E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের উন্নয়নের মাইল ফলক

২০১৭ মে ২৫ ২১:৩৭:৪৮
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের উন্নয়নের মাইল ফলক

ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি : স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের উন্নয়নের মাইল ফলক’ বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এই প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। এই সাক্ষাতকারে এলাকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিরা সুদীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশী সময় পরে অর্থাৎ ১৯৬১ সালে গৃহীত এই প্রকল্প বর্তমান সরকার আমলে এলাকাবাসীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ায় আম-জনতা সকলের মধ্যেই স্বত:স্ফূর্ত অনুভূতি কাজ করছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও নাগরিক মঞ্চ ঈশ্বরদীর সভাপতি অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে এই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়া কোন উপায় নেই। পরিবেশ ও জনগণের উপর এই প্রকল্প প্রভাব ফেলবে কিনা এই বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ্যাটোমিক বললেই মনে হয় জাপানের হিরোসিমা-নাগাসিকোর কথা। এই কারণে অসচেতন মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। আধুনিক এ্যাটোমিকের অনেক উন্নতি হয়েছে।’ এতে পরিবেশ বা জনগণের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘কতিপয় গোষ্ঠি বিদেশের প্ররোচণায় প্রথমে জনগণের মধ্যে অপপ্রচার চালানোর প্রচেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই অপপ্রচারকারীদের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কারণ রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।’

এলাকাবাসীর মধ্যে জনসচেতনতার জন্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ হতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রযোজন কিনা- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে এখনও তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহন চোখে পড়েনি। তবে, স্কুল-কলেজে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারণার জন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান প্রসংগে তিনি বলেন, এখনও প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়নি। প্রাক-প্রস্তুতিমূলক বর্তমান কর্মকান্ডে এলাকার ৫/৬ হাজার শ্রমিক ইতোমধ্যেই নিয়মিত কাজ করছে। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী ভবিষ্যতে প্রযুক্তিবিদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের এই প্রকল্পে কর্মসংস্থান হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় জনগণ কিভাবে উপকৃত হবে এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি জানান, এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুতের অব্যাহত সরবরাহ থাকলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে। এখানে ইপিজেড রয়েছে। এই প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুতের সরবরাহ শুরু হলে ইপিজেড-এর পরিধি বৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, যেহেতেু রাশিয়ানরা কাজ করছেন, অবশ্যই নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঈশ্বরদী, পাকশী ও রূপপুর এলাকায় রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো উন্নয়ন সাধিত হবে এবং রূপপুর গ্রামটি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

পাকশী রেলওয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা ইমরুল কায়েস তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, জন্মের পর হতে এই প্রকল্পের কথা শুনে আসছি। অনেক আগের এই প্রকল্পের দ্রুত নির্মাণ কাজ দেখে আজ আমরা আশ্বস্থ । যেভাবে কাজের মহাযজ্ঞ চলছে তাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রূপপুর ও পাকশীর চেহারা বদলে যাবে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই হবে বলে তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এলাকার এবং দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এলাকায় পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব প্রসংগে তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। জনগণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সরকার এই ধরণের প্রকল্প গ্রহণ করতো না বলে তিনি মনে করেন। এসময় তিনি বলেন, জনসচেতনতা তৈরীতে সরকার বা সংশ্লিষ্ঠরা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এলাকাবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, আবার কেউ ভাবছেন, এলাকায় আর থাকা যাবে না, লিক করে রেডিয়েশন বাইরে আসবে কিনা । এসব বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে সেমিনার, সভা বা কর্মশালার আয়োজন করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। এলাকাবাসীর প্রকল্পে কর্মসংস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী এই প্রকল্পে কর্মস্থানে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

