E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে পদ্মার আগাম ভাঙ্গন শুরু

২০১৭ জুলাই ০৮ ১৮:৪০:১৫
শরীয়তপুরে পদ্মার আগাম ভাঙ্গন শুরু

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উজেলার বিস্তীর্ন এলাকা জুরে শুরু হয়েছে পদ্মার আগাম ভাঙ্গন। নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে বাঁচতে চার দিকে লাল নিশানা টাঙিয়ে এলাকাবাসীদের নিরাপদে সড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন। ইতমধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য ঘর বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে রাক্ষুসী পদ্মার এই আগাম ভাঙ্গনে। পািন উন্নয়ন বোর্ড বলছেন, নদীর গতি পথ পরিবর্তনের কারনে পদ্মা নদীর ডান তীরে শরীয়তপুর অংশে ভাঙ্গন আরো তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে ব্রাক এবং পরিবেশ ও ভূগোল বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও সরকারকে এই বলে সতর্ক করেছেন যে, শরীয়তপুরের দুই উপজেলায় পদ্মা পাড়ের সাড়ে ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘের এলাকায় ভাঙ্গন অব্যাহত থাকবে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে স্থানভেদে ২০০ মিটার থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত ভেতরের দিকে ভাঙ্গার আশংকা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

একটি জরিপে জানা গেছে, গত ১০-১২ বছরে পদ্মার রাক্ষুসী ছোবলে বিলীন হয়েছে পদ্মার ডান তীরে অবস্থিত শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের ৭৪ টি গ্রাম। অন্তত ৮ হাজার একর ফসলী জমি, ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য মসজিদ, পাকা-কাচাঁ ১ শত ৬০ কিলো মিটার সড়ক, ১৪ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইনও ভেঙ্গে নিয়ে গেছে সর্বনাশা পদ্মা নদী। দীর্ঘ এক যুগের ধারাবাহিক ভাঙ্গনে অন্তত ৬২ হাজার পরিবার হারিয়েছে তাদের বাস্তুভিটা, সহায়-সম্বল সব কিছু। এদের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার পরিবারের অন্তত সোয়া দুই লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ঠাঁই নিয়েছে অন্যের জমি, ঢাকা সহ বিভিন্ন মেগা শহরের বস্তি ও দেশের বিভিন্ন এলাকায়। যাদের আর কোন দিনও ফিরে আসা সম্ভব হবে না নিজের পৈত্রিক ভিটায়।

গত বছর জুলাই মাসের শেষ ভাগ থেকে শুরু হয়েছিল শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে বিগত ১ শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতম নদী ভাঙ্গন। টানা তিন মাসের ভাঙ্গনে জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার কুন্ডেরচর ও মোক্তারেরচর ইউনিয়নের ৮ গ্রাম, ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি প্রাচীন বাজার, অন্তত ১৫টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি, পাকা সড়ক, বৈদ্যুতি লাইন সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে বিলীন হয়। এতে অন্তত দেড় হাজার পরিবার তাদের সহায় সম্বল হারিয়েছিল। গত বছরের রেষ কাটিয়ে না উঠতে আর বছর না ঘুরতেই এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আবার শুরু হয়েছে ভাঙ্গন। গত ৮ জুন থেকে জাজিরার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের বেপারী কান্দি ও নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে একসাথে শুরু হয়েছে এই ভাঙ্গন। ইতিমধ্যে কুন্ডেরচর ইয়াকুব বেপারী কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার আশংকায় নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে সরকার। এতে প্রায় ৪ শত শিশুর শিক্ষা গ্রহন অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঈশ্বরকাঠি মাদবর কান্দি জামে মসজিদ। যে কোন মুহুর্তে বিলীন হবে কুন্ডেরচর হাশেম মাদবর কান্দি জামে মসজিদটি। হুমকিতে রয়েছে কুন্ডেরচর কাইউম খার বাজার ও কালু বেপারী উচ্চ বিদ্যালয়টি।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের গবেষনা প্রতিষ্ঠান সি.ই.জি.আই.এস (সেন্টার ফর এনভায়ারমেন্টাল জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস) ও ব্রাক সম্প্রতি যৌথভাবে পদ্মার ডান তীরে একটি জরিপ পরিচালনা করেন। তারা ১৯৯২ সন থেকে পুরনো স্যাটেলাইট ইমেজ এর বিশ্লেষন, ভূমির গঠন ও নদীর স্রোতের গতি নিয়ে ব্যাপক গবেষনা কাজ পরিচালনা করেন। এ থেকে তারা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নদীর উত্তর পাড় বা বাম তীরে এবং পদ্মার মাঝ বরাবর অসংখ্য চর পরার কারনে এবং অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে ব্যাপক মাত্রায় বালু উত্তোলনের কারনে নদীর গতি ইউ টার্ন নিয়ে নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীর বাম তীর থেকে প্রবাহমান পানির স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে ডান তীরে গিয়ে আঘাত হানছে। এ কারনে নদী ভাঙ্গন তীব্রতর হচ্ছে।

