পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু।



সংশ্লিষ্ঠ সূত্র মতে, বানিজ্যিকভাবে কুচিয়ার চাষ সম্প্রসারণ করতে দক্ষিনাঞ্চলের তিনটি জায়গায় কুচিয়া ও কাঁকড়ার খামার স্থাপনের জন্য পৃথকভাবে ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর এবং সাদু পানি গবেষণা কেন্দ্র।

এসব প্রকল্প থেকে বছরে কুচিয়া ও কাঁকড়া রপ্তানী করে কয়েক’শ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়কারী সংশ্লিষ্ঠরা।
কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ প্রকল্প পরিচালক ড. বিনয় চক্রবর্তী জানান, প্রচুর সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে আগৈলঝাড়ায় কুচিয়া চাষের জন্য ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন অর্থ বছরে বানিজ্যিকভাবে কুচিয়া চাষের সম্প্রসারণ করতে পাইলট প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। দু’টি ধাপে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে মৎস্য অধিদপ্তর এবং দ্বিতীয় ধাপে সাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তর ২২ কোটি টাকা এবং সাদু পানি গবেষণা কেন্দ্র ১৪ কোটি টাকার প্রাক্কালন ব্যয় ধরা হয়েছে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. ওয়াহেদুজ্জামান জানান, আগৈলঝাড়ায় বানিজ্যিকভাবে কুচিয়ার চাষ বাড়াতে সরকারের পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া আরও চারটি জেলায় এ প্রকল্পের আওতায় কাঁকড়া চাষ সম্প্রসারণের কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। কুচিয়া প্রদর্শনী খামারের জন্য তিনটি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। কুচিয়া সাধারণতঃ ‘মাছ” হিসেবে খাবারের তালিকায় গ্রহন করা হয়। কুচিয়া স্বাদ ও অধিক পুষ্টিগুন সম্পন্ন।

তিনি আরও জানান, কুচিয়া চাষের জন্য বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা এবং কাঁকড়া চাষের জন্য ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং পিরোজপুর জেলা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এক’শ চাষি ও ব্যবসায়িকে বাছাই করে কুচিয়া চাষের উপর তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. অনিল চন্দ্র দত্ত বলেন, সাপের মতো দেখতে হলেও কুচিয়া এক প্রকার মাছ। এটা দেশের বিভিন্ন স্থানে কুইচ্চা, কুইচা, কুচে, কুচো, কুচিয়া নামে পরিচিত। দেশের হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পরিত্যাক্ত ও মজা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে কুচিয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। কুচিয়া মাছের শরীর লম্বা বেলনাকৃতির। আপাতদৃষ্টিতে কুচিয়া মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান যার বেশিরভাগ অংশই চামড়ার নিচে সজ্জিত থাকে।

খাদ্য হিসেবে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কুচিয়া মাছকে অস্পৃর্শ মনে করে। যদিও কুচিয়া শারীরিক দুর্বলতা, রক্ত শূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌষধের কাজ করে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামার বাড়ি) উপ-পরিচালক রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ জানান, পরিবেশের খাদ্য জালে কুঁচিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে। ধান ক্ষেতের ফসল অনিষ্টকারী পোকার লার্ভা, শামুক, কৃমি ইত্যাদি খেয়ে কুঁচিয়া কৃষকের উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অনেক পচা-গলা জৈব পদার্থ খেয়ে পরিবেশে মানবসমাজের বিশেষ বন্ধু হিসেবেও ভূমিকা রাখে কুচিয়া।

সূত্র মতে, পাইলট প্রকল্প গ্রহনের আগে শুধুমাত্র আগৈলঝাড়া উপজেলা থেকে প্রতি বছর ১২ কোটি টাকার কুচিয়া রপ্তানী হত বিদেশে। কুচিয়া শিকার ও বিক্রির মাধ্যমে এলাকার পাঁচ শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। আর একারণেই বরিশাল বিভাগের মধ্যে আগৈলঝাড়া উপজেলায় কুচিয়া চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাইলট প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে।

কুচিয়া শিকারী, খামারী ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলায় প্রায় ১৫ বছর পূর্বে কুচিয়া শিকার ও ব্যবসা শুরু হয়। এক পর্যায়ে উপজেলায় কুচিয়ার ৬টি আড়ত গড়ে ওঠে। আড়তগুলোর মধ্যে অন্যতম আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরে দু’টি, গৈলায় তিনটি এবং ঐচারমাঠে একটি।
আগৈলঝাড়া গৈলা এলাাকার কুচিয়া ব্যবসায়ি সুশীল মন্ডল, জয়দেব মন্ডল, অর্জুন মন্ডল, জহর মন্ডল, ভীম মন্ডল ও প্রদীপ বাড়ৈ জানান- তারা আগে মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করতেন। আবার অনেকে ছিলেন বেকার।

ব্যবসার জন্য ঢাকা আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে যোগাযোগ হয় ঢাকার উত্তরার টঙ্গীর কামারপাড়া ও নলভোগ এলাকার অর্কিড ট্রেডিং কর্পোরেশন, আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনাল ও গাজী এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য কুচিয়া রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের মজুদ করা কুচিয়া বিদেশে রপ্তানী করে আসছিল তারা। রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কুচিয়া ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয় কুচিয়া ব্যবসায়ীদের দাদনে টাকা দিতেন।

