E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাড়ে তিন বছর পর মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন সেই ৭ নাবিক, এলাকায় আনন্দাশ্রু

২০১৪ জুন ১৪ ২১:১৫:৪৮
সাড়ে তিন বছর পর মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন সেই ৭ নাবিক, এলাকায় আনন্দাশ্রু

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সোমালীয় জলদস্যুর হাতে সাড়ে তিন বছর জিম্মি থাকার পর মুক্তি পাওয়া সাতক্ষীরার চার নাবিকসহ সাতক্ষীরার বাংলাদেশের সাত নাবিক বাড়ি ফিরেছেন। শনিবার বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে  প্রথম বাড়ির সীমানায় পা রাখেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ী ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের মৌ হোসেনের ছেলে গোলাম মোস্তফা। সাতক্ষীরা- আশাশুনি সড়কের ভালুকা চাঁদপুর যতন মালির মোড়ে গোলাম মোস্তফার বাড়ি। শনিবার বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে নামার সাথে সাথে পূর্ব থেকে অপেক্ষামান শত শত মানুষ বৃষ্টির মধ্যেও দৌড়ে যায়। এরপর স্বজনদের বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে গোলাম মোস্তফা। স্বজনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে গোলাম মোস্তফা বলেন, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বন্দী হবার পর কোনদিন ভাবিনি আমার ভিটে ফিরে আসবো। আমার ছেলে-মেয়ে ও স্বজনদের মুখ দেখতে পাবো এটা কোনদিন ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দয়ায় আর মহান আল্লাহ’র অশেষ মেহেরবাণীতে আবার আমি আমার সন্তান ও স্বজনদের মুখ দেখতে পাচ্ছি।

এসময় সংক্ষিপ্তভাবে বন্দী দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে গোলাম মোস্তফা হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, আমরা যে জাহাজে ছিলাম তা ছিল মালয়েশিয়া পতাকাবাহী। জাহাজটির মালিক ছিলেন, মালয়েশিয়ান। সোমালীয় জলদস্যুরা জাহাজটি আক্রমন করে আমাদের জিম্মি করে রাখে। এক পর্যায়ে জাহাজটি ধ্বংস করে দেয়। তারপর আমরা সাঁতার কেটে আমাদের পিছনে থাকা আরেকটি জাহাজে উঠি। সে জাহাজটির আক্রমন করে সোমালীয় জলদস্যুরা। তারপর থেকে আমাদের উপর চলে নির্যাতন। হাত-পা বেধে ওরা আমাদের নির্যাতন করতো। এক বেলা খেতে দিতো। কখনো কখনো আমাদের দিয়ে ছিনতাই করাতো। আমাদের সামনেই ভারতীয় এক নাবিককে জলদস্যুরা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। প্লাস দিয়ে শরীরের চামড়া টেনে ধরতো। কখনো কখনো শরীরে সুঁচ ফুটাতো। নির্যাতনের কথা কী বলবো? সাড়ে তিন বছর ধরে সোমালীয় জলদস্যুরা একে সময় একেক রকম নির্যাতন করতো। নির্যাতনের কথা স্মরন করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন গোলাম মোস্তফা।

গোলাম মোস্তফা আরো বলেন, বন্দী দশা থেকে আজ আমরা মুক্তি পেয়েছি। ফিরে পেয়েছি আপনজনদের এটা আমার দ্বিতীয় জীবন। কোনো দিন ভাবিনি দেশে ফিরে আসবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় আজ আমরা স্বজনদের মুখ দেখতে পাচ্ছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে চির কৃতজ্ঞ। চির ঋণী।

গোলাম মোস্তফার মেয়ে মীম কাঁদতে কাঁদতে জানায়, আজ সাড়ে তিন বছর পর আমার আব্বুকে ফিরে পেয়েছি। আব্বুর মুখ দেখতে পেয়ে আমি আনন্দিত। এ আনন্দ কাউকে বোঝাতে পারবো না।

