E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

দুই পরিবারের ৭ প্রতিবন্ধীর মানবেতর জীবন

২০১৭ এপ্রিল ০৭ ১১:৫৪:৪৯
দুই পরিবারের ৭ প্রতিবন্ধীর মানবেতর জীবন

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরের  গোসাইরহাট ও ডামুড্যা উপজেলার দুইটি পরিবারে ৭ জন সদস্য দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। সরকারের দরিদ্র বান্ধব বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও তা কোন কাজে আসছে না এই দুটি পরিবারের ক্ষেত্রে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসহায় দুস্থ্য দুটি পরিবারের পাশে নেই তাদের সমাজ, নেই রাষ্ট্র। ফলে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা।

অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে, শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলা সদরের ইদিলপুর ইউনিয়নের মিত্রসেনপট্রি গ্রামে একই পরিবারে তিনজন অন্ধ। এই গ্রামের মৃত ইউসুফ আলী মালের ছেলে আবুল কালাম মালের বয়স এখন ৫৮ বছর । মাত্র ৩ বছর বয়সে ভাঙ্গা ঘরের বেড়ার ফাক দিয়ে শিয়ালের কামড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। তার অন্ধ বাবা ইউসুফ আলী ছেলের চিকিৎসায় শেষ সহায় সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করেও চোখের আলো ফিরিয়ে আনতে পারেননি। ৫ বছর বয়সে সে দুটি চোখের দৃষ্টি হারায় । কালামের বয়স যখন ২৪ বছর তখন পাশের গ্রামের ফাতেমা নামে এক দরিদ্র কিশোরীকে বিয়ে করে সংসার গড়ে কালাম । ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। অন্ধ কালামের ঘর আলো করে জন্ম নেয়া প্রথম পূত্র সন্তান রাসেল মাত্র দুই বছর বয়সে বাড়ির পাশে নদীতে পড়ে চোখে বালু ঢুকে। শিশু রাসেলকে কোন চিকিৎসাই ভালো করতে পারেনি। ৪-৫ বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যায় রাসেল।

এরপর কালাম-ফাতেমা দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেয় এক কন্যা। নাম রাখা হয় শিল্পী আক্তার। দেড় বছর বয়সে তরকারীর কড়াইর উপর পরে গিয়ে এক চোখে আঘাত পায় শিল্পী। শুরু হয় হেকিম, বৈদ্য, ওঝা, কবিরাজ থেকে শুরু করে আধুনিক সব চিকিৎসা। কিন্তু কোন কিছুতেই ভালো হয় না শিল্পীর চোখ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায় দরিদ্র পরিবারের নিষ্পাপ মেয়েটির। অন্ধ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে এখন অমানিশার ঘোর অন্ধকারে দিন কাটছে ফাতেমার। উল্লেখ করার মত কোন সরকারি সহায়তা মিলছে না তাদের ভাগ্যে। কিছু দিন ভিক্ষাবৃত্তি করলেও এখন আর মানুষের কাছে হাত পাতেনা ফাতেমার সন্তানেরা। তার দিন কাটে এখন অন্ধ মা,স্বামী ও ছেলে মেয়ের অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

গোসাইরহাট উপজেলা সদরের পট্টি ব্রিজের পূর্বপাড়ে আড়িয়াল খাঁ, সাইক্যা ও জয়ন্তিয়া এই তিন নদীর মোহনায় জীর্ণ-শীর্ণ একটি দোচালা টিনের ঘরে বসবাস করে এই অন্ধ পরিবারটি। মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে করে, খেয়ে না খেয়ে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে তিল তিল করে কিছু পয়সা জমিয়ে বছর দশেক আগে এক চিলতে জমি ক্রয় করেছিল তারা। নদী ভাঙ্গনের কবলে পরে সেই ভিটে টুকুও এখন হারাতে বসেছে এই অসহায় পরিবারটি। নদী ভাংতে ভাংতে এখন ঘরের দরজায় এসে ঠেকেছে। আসন্ন বর্ষায় তাদের এই ভিটে খানি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

এদিকে জেলার ডামুড্যা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের তারাশিমুলিয়া গ্রামের আবুল বাশার বেপারী ১৯৭৪ সালে বিয়ে করেন একই উপজেলার রওশন আরা বেগমকে। তাদের ঘরে এক এক করে জন্ম নেয় তিনজন পূত্র সন্তান । বড় ছেলে মাহবুবের বয়স এখন ৩৮ বছর, মেজ ছেলে টিপুর ৩৫ আর ছোট ছেলে রুবেলের বয়স ২৮। জন্মের মাত্র ২ বছর পর থেকেই সব ক‘টি ছেলে শারীরিক প্রতিবন্দি হয়ে পরে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবারের লোকেরা অনুভব করে ওদের বুদ্ধি প্রতিবন্দি হওয়ারও লক্ষন। আর এই তিন সন্তানের অভাগী মা রওশন আরা সেও তৃতীয় পূত্র জন্ম দেয়ার তিন বছর পর থেকেই হারিয়ে ফেলে তার শরীরের শক্তি ও চোখের দৃষ্টি। সামান্য কাঠ মিস্ত্রি আবুল বাশার গত চার দশকেরও বেশী সময় ধরে এতগুলো অক্ষম মানুষের ঘানি টানতে টানতে নিজেও গত ২ বছর আগে ঘরের চাল থেকে পরে গিয়ে কোমড়ের কাছে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে এখন কর্মহীন।

