E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে লড়াই চলছে আওয়ামীলীগের দুই সভাপতির

২০১৬ ডিসেম্বর ২৩ ১৩:৪৯:০৮
শরীয়তপুরে লড়াই চলছে আওয়ামীলীগের দুই সভাপতির

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : প্রথম বারের মত দেশে আগামী ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে দেশের ৬১ জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন। চেয়ারম্যান পদে শরীয়তপুরে লড়াই চলছে আওয়ামীলীগের দুই সভাপতির মধ্যে। কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ মনোনয়ন দিয়েছেন পদ্মা সেতুর প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা জেলা আ’লীগের বর্তমান সভাপতি ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদারকে আর তার প্রতিপক্ষ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি, একটি বিদ্যালয়ের জমি বিক্রির কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে দুদকের মামলার প্রধান আসামী আব্দুর রব মুন্সি। প্রকাশ্যে খোকার পক্ষে বেশিরভাগ নেতার সমর্থন থাকলেও ভেতরে অনেকের মৌন সমর্থন রয়েছে রব মুন্সির দিকেও। এ নিয়ে জমে উঠেছে শেষ সময়ের নির্বাচনী প্রচারনা।

শরীয়তপুর জেলার ৬টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা ও ৬৫ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জেলা পরিষদকে ১৫টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি রয়েছে সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড। স্থানীয় সরকার কাঠামোর সকল স্তরের ৯ শত ২৬ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এ নির্বাচনে তাদের ভোট প্রয়োগ করবেন। এরা হলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভা মেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারেরা। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দুই জন, ৫টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের মধ্যে ৩টিতে ১০ জন, ১৫টির মধ্যে ১৪ টি সাধারন ওয়ার্ডে ৪৩ জন সদস্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। ইতমধ্যে ১নং ও ২নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও ৮নং ওয়ার্ডে সাধারন সদস্য পদে একজন বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা নির্বাচন কার্যালয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সদস্য পদের প্রতিদ্বন্দি প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশী যোগাযোগ করছেন ভোটারদের সাথে। আওয়ামীলীগের একটি বৃহৎ অংশ দলীয় প্রার্থী খোকা শিকদারের মোটর সাইকেল প্রতীকের পক্ষে প্রতিটি ইউনিয়নে ঘুরে ঘুরে ভোট চাইছেন। অপর দিকে আব্দুর রব মুন্সির আনারস প্রতীকের পক্ষে তার পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয় স্বজনসহ পদ পদবী বিহীন কিছু দলীয় সমর্থক ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।

একটি জরিপে দেখা গেছে, জেলার ৬৫ ইউনিয়নের ৬৪ চেয়ারম্যান, ৬ উপজেলা পরিষদের ৫ জন চেয়ারম্যান এবং ৫টি পৌরসভার ৫ জন মেয়রই আওয়ামীলীগের। এদের মধ্যে দুই একজন বাদে বাকি সবাই সমর্থন করেছেন খোকা শিকদারকে। তাদের সাথে বেশীরভাগ মেম্বার এবং কাউন্সিলরগন ও তাদের সমর্থন দিয়েছেন খোকা শিকদারের মোটর সাইকেল প্রতীকে। ফলে খোকা শিকদারের পক্ষে একটি গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামীলীগ প্রার্থী ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদার তার প্রায় ৪৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামীলীগের বাইরে কোন দলের সাথ আপোষ করেননি। সব সময় মূল ধারার সাথে যুক্ত থেকে তিনি দলের চরম দূর্দিনে দলীয় কর্মীদের পাশে থেকেছেন। ৭৫ ট্রাজেডির পর অনেকেই দল থেকে বিভক্ত হলেও শত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি সাহসিকতার সাথে দলীয় আদর্শ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বাইরে ভিন্ন কিছু বিবেচনা করেননি। তিনি আ’লীগের ক্রান্তিকালে জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে দলকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম শরীয়তপুর জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর অবিভক্ত ভেদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ দিন। টানা ৩০ বছর খোকা শিকদার শরীয়তপুর জেলা আওয়ামলীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালনের পর চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারী তাকে জেলা আওয়মীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। খোকা শিকদার একজন সফল ব্যবসায়ী নেতা। তিনি মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মানরে প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সহজে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি ১৯৮৪ সালে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করেন। যাতে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। খোকা শিকদারের স্বপ্ন ও দাবীর ফসল হিসেবে আজ দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা বহুমূখি সেতু নির্মান এগিয়ে চলেছে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে।

