E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুর শিক্ষকদের রেজিষ্ট্রেশন বাণিজ্য, আদায় করা হচ্ছে ১০ গুন টাকা!

২০১৭ মে ০৮ ১৭:৪২:৫৩
শরীয়তপুর শিক্ষকদের রেজিষ্ট্রেশন বাণিজ্য, আদায় করা হচ্ছে ১০ গুন টাকা!

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষকদের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা এখন সবার মুখে মুখে। তারা নানা সময়ে নানা উপায়ে মাত্রাতিরিক্ত টাকা বা ফি আদায় করছেন শিক্ষার্থীদের থেকে। আগামী জেএসসি পরীক্ষার জন্য অষ্টম শ্রেনির শিক্ষার্থীদের শুরু হয়েছে রেজিষ্ট্রেশন বা নিবন্ধন। আর এ জন্য শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছে সরকার নির্ধারিত ফি‘র ১০ থেকে ১২ গুন অর্থ। আর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য নবম শ্রেনির নিবন্ধন শুরু হবে চলতি মাস থেকে। সে ক্ষেত্রেও আগাম ফি নেয়া হচ্ছে অনুরূপ হারে। এভাবে অনিয়ম করে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য নিন্দা জানিয়েছেন অভিভাবক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

গত ২০ এপ্রিল থেকে একযোগে দেশের সকল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৮ম শ্রেনির শিক্ষার্থীদের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের জন্য শুরু হয়েছে নিবন্ধন বা রেজিষ্ট্রেশন। এ জন্য সরকার ফি নির্ধারণ করেছেন মাত্র ৬০ টাকা। কিন্তু শরীয়তপুর জেলার বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শরীয়তপুর সদর উপজেলার সব ক‘টি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা আদায় করছেন ৫ শত থেকে ৭ শত টাকা পর্যন্ত। কিন্ত এর বিপরীতে শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হয়না টাকা আদায়ের কোন রশীদ বা রিসিট। ২০১৯ সনে অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের জন্য ৯ম শ্রেনির নিবন্ধন নির্দেশনা এখনো জারি না হলেও একই হারে একই সাথে টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা।

জানা গেছে গত ২০১৬ শিক্ষা বর্ষে জেএসসির নিবন্ধনের জন্য শিক্ষা বোর্ড নির্ধারণ করেছিল ৭০ টাকা। এ বছর ১০ হ্রাস করে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা। নবম শ্রেনির জন্য নিবন্ধন ফি কত টাকা হতে তা এখনো শিক্ষা বোর্ড থেকে জানানো না হলেও শিক্ষকরা আদায় করছেন ৫ শত টাকা থেকে ৭ শত টাকা। ফলে, এলাকার বেশীরভাগ দরিদ্র অভিভাবকরা শিক্ষকদের এই অনিয়মের কাছে অসহায় হয়ে পরেছেন। তারা সন্তানের শিক্ষা জীবনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এক রকম নিরুপায় হয়েই অতিরিক্ত ফি গুনতে বাধ্য হচ্ছেন।

সরেজমিন ঘুরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কোন্ বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কত টাকা করে আদায় করছে তার ভয়াবহ তথ্য। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে, শরীয়তপুর পৌরসভাধীন আঙ্গারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন অষ্টম শ্রেনির ছাত্রীদের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রেশন ফি বাবদ আদায় করেছেন ৭ শত টাকা করে। নবম শ্রেনির রেজিষ্ট্রেশন নির্দেশনা জারি করা না হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একই হারে ৭ শত টাকা করে নিয়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু মাত্র ৬০ টাকার রেজিষ্ট্রেশন ফি‘র বিপরীতে ১২ গুন বেশী টাকা নিয়ে টাকা আদায়ের কোন রশীদ বা রিসিট দেয়া হয়নি শিক্ষার্থীদের।

মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর সদর উপজেলায় ১৮টি বেসরকারি মাধ্যমিক (উচ্চ বিদ্যালয়) বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেনিতে ৩ হাজার ৪ শত ৭৭ জন ও নবম শ্রেনিতে ২ হাজার ৯ শত ৯১ জন মোট ৬ হাজার ৪ শত ৬৮ জন শিক্ষার্থী এবছর নিবন্ধিত হচ্ছে। সে অনুয়ায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮-১২ গুন বেশী টাকা আদায় করা হয়েছে । এতে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর থেকে অন্তত ২৫ লক্ষ টাকা শিক্ষকরা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কোন শিক্ষার্থীই রেহাই পায়নি শিক্ষকদের এই রেজিষ্ট্রেশন বানিজ্যের হাত থেকে।

আঙ্গারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, ডোমসার জগৎ চন্দ্র ইনষ্টিটিউিট, গঙ্গানগর আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজ এর অষ্টম ও নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী রাবেয়া আক্তার, সুপ্তি, আয়শা, সাদিয়া, টিশা, জেসিকা হোসেন লামিয়া, মো. নাঈম, রেহানা, রিয়াদ হোসেন ও শারমিন সুলতানা জানায়, সরকার কত টাকা নির্ধারণ করেছে তা তাদের জানা নেই। কিন্তু শিক্ষাকরা এ বছর অষ্টম ও নবম শ্রেনির রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য তাদের থেকে ৫ শত ও ৭ শত টাকা করে আদায় করেছেন। কিন্তু কোন রিসিট প্রদান করেননি। শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানায়, এত গুলো টাকা দিতে তাদের অভিভাবকদের অনেক কষ্ট হয়েছে।

ডোমসার কোয়ার গ্রামের অভিভাবক আব্দুল মুকিম খান বলেন, আমরা দরিদ্র মানুষ, খুব কষ্ট করে সন্তানদের লেখা পড়া করাই। শিক্ষকরা যখন যেটা দাবি করে ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে তখন সেটাই বাধ্য হয়ে পুরন করি। ৬০ টাকার রেজিস্ট্রেশন ফি ৫ শ ৭ শ টাকা শিক্ষকরা নিলে আমাদের কিছু বলার থাকেনা। কারন, সব স্কুলেই তো একই রকম। একটা বাদ দিয়ে আরেক স্কুলে নিয়ে তো পড়ানোর কোন সুযোগ নেই। তাই নিরুপায় হয়ে আমরা অরিক্তি টাকা দেই।

ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিতে সব চেয়ে বড় অনিয়মকারি আঙ্গারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দোলোয়ার হোসেন। তিনি আদায় করেছেন ৭ শত টাকা করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফি বাবদ বেশী টাকা নেয়া হয়েছে। কোন রিসিট না দেয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক দিন পরে রিসিট দেয়া হবে।

অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে ডোমসার জগৎ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট এর প্রধান শিক্ষক কবিরাজ আব্দুল খালেক বলেন, কম্পিউটারে কাজ করা, ভুলত্রুটি সংশোধন করা, শিক্ষা বোর্ডে বার বার যাতায়াত করা ও বাড়তি পরিশ্রম বাবদ কিছু অতিরিক্ত টাকা আমরা আদায় করি।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর শরীয়তপুর জেলা সভাপতি আহসান উল্লাহ ইসমাইলী বলেন, শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবী আদায়ের যৌক্তিক আন্দোলনকে আমরা নৈতিকভাবে সমর্থণ করি। কিন্তু তারা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন, তখনই সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটে। আর এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছে তিনি।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, নিবন্ধন করতে গিয়ে শিক্ষকরা অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে এ ধরনের কোন অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি। কোন অভিযোগ পেলে তা প্রমান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি এ বিষয়ে অভিভাবকদের সজাগ থাকার জন্য আহবান জানান।

(কেএনআই/এএস/মে ০৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test