E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উদ্ধারের পরদিন যৌনপল্লীতেই ফিরে গেলো অপহৃত কিশোরী

২০১৭ আগস্ট ১৪ ১৮:২৭:০০
উদ্ধারের পরদিন যৌনপল্লীতেই ফিরে গেলো অপহৃত কিশোরী

আহম্মদ ফিরোজ, ফরিদপুর : ফরিদপুরে র‌্যাবের বিশেষ অভিযানে সম্প্রতি উদ্ধার হয় তিন কিশোরী। আটক হয় মানব পাচার চক্রের দুই সদস্য। এরপর তাদের থানায় হস্তান্তর করলে অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়। কিন্তু পুলিশের নিকট থেকে অপহৃত কিশোরী মুক্ত হয়ে আবার সেই অপরহণকারীদের ডেরাতেই ফিরে গেছে সুমিতা রাণী সরকার (১৭) নামে অপহৃত এক কিশোরী। বর্তমানে সুমিতাকে দিয়ে আবারও যথারীতি অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অপহরণকারী চক্র। ফলে র‌্যাব-পুলিশের অপহৃত কিশোরী উদ্ধারে র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতা রহস্যময় নাটকে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে, এখনও সেখানে আটক কয়েকশ’ কিশারীর মুক্ত হওয়ার স্বপ্নও এই ঘটনার পর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

উদ্ধার হওয়া সুমিতার বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার তুলশীপুর গ্রামে। পিতার নাম মৃত গোপাল সরকার। খুব ছোটবেলায় সে মা-বাবাকে হারিয়ে ভাইয়ের কাছে থাকতো। সেখান থেকে চাকরীর প্রলোভনে ফরিদপুরে এনে ৩০ হাজার টাকায় তাকে রথখোলা পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হয়।

র‌্যাব-৮, সিপিসি-২ ফরিদপুর ক্যাম্প এর কোম্পানী অধিনায়ক (ভারপ্রাপ্ত) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রইছ উদ্দিন এর নেতৃত্বে গত ৮ আগষ্ট শহরের রথখোলা যৌনপল্লী থেকে পুলিশ অপহৃত ওই তিন কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে সুমিতা ছাড়া অন্য দু’জন হলো রুমা ও খুকু মনি নামে দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী।

সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদে সুমিতা জানায়, খুব ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার পর আর পড়াশোনা হয়নি তার। এরপর সে তার ভাইয়ের সাথে ঢাকায় এসে ফার্মগেট এলাকায় থাকতো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর ফার্মগেট এলাকা থেকে তাকে চাকরীর প্রলোভনে ফরিদপুরে নিয়ে আসে এক অজ্ঞাতনামা নারী। এরপর তাকে লিজা (৪০) নামে এক নারীর দালালের কাছে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। লিজা রথখোলা যৌনপল্লীতে এক নারী সর্দারণীর হয়ে কাজ করতো।

প্রাপ্ত কাগজপত্রে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জনৈক মোখলেসুর রহমান নামে জনৈক নোটারী পাবলিকের সহায়তায় ১৩ বছরের সুমিতাকে ২০ বছর বয়স দেখিয়ে একটি হলফনামার (নং- ২৭৭, তারিখ-০৯/০২/২০১৪) মাধ্যমে পতিতাবৃত্তির একটি আইনী সনদ বের করা হয়। তৎকালীন টিএসআই (টাউন সাব-ইন্সপেক্টর) তপন প্রত্যক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সুমিতার শারিরীক সক্ষমতা ও হলফনামার সত্যতা নিশ্চিত করে। এর পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয় মোটা অংকের টাকা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।

মামলা সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনার প্রায় চার বছর পর সুমিতা গোপনে র‌্যাব-৮কে মোবাইলে তাকে আটকে রেখে পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত করার বিষয়টি জানায়। এরপর গত ৮ আগষ্ট সেখানে অভিযান চালিয়ে সুমিতাসহ রুমা ও খুকু মনি নামে আরো দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। আর তাদেও একাজে লিপ্ত করায় লিজা ও নারায়ণ নামে দু’নজকে আটক করা হয়।