গোলাম মোস্তফার বোন হাসিনা খাতুন সাড়ে তিন বছর পর ভাইয়ের মুখ দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। গোলাম মোস্তফা কে জড়িয়ে ধরে হাসিনা খাতুন বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমি মোস্তফাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। সোমালীয় জলদস্যুরা ওদের কে বন্দী করার পর থেকে অপেক্ষা করছি এই দিনটির জন্য। আমার ভাই কে আমার কোলে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। গোলাম মোস্তফার বাড়ি থেকে ২০০ গজ দুরে আরেক নাবিক নূরুল ইসলামের বাড়ি। নূরুল ইসলামের বাড়িতেও একই রকম আনন্দাশ্রু মাখা পরিবেশ। সাড়ে তিন বছর পর নূরুল ইসলাম কে কাছে পেয়ে তার স্ত্রী জোসনা খাতুন কেঁদে ফেলেন। শারিরীক প্রতিবন্ধী জোসনা খাতুন জানায়, আমার স্বামী নূরুল ইসলামকে সাড়ে তিন বছর পর ফিরে পেয়েছি। কোন দিন ভাবিনি নূরুল ইসলাম আবার সোমালীয়া থেকে মুক্তি পেয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। আজ আমার জীবনের সব চেয়ে আনন্দের দিন। নূরুল ইসলামের বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে নাবিক হাবিবুর রহমান হবির বাড়ি। বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিটে সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে হাবিবুর রহমান হবি ভালুকা চাঁদপুর বাজারে নামার সাথে সাথে শত শত মানুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দৌড়ে যায় তার কাছে। হবি কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার বৃদ্ধ পিতা ইমান আলী। হাবিবুর রহমান হবি পিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আব্বা আমি ভালো আছি। তোমার কিছু হয় নি তো? তুমি ভালো আছো তো? গ্রামবাসী এসময় হবিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। হবি সবাইকে সান্তনা দেয়। মায়ের কথা মনে করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন হবি। সবাই তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু তার মা কোথায়? মায়ের খোঁজ নিতেই তার পিতা ইমান আলী হবির মায়ের কবর দেখিয়ে বলেন, তোমার (হাবিব) শোকে তোমার মা মারা গেছে। তখন শোকের মাতম ওঠে সারা বাড়ি জুড়ে।

হাবিবুর রহমান হবির বাড়ি থেকে প্রায় দু’ কিলোমিটার দুরে আরেক নাবিক আবুল কাশেমের বাড়ি। সকাল থেকে ওই বাড়িতে অপেক্ষা করছিল গ্রামবাসী। কখন ফিরে আবুল কাশেম। অবশেষে আবুল কাশেম ফিরে আসার পর গ্রামবাসী তাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে। তোমরা সবাই কেমন আছো? তোমরা ভালো ছিলে তো? প্রশ্ন আবুল কাশেমের প্রশ্ন শেষ হতেই গ্রামবাসী সমস্বরে বলেন, আমরা ভালো আছি। তুমি কেমন ছিলে? গ্রামবাসীর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন আবুল কাশেম। সাড়ে তিন বছরের বন্দী জীবনের বর্ণনা দিতে দিতে উঠোন থেকে ঘরে প্রবেশ করেন তিনি। তারপর পরিবার পরিজন, আতœীয় স্বজনদের সাথে আনন্দাশ্র“ মেশানো আবেগে প্রকাশ করেন দেশে ফেরার অনুভূতি।

প্রসঙ্গত ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর বন্দী হওয়া মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আলভাঁদোয় থাকা অন্য দেশের নাগরিক, সাতক্ষীরার চার নাবিকসহ সাত বাংলাদেশি নাবিককে অপহরণ করে সোমালিয় জলদস্যুরা। জলদস্যুদের কাছে আটক হওয়ার পরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনওডিসি ও এমপিএইচআরপির মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনওডিসি ও এমপিএইচআরপি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে বন্দি বাংলাদেশী নাবিকদের মুক্ত করেন।

(আরকে/অ/জুন ১৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test