E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে না কপোতাক্ষ খনন

২০১৪ জুন ১৬ ১৬:০৮:২৮
ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে না কপোতাক্ষ খনন

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ঝুড়ি কোদালের পরিবর্তে খননযন্ত্র (স্কেবেটর) ব্যবহার করে কপোতাক্ষ নদ খনন করে সরু খাল তৈরি করা হচ্ছে। খননকৃত মাটির স্তুপ করে রাখা হচ্ছে নদের ভেতরই। ভারী বৃষ্টি হলে এই মাটিতে নদ ফের ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া নদের ভেতরে মাটির স্তুপ করে রাখায় চরভরাটি জমি ভুমিদস্যুদের দখলে নিতে সুবিধা হচ্ছে। এ অবস্থা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের। বর্তমানে প্রায় ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ২১ কিলোমিটার খননের কাজ চলছে। তবে এ খনন কাজ বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে লোক দেখানো কিছু কাজ ছাড়া কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যদিও সোমবার রাতে সংসদীয় কমিটির তিন সদস্যের আগমনকে সামনে রেখে গত কয়েকদিন যাবৎ কাজের গতি কিছুটা বেড়েছে। আগের ভরাট করা স্থানে আবার খনন করে নদের অপর পাড়ে ফেলা হচ্ছে। এক কথায় এ ধারের মাটি ওধারে আর ওধারের মাটি এধারে ফেলার মধ্যদিয়ে লোক দেখানো কাজ হচ্ছে। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে পত্রপত্রিকায় পজেটিভ নিউজ প্রকাশের প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোর অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের জুলাই মাসে চার বছর মেয়াদি কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ডিপিপি অনুযায়ী প্রথম বছরে তালার পাখিমারা বিলে টিআরএম’র জন্য প্রায় ১৩ কিলোমিটার পেরিফেরিয়াল বাধ নির্মাণ, শালিখা নদী পুনঃখনন, পেরিফেলিয়াল বাধের বিভিন্নস্থানে পাইপ আউটলেট নির্মাণ, গজশ্রী খাল খনন, বিলের সাথে সংযুক্ত ১১টি খাল খনন, কপোতাক্ষের উভয় তীরে বেড়িবাধ নির্মাণ, বেইলি ব্রিজ নির্মাণ এবং দু’টি স্কেবেটর ও দুটি গাড়ি ক্রয় অর্ন্তভুক্ত ছিল। এ জন্য প্রয়োজন ছিল ৩০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ঐ বছর ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু দুটি বিলাশ বহুল গাড়ি ক্রয় ছাড়া প্রথম বছরের আর কোন কাজ শতভাগ শেষ হয়নি।
দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে জনগণের অংশগ্রহণ ও মোটিভিশনের জন্য ডব্লিউএমএ গঠন করার কথা ছিল। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এছাড়া পানি, লবণাক্ততা, নদীতে ও টিআরএম বেসিনে বন্যা জোয়ার মনিটরিং ও নদ পুনঃখননকালে প্রি ও পোস্ট ওয়ার্ক সার্ভে কাজ, ফসলের ক্ষতিপূরণ, ক্রসড্যাম/ক্লোজার নির্মাণ ও অপসারণ, টিআরএমের সংযোগ খাল খনন এবং কপোতাক্ষ নদ পুনঃখনন কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এর অধিকাংশ কাজই অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
এদিকে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শেষ দিকে এসে বর্ষা মৌসুম শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ৬১ কোটি ৮০ লাখ ৭৪ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষের ২১দশমিক ২৫০ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়। খনন কাজ ১৫টি গ্রুপে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ১২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে, যার দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ৪৫০ মিটার। এর মধ্যে দুই ইউপি চেয়ারম্যানকে টেন্ডার ছাড়াই ৮৫৫ মিটার ও চার ইউপি সদস্যকে ৯৪৫ মিটার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে বলে পাউবো সূত্রে জানা গেছে।
কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- যশোর সদরের মেসার্স কপোতাক্ষী এন্টারপ্রাইজ, এমএসসি-একেএ, কেএমআই-এমজিআর, এমএএইচ-এমজিএফ, এমএসসি-একেএ, মেসার্স রেজা এন্টারপ্রাইজ, এসএনএইচ-এমজিআর, মো. নূর হোসেন, এমএসসি-এএন্ডসি, এমইবিএল-কেই, সাতক্ষীরা সদরের এসএইউ-এমকেই ও খুলনার মো. শামিম আহসান।
