E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৪৬ বছর পর বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পেল জামালপুরের ৫ সাহসী নারী

২০১৭ আগস্ট ০৭ ২২:০৫:৪৬
৪৬ বছর পর বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পেল জামালপুরের ৫ সাহসী নারী

রাজন্য রুহাানি, জামালপুর : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রেকি করে পাক বাহিনীর অবস্থানের সংবাদ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিত জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ৫ নারী। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে গিয়ে পাক বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে নির্যাতন ও সম্ভ্রম হারানোর শিকার ওই ৫ সাহসী নারী ৪৬ বছর পর অবশেষে  বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পেল।

বীরঙ্গনার স্বীকৃতি প্রাপ্তরা হলেন, ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচর গ্রামের মাহফুজুল হকের স্ত্রী সামছুন্নাহার বেগম, একই গ্রামের মো. ভোলা শেখের স্ত্রী মোছা. রংমালা খাতুন, কুলকান্দি ইউনিয়নের কুলকান্দি গ্রামের মৃত আঃ সামাদ খানের স্ত্রী ছকিনা বেগম, আঃ রহিমের মেয়ে শেফালী বেগম ও জসিজলের স্ত্রী রাবেয়া বেগম।

বীরঙ্গনা ও তাদের পরিবারের চোখেমুখে দেরিতে হলেও স্বীকৃতি পাওয়ায় তৃপ্তির কান্না। যমুনাপাড়ে ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নে তিনজন বীরাঙ্গনার খোঁজে গিয়ে সেখানে পাওয়া যায়নি। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে মাথা গুজার ঠাঁই করে নিয়েছে পাশের পার্থশী ইউনিয়নের শাশারিয়া খানপাড়া গ্রামে। সেখানে দেখা হয় রাবেয়া বেগম, ছকিনা বেগম ও শেফালী বেগমের সাথে। বয়সের ভারে ৩ জনই ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। সমাজের তিরস্কার, জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে আজো বেঁচে আছেন কোনোমতে। দারিদ্র্যতা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। দিন কাটছে তাঁদের অর্ধাহারে, অনাহারে কিংবা উপোস অবস্থায়।

ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচর গ্রামের বীরঙ্গনা সামছুন্নাহার বলেন, যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেওয়ার সময় আল বদরেরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। এ সময় আমাকে ঝগড়ারচর ক্যাম্পে নিয়ে আটকিয়ে রাখে এবং অমানুষিক নির্যাতন চালায়। যখন আমি মৃত্যুশয্যায়, ঠিক সেই সময় আমাকে ছেড়ে দেয়। তার কয়েকদিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়।

একই গ্রামের রংমালা খাতুন বলেন, যুদ্ধের কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়। নববধু অবস্থায় পাক বাহিনীরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় ঢাকার কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পে। সেখানে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এক সময় কৌশলে আমি পালিয়ে আসি।

বীরাঙ্গনা শেফালী বেগম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বিয়ের কথা চলছিল। এ সময় বদরদের সহযোগিতায় হঠাৎ বাড়িতে পাকবাহিনীরা এসে আমার বাবা নুরু খানকে বেধেঁ নিয়ে যান। এ সময় অন্যরা আমাকে আমার বাড়িতেই শারিরীক নির্যাতন করে।

একই অবস্থা রাবেয়ার। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, নিজ বাড়িতেই আমাকে আটকিয়ে রেখে দিনের পর দিনে আলবদর, রাজাকাররা আমার প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার বিয়ে হয়। সেই দিনের দু:সহ স্মৃতি নিয়ে আজো বেচেঁ আছি।

ছখিনা বেগমের পরিবারিক সুত্র জানায়, ছখিনা এলাকায় নেই। লোকলজ্জার ভয়ে পরিচয় গোপন করে টাঙ্গাইলে বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করছে। যুদ্ধ চলাকালে বর্তমান কুলকান্দি শহীদ স্বৃতি স্কুল মাঠে একদিনে এলাকার ১১জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। তার মধ্যে ছখিনার স্বামী সামাদ খানও ছিলেন। সামাদ খানকে হানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে যাওয়ার দিন ছখিনা বেগম ৪০ দিন আগে সন্তান প্রসব করেছেন। এ অবস্থাতেও তাকে নির্যাতন থেকে রেহায় দেয়নি রাজাকার আলসামসরা। নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানীর মুখে ছখিনার কানে খবর পৌঁছে তার স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ। তার পরিবারের লোকজন আরো বলেন, সামাদ খানকে আজো কোন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি।

ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম আহসানুল মামুন জানান, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৫ জুন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে ৪৪ তম সভার সিদ্ধান্তক্রমে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এখনো সরকারি প্রজ্ঞাপন আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি। পৌঁছলে এই ৫ বীর সেনানী সাহসী নারীকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স¤¦র্ধনা ও বরণ করে নেয়া হবে।

ইউপি সদস্য তাহের খান জানান, আমাদের এখানে শহীদ স্মৃতি স্কুলে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এসব এলাকার রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতায় বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে নারীদের নির্যাতন ও পুরুষদের স্কুলে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলেছে। অনেকেই আজো কোনো স্বীকৃতি পায়নি। তাদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন তিনি।

চরপুটিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সুরুজ মাষ্টার জানান, সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। সকল ব্যবস্থা যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয়। শেষ বয়সে যাতে একটু শান্তিতে থাকতে পারেন তাঁরা।

ইসলামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানিকুল ইসলাম জানান, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক সরকার। পাচঁ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি তার প্রমাণ। তাদের ত্যাগ বৃথা যায়নি। শেষ বয়সে তারা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রেখে দ্রুত সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আহবান জানান তিনি।

স্থানীয় এমপি আলহাজ্ব ফরিদুল হক খান দুলাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ১৫ জনকে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার মধ্যে ইসলামপুরের ৫ জন। তারা আমাদের গর্বিত জননী। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ইসলামপুরবাসীর পক্ষ থেকে দ্রুত তাঁদের সন্মাননা জানানো হবে।

(আরআর/এএস/আগস্ট ০৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test