ওই সকল প্রতিষ্ঠান থেকে আগৈলঝাড়ার ব্যবসায়ীরা পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা দাদনে (সুদে বা তাদের কাছে মাল বিক্রির শর্তে) গ্রহন করতেন। রপ্তানীকারকদের কাছে কুচিয়া বিক্রির মাধ্যমে দাদনের টাকা পরিশোধ করতেন ব্যবসায়িরা।

ওই দাদনের টাকা নিয়ে স্থানীয় কুচিয়া ব্যবসায়িরা এলাকার বেকার যুবকদের মাঝে দশ থেকে ত্রিশ হাজার করে টাকা দাদন দিতেন কুচিয়া শিকারের জন্য। আগৈলঝাড়ার স্থানীয় লোকজন ছাড়াও কুচিয়া শিকারের সাথে জড়িত হয়ে পরে ময়মনসিংহ এলাকার যুবকরা। জীবিকার প্রয়োজনে এরা কুচিয়া শিকার করে। এরা কুচিয়া শিকার করে স্থানীয় ব্যবসায়িদের কাছে বিক্রি করত। দিনমজুর ওই মানুষগুলো দৈনিক শ্রম বিক্রির চেয়ে কুচিয়া শিকার ও বিক্রির মাধ্যমে অধিক লাভবান হয়েছে। এভাবেই স্থানীয় ব্যবসায়িদের মাধ্যমে কুচিয়ার বাজারের ক্রমঃবিকাশ ঘটিয়ে অন্তত পাঁচ’শ লোক কুচিয়া শিকার, মজুদ ও ব্যবসার মাধ্যমে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

শিকারীরা প্রথমতঃ গর্তের ভিতরে হাত বা লাঠি দিয়ে। দ্বিতীয়তঃ গর্তের মুখে বড়শি দিয়ে এবং তৃতীয়তঃ মাছ ধরা চাঁইয়ের মধ্যে খাবার দিয়ে কুচিয়া শিকার করেন।

স্থানীয় ব্যবসায়িরা আরও জানান, বাজারে প্রতি কেজি কুচিয়া বিক্রি হয় আড়াই’শ থেকে তিন’শ টাকায়। সেই হিসেবে প্রতি মন কুচিয়ার মূল্য দাড়ায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কুচিয়ার বাজার মূল্য ওঠানামা করে।

আগৈলঝাড়ার উল্লেখিত ছয়টি আড়ৎ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৭ টন হিসেবে মাসে ২৮ টন কুুচিয়া ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। যার মূল্য দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে আগৈলঝাড়া থেকে ৬টি আরতের মাধ্যমে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকার কুচিয়া বিক্রি হচ্ছে। যা বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে।

ঢাকার উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলো কুচিয়া মাছগুলো বিদেশে রপ্তানী করে আসছে। বাংলাদেশ লাইট এন্ড জিলড ফুড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী মো. শিহাব উদ্দিন মোবাইল ফোনে জানান, তারা আগৈলঝাড়া থেকে প্রতি সপ্তাহে ৭-৮ টন কুুচিয়া আমদানি করেন। আর সারা দেশ থেকে সপ্তাহে আমদানি হয় প্রায় একশ’ টন। আমদানিকৃত কুচিয়ার ৯০ ভাগ রপ্তানী হয় চীনে। বাকি ১০ ভাগ রপ্তানী হয় সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, তাইওয়ান এবং আমেরিকায়। তিনি আরও জানান, কুচিয়া মাছ রপ্তানী করে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে তিন’শ কোটি টাকার উপরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। এ খাত থেকে সরকার ৪৫ কোটি টাকার উপরে রাজস্ব পেয়েছে। সম্ভাবনাময় এখাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে কুঁচিয়া এবং কাঁকড়া চাষ এবং গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, এলাকা জরীপের সময় দেখা গেছে, বেশ কিছু মানুষ কুচিয়া শিকার ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া এটি লাভজনক এবং রপ্তানীযোগ্য হওয়ায় জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে প্রকল্পটি বাস্তবানের জন্য আগৈলঝাড়া উপজেলার নাম সুপারিশ করেন। মাঠ পর্যায়ে কুুচিয়া চাষ প্রদর্শনীর জন্য আগৈলঝাড়ায় দু’টি স্থান নির্ধারণ করে ১০ জন করে দল গঠন করা হয়েছে। এরমধ্যে বাকাল গ্রামের চ্যাটার্জী বাড়ি, রাজিহার গ্রামে বিশ্বাস (ভাংরা) বাড়ি।

উপজেলার গৈলা গ্রামের সুশীল মন্ডল জানান, তিনি আগে মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করতেন। বর্তমানে কুচিয়ার ব্যবসা করে ভালো আছেন তিনি। জয়দেব মন্ডল জানান সরকার যদি এই খাতে তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করত তাহলে দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি থাকতে হত না। তাহলে এ ব্যবসারও প্রসার লাভ করত এবং সরকার আরও বেশি রাজস্ব পেত।

(টিবি/এএস/আগস্ট ২০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test