এছাড়া টেন্ডার ছাড়াই তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম লিয়াকত হোসেনকে আটটি প্রকল্প, একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শামসুল আলমকে ১১টি প্রকল্প, ইউপি সদস্য সিদ্দিক হোসেনকে আটটি প্রকল্প, ইউপি সদস্য নিমাই সানাকে ১০টি প্রকল্প, একই উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটুকে ১৪টি প্রকল্প, একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে দু’টি প্রকল্পের কাজ দেয়া হয়েছে। চলতি জুনের মধ্যে উক্ত কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ মাসেই অধিকাংশ গ্রুপের কাজ শুরু হয়েছে। বর্ষ মৌসুম শুরু হওয়ার মুহূর্তে কাজ শুরু করায় এর বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, কপোতাক্ষ নদ ঝিনাইদহ’র মহেশপুর উপজেলার তাহেরপুর নামক স্থান থেকে উৎপত্তি হয়ে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, যশোর’র ঝিকরগাছা, কেশবপুর ও মনিরামপুর, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া, আশাশুনি ও শ্যামনগর এবং খুলনার পাইকগাছার শিববাড়ি শিপসা নদীর ত্রিমোহনায় মিশেছে। কপোতাক্ষ নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার। বর্তমানে সাত কিলোমিটার বাদে এ নদের সবই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে কপোতাক্ষ তীরের কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে।
এদিকে সোমবার বিকেলে সরেজমিনে তালা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় যেয়ে দেখা যায়, ইতোপূর্বে নদ খনন করে সেই মাটি দিয়ে যে পাড় তৈরী করা হয়েছিল সেই পাড় আবার কেটে নদের অপর পাড়ে ফেলা হচ্ছে। কোন কোন স্থানে আগের ফেলে রাখা মাটি আবার তুলে আরো সামান্য দূরে ফেলা হচ্ছে। পাখিমারা বিলে টিআরএমের জন্য ক্যানেল খননের জন্য স্কেবেটর মেশিন আনা হয়েছে। গাছ গাছালি কাটার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর এসব করে দেখানো হচ্ছে কাজের গতি।
মাগুরা গ্রামের জহর আলী গাজী জানান, কপোতাক্ষ নদের তলা ২২ থেকে ২৫ ফুট, উপরে ৩৫ থেকে ৪০ ফুট ও তিন থেকে চার ফুট গভীর করে খনন করা হচ্ছে। খননের মাঠি নদের ভেতরে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। বর্ষা হলেই এ মাঠিতে নদ আবার ভরাট হয়ে যাবে।
মাগুরা গ্রামের শিক্ষক জনাব আলী জানান, কপোতাক্ষ নদ খননে আগেও যে লুটপাট হয়েছে, এবার তাই হচ্ছে। পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা কপোতাক্ষকে দুধের গাভী হিসেবে ব্যবহার করছে। খননের নামে তারা লুটপাট ছাড়া কিছুই বোঝে না।
বারুইপাড়া নারায়ন দেবনাথ অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা কাজ তেমন তদারকি করে না। ফিল্ডে আসে না ঠিকমতো। এজন্য ঠিকাদাররা সুযোগ পায়। একই অভিযোগ মাগুরা গ্রামের নিমাই দেব নাথ, সুফিয়া বেগম, সাদ্দাম হোসেন, গনেশ মন্ডল, বিধান রায়সহ কয়েক জনের।
খননযন্ত্র (স্কেবেটর) চালক মিজানুর রহমান বলেন, নদের এক পাশ খনন করা হচ্ছে। এই মাটি নদের তীরে রাখা হচ্ছে। পরে এ মাটি অপসারণ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী খনন হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিকাদার যে ভাবে বলেছে, সেই ভাবে খনন করছি।
ঠিকাদারের পক্ষে কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা জামানুল হক মুন্নি জানান, নকশা অনুযায়ী খনন করার চেষ্টা করছি। তবে সব সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, যশোরের এমএসসি-একেএ (জেভি) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক শামিম চাকলাদার বাবুসহ ১২জন ঠিকাদার এই খননের কাজ বাস্তবায়ন করছেন।
কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম জানান, কপোতাক্ষ নদ মুল ডিজাইন অনুযায়ী খনন করা হচ্ছে না। লোক দেখানো খনন করে লুটপাট করা হচ্ছে।
এমএসসি-একেএ (জেভি) প্রতিষ্ঠানের মালিক শামিম চাকলাদার বলেন, নকশা অনুযায়ী খনন করা হচ্ছে। তবে খননকৃত মাঠি আপাতত নদের ভেতর রাখা হচ্ছে। এ মাটি নদের ভেতর থেকে অপসারণ করা হবে। একই কথা বলেছেন ঠিকাদার শামিম আহসান।
খেশরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম লিয়াকত হোসেন কপোতাক্ষ খননের কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নামে আমি কাজ পেয়েছি। ভেতরে অনেকই এ খনন কাজের সাথে আছে।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান বলেন, নদের ভেতরে কোন মাটি রাখা যাবে না। খননের মাঠি নদের ভেতর থেকে অপসারণ করতে হবে। সবকিছু সঠিকভাবে খনন না হলে ঠিকাদার বিল পাবে না।
(আরকে/এএস/জুন ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test