এই পরিবারটির মাত্র ১০ শতাংশ জমি সমেত একটি ভিটে ছারা কোন সম্পদ নেই। দুস্থ্য অসহায়দের জন্য সরকারের অজস্র সুযোগ সুবিধা থাকলেও এদের কাছে আজো পৌছেনি কোন সহায়তা। আবুল বাশারের বাড়ি থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ইউপি চেয়ারম্যানসহ দুইজন ওয়ার্ড মেম্বারের বাড়ি। এরপরেও এই পরিবারটির ভাগ্যে জোটেনি সরকারের দরিবান্ধব কর্মসূচির সর্বশেষ প্যাকেজ ১০ কেজি মূল্যে চাউল প্রাপ্তির একটি কার্ড।

গোসাইরহাটের অন্ধ আবুল কালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, আমার ভালোভাবে কোন কিছু বুঝে ওঠার বয়স হওয়ার আগেই একজন অন্ধ মানুষের সাথে বিয়ে হয়। তখন শুনেছি আমার শশুরও অন্ধ ছিলেন। আমার কোলে পর পর দুটি সন্তান আসে। তারা চোখ মেলে ঠিকমত পৃথিবীর আলো দেখার আগেই অন্ধ হয়ে যায়। আমি আমার অন্ধ সন্তানদের নিয়ে অতি কষ্টে জীবন পার করছি। আমার বিধবা ৮০ বছর বয়সের অন্ধ মা, সেও আমার কাধের উপর। আমার দৃষ্টিহীন ছেলে রাসেল একটি ওয়ার্কশপে দৈনিক মাত্র ২০ টাকা বেতনে কাজ করে। তা দিয়ে ওর নিজের পেটে দুইটি রুটির বেশি কিছু দিতে পারেনা। আমার সন্তানেরা ভিক্ষা করতে চায়না। মেয়ে শিল্পীর নামে শুধু একটা প্রতিবন্দি কার্ড করে দেয়া হয়েছে। তাও ঠিকমত ভাতা পাওয়া যায়না। আমার ঘর নদী ভেতরে চলে এসেছে। এ বছরের বর্ষায় মনে হয় বাড়িটি টোকানো যাবেনা। আমার অন্ধ সন্তানদের নিয়ে মাথা গুজার জন্য আমি সরকারের কাছে একটু জমি ভিক্ষা চাইছি।

ডামুড্যা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের তারাশিমুলিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী পরিবারের অভিভাবক আবুল বাশার বেপারী বলেন, আমার স্ত্রী সহ তিনটি ছেলে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আমি সামান্য কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতাম। দুই বছর আগে কাজ করার সময় ঘরের চাল থেকে পরে গিয়ে আমার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে গিয়ে এখন আমিও অক্ষম হয়ে গেছি। আমার আয রোজগারের কোন রাস্তা নেই। পরিবারের এতগুলো মানুষ অসহায় মানুষ নিয়ে অনেক সমস্যায় রয়েছি। সরকারের কোন সহায়তা না পেলে আমাদের না খেয়ে মরা ছারা আর কোন গতি থাকবেনা।

ইদিলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন শিকারী বলেন, আমার পরিষদের পক্ষ থেকে অন্ধ পরিবারটিকে যতটা সম্ভব সহায়তা করা হচ্ছে। তাদের বসবাসের জন্য সরকারি জমি বন্দোবস্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।

ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আমিন উদ্দিন ঢালী বলেন, আমি নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। মিডিয়ার লোকদের কাছে ওই প্রতিবন্ধী পরিবারের খবর জেনেছি। আমি তাদের চিনিনা, এমনকি তারাও আমার কাছে কোন দিন আসেনি। আমি মেম্বারদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে তাদের সহায়তার ব্যবস্থা করবো।

শরীয়তপুর জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী পরিবার দুটি যদি সরকারের দরিদ্র বান্ধব কোন কর্মসূচির আওতায় এসে না থাকে, তাহলে অচিরেই সংশ্লিষ্ট উপজেলা কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের সকল প্রকার সরকারি সাহায্যের আওতায় আনা হবে।

শরীয়তপুরের জেলা মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, অসহায় এই পরিবার দুটিকে বিশেষ বিবেচনায় সরকারি সব রকমের ভাতা প্রদান, জমি বরাদ্দ, গৃহ নির্মানসহ পূনর্বাসন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

(কেএনআই/এসপি/এপ্রিল ০৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test