E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অমরাবতীর খোঁজে

২০১৪ আগস্ট ০৮ ১৪:৩৪:৪১
অমরাবতীর খোঁজে

সালাম সালেহ উদদীন : পিচঢালা পথ পেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় যখন পা বাড়াই তখন আমার মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকে। দুই দশকের বেশি সময় এই পথ আমি মাড়াইনি। অচিন পথিকের মতোই যেন আমার পথচলা। আমি যাচ্ছি রামনাথপুর গ্রামে।

ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে আমার বড় ফুফু থাকেন। বছর কয়েক আগে ফুপা মারা গেছেন। সান্ত¡না দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়, তার সঙ্গে দেখা করার জন্য মূলত আমার এ যাত্রা। আমি একা নই, সঙ্গে রয়েছে আমার ছেলে প্রিয় এবং ভাতিজা ওসামা। ওরা দু’জন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং বয়সের ব্যবধান তেমন নয়। প্রিয়র জন্ম শহরে। তাই ওসামার চেয়ে প্রিয় গ্রামীণ পরিবেশে অতিমাত্রায় উৎফুল্ল। দু’জনে কখনও আমার হাত ধরে হাঁটছে, আবার কখনও হাত ছেড়ে দিয়ে আমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমি ধীর পায়ে হাঁটতে থাকি আর চারপাশের বাড়িঘর, গাছপালার দিকে তাকাই। দুই দশকে এই এলাকার অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। আগে বিলের পাশ ঘেঁষে ছোট একটি রাস্তা ছিল, হালকা গাছপালা এবং ফাঁকা ফাঁকা শনের ঘর চোখে পড়তো। এসব ছাপিয়ে চান্দার বিলই চোখের সামনে ফুটে উঠতো। এখন পাশের বড় রাস্তাটি অর্থাৎ জয়পাড়া কার্তিকপুর সংযোগ সড়ক পিচঢালা। শাখা রাস্তাগুলোও অধিকাংশ পাকা। তবে রামনাথপুরের এই রাস্তাটি পাকা না হলেও বেশ উঁচু এবং অনায়াসে রিকশা-ভ্যান চলতে পারে। আশপাশের বাড়িঘর, টিন-কাঠের সংমিশ্রণে তৈরি এবং ভিটি পাকা। ঢাকার দোহারের চরাঞ্চলের এই পরিবর্তন সত্যিই অকল্পনীয়, বিশেষ করে যারা স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়বেন পূর্বের দৃশ্য স্মরণে এনে। মনের অজান্তেই হয়তো বলবেন কী ছিল আর কী হয়েছে।
ফুফার মৃত্যুর পর থেকেই ভাবছি ওই বাড়িতে যাবো। শহরমুখী যান্ত্রিক জীবন আর নানা ব্যস্ততার কারণে হয়ে ওঠেনি। আজ পঞ্চম বারের মতো উদ্যোগ নিয়ে সফল হলাম। রামনাথপুর যাওয়ার একটি গোপন উদ্দেশ্যও আছে। এই গোপন উদ্দেশ্যটি সময়ে-অসময়ে মনের মধ্যে লালন করে আছি বত্রিশ বছর ধরে। এই দীর্ঘ বছর ধরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় না। আমি জীবনে একবার তার মুখোমুখি হতে চাই। বছর কয়েক আগে দোহারে গেলে মাকে তার কথা জিজ্ঞেস করলাম এবং বললাম তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। মা বললেন, ওর সঙ্গে তুই কেন দেখা করবি? প্রায় একই সময়ে আমার স্ত্রী মিতাকে বললাম, তুমি তো ওর বিষয়টি জানো। ওর স্বামী মারা গেছে, চার মেয়ে নিয়ে ও খুব অভাবে আছে। অর্থের জন্য মেয়েদের পাত্রস্থ করতে পারছে না। মেয়েদের নিয়ে ও খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়, পরনে ছেঁড়া কাপড়। আমি ওর সঙ্গে দেখা করে কিছু সাহায্য করতে চাই। আমার কথা শুনে মিতা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো- কিন্তু সাহায্য কেন, ব্যাংকে যা টাকা আছে সব তুলে দিয়ে আসো, না হয় সবাইকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসো। আমরা ভরণ-পোষণ ও বিয়ের ব্যবস্থা করি। এ যুগের নব্য হাতেম তাইয়ের এছাড়া আর করার আর কী আছে। আমি অন্য এক গল্পে লিখেছি (কৃষ্ণপক্ষের মানুষ) রমজান খাঁর মেয়ে সালেহার সঙ্গে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। আত্মীয়তার সূত্রে সালেহা আমার ফুফু হতো। আমরা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। ও অসম্ভব মেধাবী এবং তুখোড় ক্রীড়াবিদ হওয়ার কারণে ওর প্রতি আমার এক ধরনের টান বা দরদ ছিল। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় ওর বাবা রমজান খাঁ আদমজী-শ্রমিক সুদর্শন জাফরের সঙ্গে ওর বিয়ে দেয় লেখাপড়া চালাতে না পেরে। গ্রামীণ এক অসাধারণ প্রতিভার অকাল মৃত্যু ঘটে। সালেহা স্বামীগৃহে যখন চলে যায়, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। একজন ভালো সঙ্গী হিসেবে ওর শূন্যতা অনুভব করতাম। স্বপ্ন দেখতাম সালেহা আকাশে উড়ে আমার কাছে আসতো খাবার নিয়ে। ঘুম থেকে জেগে উঠলে মনটা বিরহকাতর হয়ে পড়তো। ওর আর আমার সম্পর্ক ঘটিত বিষয়টি প্রেমের পর্যায়ে ছিল না। প্রেম-ভালোবাসা কী জিনিস উপলব্ধিতেও আসতো না তখন। তা সত্ত্বেও সালেহার জন্য মন খারাপ ছিল দীর্ঘদিন। এরপর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ওকে ঠিক আগের মতো মনে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে ওর স্বামী জাফরের অকাল মৃত্যুর খবর আমার কাছে অনেক দেরিতে পৌঁছে। এর কয়েক বছর পর পৌঁছে তার আর্থিক ও কন্যাদের পাত্রস্থ করার সংকট। এই দুটো খবর যখন আমি স্মরণে আনি, তখন ভয়ানকভাবে মুষড়ে পড়ি। স্কুল-জীবনের সালেহা জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ধরা দেয়।
