E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গ্রেনেড হামলা: ইঙ্গিতে আ.লীগকেই দোষারোপ ফখরুলের

২০১৮ আগস্ট ২৭ ১৭:২৮:৩৯
গ্রেনেড হামলা: ইঙ্গিতে আ.লীগকেই দোষারোপ ফখরুলের

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলার জন্য আকার ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রায় ১৪ বছর পর এই মামলার রায় ঘোষণা যখন সময়ের অপেক্ষা, তখন দলের পক্ষ থেকে সোমবার করা এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব এই হামলা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলেন।

তবে এই সংবাদ সম্মেলনে ফখরুলকে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি।

ফখরুলের মোট ১০টি বিষয়ের অবতারণা করে প্র্রমাণের চেষ্টা করেন তার সরকার বা তারেক রহমান এই ঘটনায় জড়িত ছিল না।

তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে করা প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত এবং বিচারিক তদন্ত নিয়ে একটি কথাও বলেননি ফখরুল। নিরীহ জজ মিয়াকে ফাঁসাতে ওই সরকারের চেষ্টা, আলামত নষ্ট, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়ে এসে তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ এবং তাদের বিরক্তি প্রকাশ করে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গেও কিছুই বলেননি বিএনপি নেতা।

ফখরুল প্রথম যে প্রশ্নটির অবতারণা করেন, সেটা হলো আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল মুক্তাঙ্গাণে। কিন্তু সেটা কেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সরিয়ে নেয়া হলো। এটাকেই সন্দেহজনক হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।

হামলার ১৪তম বার্ষিকীতে গত ২১ আগস্ট এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের যখন অনুমতি মিলছিল না, তখন তারা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশের জন্য মাইকিং ও পোস্টারিং করেন। কিন্তু আগের রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে অনুমতি দিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু এত রাতে আওয়ামী লীগ কাজ করে না, ওই চিঠি খুলেনি কেউ।

২২ জন নিহত এবং কয়েক শ মানুষ আহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে থাকা পুলিশ সদস্যরা বিস্ময়করভাবে সেদিন লাঠিপেটা করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর, ছোড়া হয়েছে কাঁদানে গ্যাস। আবার আহতদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসা হয়নি, কারণ বিএনপিপন্থী চিকিৎসকরা সবাই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কাউকে নিতেই দেয়া হয়নি।

হামলার পর শেখ হাসিনার বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধার মুখে তিনি যেতে পারেননি। এরপর থেকে বিএনপির সুর পাল্টে যায়।

হামলার পরে মুক্তাঙ্গনে বিএনপির সমাবেশে নেতারা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নিজেই এই হামলা চালিয়েছে জনগণের দৃষ্টি ও সহানুভূতি আদায়ের জন্য। সংসদে বিএনপির নেতারা এমনও বলেন, শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।

হামলার পর আলামত সংগ্রহ না করে তা নষ্ট করে দেয়া হয়। আর জজ মিয়া নামে এক হকারকে এই হামলার মূল হোতা সাজানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জানা যায়, নোয়াখালীতে জজ মিয়ার পরিবারকে নিয়মিত মাসোহারা পাঠাত পুলিশ। আর তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।

আবার বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দেশ ছাড়তে সহায়তা করে বলেও প্রমাণ মেলে ওই সময়।

সে সময় একটি বিচারিক তদন্ত হয়েছিল, যার প্রতিবেদন পরে হাস্যরস সৃষ্টি করে। এতে দাবি করা হয়, প্রতিবেশী একটি দেশে এই হামলার ছক কষা হয় আর হামলাকারীরা একটি লোহার খাঁচা বানিয়ে সেখানে গ্রেনেড ছুড়ে অনুশীলনও করে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের এসব তদন্ত অসাড় প্রমাণ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আর সে সময় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনের বিচার শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার তদন্তে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

হামলার ১৪ বছর পর মামলাটির শুনানি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন শেষ আসামি হিসেবে বাবরের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন চলছে। এরপর সংক্ষিপ্ততম সময়ে ঘোষণা হবে রায়।

এই রায় নিয়ে বিএনপিতে উদ্বেগ স্পষ্ট। কারণ, তাদের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে যার নাম এসেছে, সেই তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

ফখরুলের তোলা ১০ প্রসঙ্গ

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ওইদিন (২১ আগস্ট) ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বিকাল চারটায় মুক্তাঙ্গণে সভার আয়োজন করে। মহানগর পুলিশ সভার নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু সভার কিছুক্ষণ পূর্বে হঠাৎ করে মহানগর পুলিশকে কিছু না জানিয়ে সভার স্থান পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কেন নিয়ে যাওয়া হলো তা আজও স্পষ্ট হয়নি।’