এ বিষয়ে সি.ই.জি.আই.এস এর সমাজ বিজ্ঞানী মো. মনিরুল ইসলাম মানিক এবং ব্রাক এর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি বিষয়ক সিনিয়র সেক্টর বিশেষজ্ঞ মো. জাফর ইকবাল বলেন, জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার কিছু অংশে যে আগাম ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। এর পর বর্ষার পানি আবার যখন কমতে শুরু করবে তখন অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্তও ভাঙ্গন অব্যাহত থাকতে পারে। তারা জানিয়েছেন, এবছর ৮ শত ৮৮ হেক্টর ফসলি জমি ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে এবং কমপক্ষে ৭ শত ৫০ টি পরিবারের বসত বাড়ি বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা গেছে, ১৮৩০ সালে ভারতের আসাম রাজ্যে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে বাংলদেশে পদ্মা নদীর গতি পথ পরিবর্তন হয়েছিল। তখন গোয়ালন্দ থেকে শুরু করে শিবচর-মাওয়া-জাজিরা হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার গতিপথে আমুল পরিবর্তন আসে। প্রায় ২০০ বছর আবার মানব সৃষ্ট দুর্যোগের কারনে পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তণ হতে শুরু করেছে। এতে মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য জানিয়েছেন, পদ্মার বাম তীর অর্থাৎ মুন্সিগঞ্জ অংশে চর পরে নদীর গতি পরবির্তন হয়ে গেছে। এ কারনে, ডান তীর অর্থাৎ দক্ষিন তীরে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া অংশে অব্যাহত গতিতে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। নদী রক্ষার জন্য একটি ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল) প্রনয়ন করা হয়েছে। এটি সরকার অনুমোদন দিলে পদ্মার ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হবে।

শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মাহবুবা আক্তার বলেন, এ বছর আগাম নদী ভাঙ্গন শুরু হওয়ায় এলাকাবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে একটি নির্ধারিত এলাকা জুরে আমরা লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে ওই এলাকা থেকে তাদের ঘর বাড়ি ও স্থাপনা নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে সড়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রান সহায়তা মজুদ রয়েছে। তালিকা প্রস্তুত করে তা বিতরণ করা হচ্ছে।

শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য বি, এম মোজাম্মেল হক বলেছেন, পদ্মা একটি খরস্রোতা নদী। এই নদীর ভাঙ্গন কোন পাথর, ব্লক বা বালুর বস্তা দিয়ে রোধ করা সম্ভব না। এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মাওয়া থেকে চাঁদপুরের মেঘনা পর্যন্ত নদী খনন করে, নদীর গতি পরিবর্তন করে অন্তত ৬ শত কোটি টাকা ব্যয়ে ভাঙ্গন রোধ করা হবে। প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার পর চলতি অর্থ বছরেই এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হতে পারে।

(কেএনআই/এএস/জুলাই ০৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test