অপর দিকে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও শরীয়তপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুর রব মুন্সিরও রয়েছে বিভিন্ন দলের সাথে রাজনীতি করা অভিজ্ঞতা। তিনি ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতির সাথে জরিত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে তিনি ১৯৬৪ সালে মাদারীপুর নাজিম উদ্দিন কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি শরীয়তপুর-১ আসন থেকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে মুজাফ্ফর ন্যাপ এর হয়ে কুড়েঘর নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে পরাজিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পূনরায় একই আসন থেকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে কুড়েঘর প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের সকল প্রগতিশীল রাজনীতিবীদেরা যখন বাকশালে যোগ দেন আব্দুর রব মুন্সিও তখন এই কাতারে ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি স্বৈর শাসক এরশাদ সরকারের জনদলে যোগ দিয়ে শরীয়তপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে চরমভাবে পরাজিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি আওয়ামীলীগে যোগদান করেন এবং জেলা আ’লীগের সহসভাপতির পদ অর্জণ করেন। ২০০৩ সালে তাকে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

২০০৮ সালে শরীয়তপুর পৌরসভা নির্বাচনে আব্দুর রব মুন্সি আওয়ামীলীগের টিকেটে মেয়র নির্বাচিত হন। রাজনীতির পাশাপাশি আব্দুর রব মুন্সি টানা ৩৪ বছর আঙ্গারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করলে সভাপতি ও মেয়র দুইটি পদের প্রভাবে তিনি অনেক অনিয়নমে জরিয়ে পরেন। এসময় তিনি প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক হতে থাকেন। ২০১২ সালে তিনি আঙ্গারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্তত ৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১২ বিঘা জমি অবৈধভাবে পানির দামে বিক্রি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করলে তার বিরুদ্ধে দূর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় রব মুন্সি জেল খাটেন। ফলে ২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হলে দূর্নীতির কারনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি। একই কারনে গত ২৭ ফেব্রুয়ারী জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থী হলে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে সভপতির পদ থেকে সড়িয়ে খোকা শিকদারকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বর্তমান জেলা পরিষদ নির্বাচনেও রব মুন্সি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হতে চেয়ে মনোনয়ন বোর্ডের কাছে আবেদন করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোকা শিকদারকেই মনোনয়ন প্রদান করেন।

ছাত্র জীবনে কলেজ নির্বাচন ও একবার পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়া ছারা রব মুন্সি বাকি কোন নির্বাচনেই সুবিধা করতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাকালে আঙ্গারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বর মুন্সি তার আপন ভাতিজা সামসুল হক মুন্সিকে দিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করান। সেখানে বিএনপি প্রার্থীর সাথে তার পরাজয় হয়। ২০০৮ সালে আবার আওয়ামলীগ ক্ষমতায় গেলে ২০১১ সালে রব মুন্সি তার আরেক ভাতিজা আনোয়ার কামালকে দিয়ে আঙ্গারিয়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করান। সেখানেও তার ভাতিজা তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আব্দুর রব মুন্সি তার সহধর্মীনি (স্ত্রী)কে দিয়ে আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করিয়ে একজন সাবেক ছাত্র নেতার সাথে দেড় হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মেয়রের পদ হারিয়ে, সভাপতি থেকে ছিটকে পরে, স্ত্রীর করুন পরাজয়, জেলা পরিষদের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরেও প্রবীন রাজনীতিক আব্দুর রব মুন্সি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদের নির্বাচন করায় এলাকার রাজনৈতিক সচেতন মহলে নানা ধরনরে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে।

জেলার বিভিন্ন এলাকার ভোটারদের মতামত জানতে চাইলে তাদের অনেকে কোন দূর্নীতিবাজকে ভোট না দিতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন। আবার অনেক ভোটাররা আব্দুর রব মুন্সিকে তার জীবনের শেষ সুযোগ হিসেবে ভোট দিবেন বলেও জানিয়েছেন। শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, এই জেলার ইতিহাসে কোন জনপ্রতিনিধি বা কোন দলের সভাপতি দুদকের মামলায় কারাগারে যাননি। তিনি পৌরসভার মেয়র হয়ে স্কুলের জমি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে দুদকের মামলায় জেল খেটেছেন। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হলে তিনি আরো বড় ধরনরে অপরাধের সুযোগ খুঁজবেন। তার কাছে এতবড় প্রতিষ্ঠান নিরাপদ নয়।

শরীয়তপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, আমরা আটজন লোক জেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদারকে মনোনয়ন দিয়েছেন। খোকা শিকদার একজন স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ। তাকে নির্বাচিত করতে দলের ভেতর কোন বিভক্তি নেই। খোকা শিকদার এই জেলার মানুষের কাছে অনেক নন্দিত ব্যক্তিত্ব। ৩০ বছর আগে তিনি মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মানের স্বপ্ন দেখে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে, এখানে খোকা ভাইর অনেক অবদান রয়েছে।

(কেএনআই/এএস/ডিসেম্বরক ২৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test