‘২০০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এ বিষয়ে জানতে চাইলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘২২ আগস্ট মতিঝিল থানার একজন কর্মকর্তা এফআইআর করেন এবং তদন্ত শুরু করেন। ২০০৭সাল পর্যন্ত মোট চারজন পুলিশ কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করে। তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রবল আগ্রহে ইন্টারপোল ও এফবিআই তদন্ত করে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এফবিআই ও অন্যান্য তদন্তকারী দল শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িটি পরীক্ষা করতে চাইলেও তিনি তা কখনো দিতে রাজি হননি।’

‘একই সঙ্গে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও গঠন করে। এসব প্রমাণ করে বিএনপি সরকার প্রকৃত ঘটনা ও অপরাধীদের শনাক্ত করার বিষয়ে উদ্যোগী ছিল।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম না থাকা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাকে আসামি করর কথা তুলে ধরেন ফখরুল। তার দাবি, ‘গোটা ঘটনা এক অস্বাভাবিক মোড় নেয়।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আখন্দকে দিয়ে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট থেকে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করা হয়। তাকে ‘বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা’ আখ্যা দেন ফিখরুল।

বিএনপি মহাসচিবের দাবি, মুফতি হান্নানকে ৪০০ দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়। কিন্তু মুফতি হান্নান সেই জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন করে ‘সরকারের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছেন’।

এখন সরকার বিচার বিভাগকে দিয়ে নিজেদের ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণের অপচেষ্টায়’ রত আছে।

এই পর্যায়ে এসে ফখরুল তার প্রশ্নগুলো তুলে ধরেন।

১. মুফতি হান্নানকে ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তুলে ধরে ফখরুল বলেন, ‘মুফতি হান্নানের সঙ্গে তারেক রহমানের যোগসাজশ থাকলে বিএনপি আমলে সে গ্রেপ্তার হবে কেন?’

২. মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তারেক রহমানের নাম এসেছে। ফখরুলের দাবি, আসামির দ্বিতীয় দফা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. ভারতের সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত। ২০০৪সালের ২১অক্টোবর দৈনিক ডন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। শেখ হাসিনা কিসের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ করেছিলেন তা কখনও কোনো আদালত বা তদন্তকারী দল জানতে চায়নি কেন?

৪. শেখ হাসিনার গাড়িতে কয়েকটি বুলেট ছোড়া হয়েছে, গাড়ির চাকায় এবং কাঁচে আঘাত করেছে। অথচ কোনো প্রতিবেদন এবং জবানবন্দীতে গুলির কথা উল্লেখ নেই কেন?

৫. মুফতি হান্নানকে ৪১০দিন রিমান্ডে নিয়ে তারেক রহমানকে জড়িত করার জন্য ‘অবর্ণনীয় অত্যাচার করা হয়েছে’। ‘কোনো সভ্য দেশে কোনো আসামিকে এত দীর্ঘ দিন রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করার নজির নেই।’

৬.মুফতি হান্নানের প্রথম জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে ২০০৭সালে। দ্বিতীয় জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে ২০১১সালে। একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে (তারেক রহমান) সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে কি না সেটা কারো মনে করার জন্য চার বছর সময় লাগে?

৭. মুফতী হান্নান তার প্রথম জবানবন্দিতে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার কারণ হিসেবে আবদুস সালাম পিন্টুর (জোট সরকারের উপমন্ত্রী) ক্ষোভ এবং ইসলামিক স্কলারদের মারার জন্য তার নিজের রাগকে কারণ হিসাবে বললেও দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিতে তা বদলে গেছে। বলা হয়েছে, তারেক রহমান শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিলেন। জবানবন্দির এই পরিবর্তন যে তার ইচ্ছাকৃত ছিল না, সেটা তিনি জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনে স্বীকার করেছেন।

৮. সিলেটে গ্রেনেড হামলা মামলায় মুফতি হান্নানকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ফলে এই মামলাটিতে বিচারিক আদালতে জবানবন্দী অস্বীকার করার আইনানুগ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

৯.আবদুল কাহার আকন্দের দেয়া চার্জশিটে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্যই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। শেখ হাসিনাও ক্রমাগত বলছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এই ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা বা কোনো আইনজীবী বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। তাদের সম্পৃক্ততা আছে বলেও দাবি করেননি।

১০. শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের লোকজন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চালিয়েছে, দুর্নীতির ‘মিথ্যা’ অভিযোগ করেছে এবং সুযোগ পেয়ে তার বিরুদ্ধে হত্যার সহযোগিতার অভিযোগ এনেছে।

(ওএস/পিএস/আগস্ট ২৭, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test