এই এলাকার পাবনা জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য সাইফুল আলম বাবু মন্ডল বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ভীষণ ২০-২১ এবং ৪০-৪১ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই দেশের বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রধিকার ভিত্তিতে উন্নত করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুতের বিকল্প নেই বলে তিনি জানান। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ‘উন্নয়নের মাইল ফলক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস প্রকল্পের কাজ যথাসময়েই শেষ হবে। স্থানীয় জনমনে বিভ্রান্তি, সংশয় এবং ভয়ভীতির প্রসংগে তিনি বলেন, এলাকাবাসীর মনে ভয়ভীতি বা কোন আশংকা থাকলে অবশ্যই এতাদিনে জনগণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো। এসময় তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে ড. এম এ ওয়াজেদ মিঞা পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন রূপপুর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে এলে স্থানীয় জনগণ তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী জানায়। সেসময় তিনি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বলে জনগণকে আশ্বস্থও করেছিলেন। প্রকল্পে এলাকাবাসীর কর্মসংস্থান প্রসংগে তিনি জানান প্রকল্পের পরিচালক ড. সৌকত আকবর স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের বিষয়টি ইতোমধেই নিশ্চিত করেছেন।

তিনি আরো জানান, এই প্রকল্পের জন্য প্রথম ১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সেসময় প্রকল্প এলাকার বাসিন্দাদের অন্যত্র জায়গা-জমি দেয়া হলেও দালিলিক ভাবে জমি হস্তান্তরিত হয় না। সুদীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশী সময় পর এই প্রকল্পের চুক্তির সম্পাদনের পরই ওইসব জমি প্রকল্পের পক্ষে স্ব-উদ্যোগী হয়ে প্রকল্পের নিজ খরচে ভূক্তভোগীদের দলিল সম্পাদন করে হস্তান্তর করা হয়। এজন্য তিনি ভূমি মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ড.ইয়াফেস ওসমান এবং প্রকল্প পরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জনসচেতনা তৈরীতে তিনি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের লোকজনদের নিয়ে সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন সচেতনামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়েজন বলে মনে করেন। পরিবেশ ও ও ্জনগণের উপর বিরূপ প্রভাব প্রসংগে তিনি বলেন, রাশিয়া আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরম বন্ধু। এই বন্ধু আবারো বাংলাদেশের উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে। যেকারণে অত্যাধুনিক রাশিয়ার ৫ স্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী বিশিষ্ট এই প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত এই প্রকল্পে রেডিয়েশন লিক করে কোন দুর্ঘটনা ঘটার একেবারেই সম্ভাবনা নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।

পকাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামূল হক বিশ্বাস বলেন, মিত্র দেশ রাশিয়া যেভাবে নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে এবং দেশের মানুষ সুফল ভোগ করবে। এই প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই বলে তিনি জানান। তবে এলাকার মানুষের জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচীর আয়োজন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আগেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এমন নজির আর কোন প্রকল্পে নেই।


এলাকাবাসীরা নিজের স্বার্থের চেয়ে স্বপ্ন পূরণের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বলে তিনি জানান। ক্ষতিপূরণ প্রসংগে এসময় তিনি বলেন, নতুন অধিগ্রহণকৃত চর এলাকার ৮০০ একর জমিতে যারা চাষাবাদ করতো তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া হলেও এখনও কোন ক্ষতিপূরণ তারা পায়নি। এছাড়া জনসাধারণের নিজস্ব আরো ১৯ একর জমির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এসব জমিতে ইতোমধ্যেই প্রকল্পের ৭০ ভাগ কাজ সম্পাদন হয়েছে বলে তিনি জানান। অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য তিনি দাবী জানিয়েছেন।

এলাকার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও রূপপুর হাই স্কুলের শিক্ষক মাসুদ রানা বলেন, আমি এই প্রকল্পে নেগেটিভ কিছু দেখছি না। রূপপুরের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে আমরা রূপপুরবাসী এখন স্বপ্নে বিভোর। ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনার হাতছানি দেখতে পাচ্ছি। এসময় তিনি পরম শ্রদ্ধাভরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং প্রয়াত দেশের খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিঞাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। পরিবেশ ও জনগণের উপর প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, জনসচেতনা তৈরীর জন্য আমি ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পের উপর গান রচনা করেছি। যা প্রকল্পের বিগত পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়েছে। সহােযগিতা পেলে এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে জনসচেতনা তৈরীর কাজে নিজেকে নিবেদিত করার দৃঢ় প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেছেন।

(এসকেকে/এএস/মে ২৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test