এরপর আটককৃত দুইজন সহ উদ্ধার হওয়া কিশোরীদের কোতয়ালী থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। কোতয়ালী থানায় ওই রাতেই সুমিতাকে বাদি করে লিজা ও নারায়ণকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। লিজা গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শিবপুর গ্রামের জনৈক মোতাহার হোসেনের মেয়ে। মানব পাচারকারীদের নিকট থেকে কিশোরীদের মোটা অংকের টাকায় কিনে রথখোলা পতিতাপল্লীর রিজিয়া বেগম নামে এক নারীর বাড়িতে রেখে সে তাদের দিয়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিকে বাধ্য করাতো। আর রিজিয়া বেগমের বাড়ির দেখভাল করতো মৃত মুকুন্দ লাল চক্রবর্তীর ছেলে নারায়ণ চক্রবর্তী ৫৫)।

সুমিতাকে বাদি করে লিজা ও নারায়ণকে আসামী করে মামলা দায়েরের পর রুমা ও খুকুমনিকে সেফহোমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর থানা থেকে বিনা বাধায় বেরিয়ে এলে সুমিতাকে আবারও রথখোলা যৌনপল্লীতে নিয়ে আসে মানবপাচারকারী এই চক্র।

উদ্ধার হওয়া রুমার বাড়ি দলপুর যাত্রাবাড়ি। পিতার নাম সরাফত আলী। নোটারী পাবলিক দিয়ে তার নামে ২০০৪ নং- হলফনামাটি করা হয় ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই। ওই হলফনামায় রুমার বয়স দেখানো হয় ২৩ বছর। আর একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারী তৈরি করা ৩৫৪ নং- হলফনামায় খুকুমনির বয়স দেখানো হয় ১৯ বছর। খুকুমনির বাড়ি ভোলা জেলার পৌর নবীপুর। পিতার নাম কাশেম।

মিথ্যা হলফনামা তৈরির পর কোতয়ালী থানার তৎকালীন টিএসআইকে দিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদেও শারিরীক সক্ষমতা ও হলফনামার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে সাংবাদিকদেও নিকট সুমিতা জানায়, থানা থেকে বের হলে তাকে আবারও যৌনপল্লীতে নিয়ে আসা হয়। আটক লিজাকে সে আম্মা বলে সম্মোধন করে।

এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, রথখোলা যৌনপল্লীর ওই বাড়ির মালিক রিজিয়া বেগম বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছে। তার বাড়িটির দেখভাল করে নারায়ণ। আর সেখানে অবস্থানরত মেয়েদের নিরাপত্তা ও থানাপুলিশ তদারকী করে রিজিয়া বেগমের মেয়ে ফুরফুরী ওরফে রোজিনা বেগম (৪০)। এই ফুরফুরী বেগম রথখোলা পতিতাপল্লীর সবচেয়ে প্রভাবশালী সর্দারণী। তাকে সহায়তা করে তারই ছোটবোন ববি (৩৫)। ববি শহরের গোয়ালচামট খোদাবক্স রোডের জনৈক ইলিয়াস শেখের স্ত্রী বলে জানায়।

ববি জানায়, ফরিদপুর রথখোলা পতিতাপল্লীতে প্রায় ৯শ’ মেয়ে রয়েছে। তার দাবি, পুলিশ টাকা খেলেও প্রায়ই ঝামেলা করে। হলফনামা করা মেয়েদের নিয়ে যেনো পুলিশ ঝামেলা না কওে সেজন্য সে আদালতের মাধ্যমে এই হলফনামা করার অনুরোধ জানায়।

নির্ভরযোগ্য অপর একটি সূত্র জানায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের নানা প্রলোভনে ধরে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। মাঝেমধ্যে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে দু’চারজনকে উদ্ধার ও জড়িতদেও আটক করা হলেও মোটা অংকের টাকা পয়সা খরচ করে তারা আবার সদর্পে ফিরে আসে। এখনও কয়েকশ’ অপ্রাপ্তকিশোরী মেয়েকে সেখানে আটকে রেখে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিছু এনজিও ও সমিতি সেখানে কাজ করলেও তাদের মূল ধান্দা থাকে দৈনিক চাঁদা তোলার প্রতি। এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে আটক মেয়েদের উদ্ধার ও ধরাছোয়ার বাইরে থাকা নারী পাচারকারীদের গ্রেফতারের জোর দাবি জানিয়েছেন।

(এফএ/এএস/আগস্ট ১৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test