E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জামালপুরে ১৩৩ সে.মি. উপর দিয়ে বইছে যমুনার পানি

২০১৭ আগস্ট ১৫ ২১:৫২:৩৪
জামালপুরে ১৩৩ সে.মি. উপর দিয়ে বইছে যমুনার পানি

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি। ভাঙনের কবল থেকে বাঁচতে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দ্বিগবিদিক ছুটাছুটি করছে যমুনাপাড়ের লোকজন। পরিবার পরিজন, গরু-ছাগল ও জিনিসপত্র নিয়ে ঘরাড়ি ফেলে এখন কেবল আশ্রয়ের সন্ধানে বানভাসী মানুষেরা।

যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। পানির তোড়ে মাদারগঞ্জের চাঁদপুরে নাংলা-চাঁদপুর বাধেঁর ১ মিটার ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। হু হু করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় দ্রুত বাড়ছে বন্যা কবলিতের সংখ্যা। মেলান্দহের দুরমুঠসহ বিভিন্নস্থানে রেললইনের উপরদিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ লাইনে রেলচলাচল বন্ধ ঘোষনা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবারের জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যমুনার পানি বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, আগামী ২/৩দিন যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে।

অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৬ উপজেলায় ৩ লাখ মানুষ। জেলার ৬ উপজেলায় অন্তত: ৪শ’ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে গেছে। এসব সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলার সদরের সাথে ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়কে নৌকা চলাচলের মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রেখেছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্যা কবলিত এলাকায় চারিদিকে প্রবল বেগে পানির স্রোতে থাকায় এবার ঘরে থাকতে পারছেনা পানিবন্দি মানুষেরা। পানির ধাক্কায় বহু ঘরবাড়ী ভেসে গেছে। অবশিষ্ট বাড়ী-ঘরও ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। ঘরে কোথাও কোমর আবার কোথাও গলা সমেত পানি। ঘরের ভিতর মাঁচা করে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেও কাজে আসছেনা তীব্র পানির স্রোত থাকায়। অনেকেই আটকে পড়ে টিনের চালে অবস্থান করছে। এসব আটকে পড়া পানিবন্দি মানুষগুলোকে উদ্ধার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দ্রুত উদ্ধার করা না গেলে জামালপুরেও ঘটে যেতে পারে বন্যায় দিনাজপুর ট্রেজেডির পুনরাবৃত্তি। এ ব্যপারে জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির বলেন, প্রয়োজন হলে উদ্ধারে সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা প্রস্তুত রয়েছি বলে জানান তিনি।

ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের পুর্ব বলিয়াদহ গ্রামের ৬০ বছর বয়সি সুরুজ মিয়া জানান, পানির ধাক্কায় ঘরে বছরের মজুদ রাখা বেড়ের ধান,আলো পিয়াজসহ সবজি ভাইসা গেছে। হেই সাথে ভাইসা গেছে ১০টি মুরগী। ঘরটিও ভাইঙ্গা যাওয়ার অবস্থা। ভয়ে পরিবার পরিজনসহ গরু-ছাগল নিয়ে নৌকা যোগে তীরে উঠেছি। দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি। কোথায় আশ্রয় নিব জানিনা।

রাস্তার ধারে সবাইকে নিয়ে বসে আছি। আজ খোলা আকাশের নিচে রাইত কাটাইতে ওইবো। একই গ্রামের দুলাল উদ্দিন(৪৫), রাশেদ মিয়া(৩০),রশিদ শেখ(৫৫), হবিবর মিয়া,পশ্চিম বলিয়াদহের উরফুল বেগম ও শিংভাঙ্গা গ্রামের নুর ইসলামের কোমর ও গলা সমেত পানি উঠায় রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছে। বলিয়াদহের নৌকাঘাটে নৌকা থেকে নেমে চিনাডুলি গ্রামের ফজলুল কাদের(৪০) স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে নিয়ে টুপলা-টাপলি নিয়ে ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। সেখানে কথা হয় বানভাসী এ মানুষটির সাথে। তিনি বলেন, অন্যন্য বারের তুলনায় এবারের বন্যার পানির চাপ বেশী তাই টিকতে পারলাম না। ঘরবাড়ী ফেলে প্রান বাঁচাতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি দেওয়ানগঞ্জে বোনের বাড়িতে।

বন্যা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়। ইসলামপুর উপজেলা সদর, পৌর এলাকা, নোয়ারপাড়া, চিনাডুলী, বেলগাছা, পাথর্শী, সাপধরি ও কুলকান্দি এবং দেওয়ানগঞ্জ সদর উপজেলা, পৌর এলাকা বাহাদুরাবাদ, চুকাইবাড়ি, ডাংধরা ও চিকাজানী, মেলান্দহের মাহমুদপুর,কুলিয়া,ঝাউগড়াসহ বেশকটি ইউনিয়ন, মাদারগঞ্জ উপজেলার ৭ ইউনিয়ন ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩ ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। দেওয়ানগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়সহ অফিস আদালত রেল ষ্টেশন এলাকা ও বেলতলী বাজার হাটু পানির নিচে। সড়কগুলো দিয়ে রিকসাসহ যানবহনের বদলে চলছে নৌকা আর কলার ভেলা। বাজার গুলো ডুবে যাওয়ায় লোকজন হাঁটুপানি ভেঙে দুরের বাজার থেকে সদাই কেনাসহ প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করছে বানভাসীরা। একদিকে পরিবার পরিজন নিয়ে বন্যার কবল থেকে বাচাঁর লড়াই অন্যদিকে গৃহস্থলের পশু গরু-ছাগল নিয়ে পড়েছে বিপাকে। পরিবার পরিজনের মুখে খাবার তুলে দেয়াতো দুরের কথা গো-খাদ্যের সংকটের মুখে অসহায় হয়ে পড়েছে দুর্গতরা।

মেলান্দহের দুরমুঠ ষ্টেশনের অদুরে রেল লাইনের উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষনা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। জামালপুর রেলওয়ে জংশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার দেলোয়ার হোসেন জানান, সোমবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলীর নির্দেশে জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দেওয়ানগঞ্জগামী আন্ত:নগর তিস্তা,ব্রহ্মপুত্রসহ সকল মেইল ও লোকাল ট্রেন জামালপুর ষ্টেশনে অবস্থান এবং জামালপুর থেকেই ছেড়ে যাবে।

ত্রাণ সংকট পুরো বন্যা কবলিত এলাকাজুড়ে। ত্রানের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসীদের মাঝে। দুর্গতদের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্ধকৃত ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় যৎ সামান্য। এই নিয়ে মুখ খুলেন ইসলামপুরের পার্থশী ইউনিয়নের চেয়ারমান ইফতেখার আলম। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্ধ খুবই কম। এত অল্প ত্রাণ দিয়ে ব্যাপক দুর্গত মানুষের চাহিদা মেটানো অসম্ভব। আমার ইউনিয়নের ভাগে কতটুকু পড়েছে। ইউনিয়নের সকল লোকই পানিবন্দি। এত অল্প ত্রাণ দিয়ে পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমশিমে পড়ে যায়। কপালেজুটে দুর্গতদের গালাগালি আর মেরে দেওয়ার অপবাদ। জেলা প্রশাসনের প্রতি ত্রাণের বরাদ্ধ বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাসেল সাবরিন বলেন, ভয়ের কোন কারণ নেই। প্রচুর পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। ত্রাণের বরাদ্ধ চাহিদা মোতাবেক বাড়ানো হবে।

(আরআর/এএস/আগস্ট ১৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test