দুই বালক কখনো আমার হাত ধরছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে। এভাবেই সামনের পথ এগোচ্ছি। ওরা আমার কিঞ্চিৎ দূরে অবস্থান করলে, রাস্তায় দাঁড়ানো এক তরুণকে মৃত জাফরের বাড়ি কোনটি জানতে চাই।
তরুণটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে, সালাউদ্দিন আপনার কী হয়?
আমি জানতে চাই কোন সালাহউদ্দিন?
- জাফর ভাইয়ের ছোট ছেলে।
আমি রিশতার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলি, ওদের বাড়ি কোনটি?
তরুণটি যে বাড়িটি দেখিয়ে দেয় তার সামনে ছোট্ট একটি ফুলের বাগান। বাগানে সাদা গোলাপের সমারোহ। পাশেই রঙকরা টিনের ঘর। বাড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো তরুণটি আমাকে অন্য কোনো বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাড়ির সামনে অনেকটা উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক বালিকাকে জিজ্ঞেস করি। বালিকাটি আমাকে একই বাড়ি দেখিয়ে দেয়। তারপর আমার ভেতর থেকে সংশয় দূর হয় না। আমি ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকি, দৃষ্টি দেই রঙ করা ঘরের দিকেও। তারপর গলা খাক্কারি দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি। আমাকে দেখে ঘর থেকে রান্নারত এক মহিলা বেরিয়ে আসেন। আমি তাঁর দিকে ভালো করে তাকাই, না সে সালেহা নয়। আমি তাঁর কাছে সালাহউদ্দিনের মাকে খোঁজ করি। তখন তিনি পাশের ঘর দেখিয়ে দেন। পাশাপাশি উচ্চকণ্ঠে এও বলেন- ‘ভাবী আপনার মেহমান আইছে’। আমি উঠানে দাঁড়াই। তখন উঠানব্যাপী বিকেলের রোদের এক অদ্ভুত খেলা চলছে। পাতায় পাতায় দৃশ্যমান হচ্ছে রোদের নাচন। ফুলের ঘ্রাণও নাকে এসে লাগছে। এমন এক মোহনীয় পরিবেশে যে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারলাম না। পরে ভালো করে পরখ করে দেখলাম, আমার সামনে সালেহা দাঁড়িয়ে আছে- কোলে ফুটফুটে সুন্দর এক শিশু। সালেহা চেহারা ও স্বাস্থ্যে মধ্যবয়স অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। মুখের চামড়ায় পর্যন্ত ভাঁজ পড়েছে। যৌবন-উত্তীর্ণ মহিলাদের সঙ্গে সাধারণত মানবিক সম্পর্কই গড়ে ওঠে। একসময়ে প্রেম-ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগার আবহ তৈরি হলেও তা আস্তে আস্তে উঠে যেতে থাকে। সালেহাকে বত্রিশ বছর পর দেখে প্রথমে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। কারণ আমি এতো বছর ওর অনিন্দ্য সুন্দর কিশোরী মুখটিই অন্তরে গেঁথে রেখেছিলাম। এখন যে সেই বাড়ন্ত মনোমুগ্ধকর সবুজ গাছটি পত্র-পল্লবহীন প্রবীণ বৃক্ষে রূপ নিয়েছে। সালেহার শারীরিক যে জীর্ণদশা তার সঙ্গে ওর বাড়িঘর, ফুলের বাগান ও চারপাশের বৃক্ষরাজির সঙ্গে কোনো সাজুয্য খুঁজে পাই না। তবে এ কথাও মনে হলো বাড়িঘর, চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশসহ তার ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে সালেহা শরীর টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
তার দিকে বিস্ময়সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম- আমাকে চিনতে পারছো- আমি সুমন? দেওভোগ স্কুলে তোমার সঙ্গে পড়তাম? আশ্চর্য, নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই ও আমাকে চিনে ফেললো। বললো- তোর সঙ্গে জীবনে দেখা হবে ভাবতে পারি নাই। বলেই সালেহার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। ও আমার হাত ধরলো। আমার মনে হলো, আমার কোনো অভিভাবক আমার হাত ধরেছে। আমার ছেলেমেয়ে ক’জন জানতে চাইলে, বললাম- এক ছেলে এক মেয়ে। অতপর প্রিয়কে দেখিয়ে বললাম- আমার ছেলে, প্রিয়। সালেহা প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু সময় থাকলো। ও জানালো, স্বামী মৃত্যুর পর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কেটেছে ওর। একবেলা খাবার পেতো তো দু’বেলা উপাস থাকতো। অনেক কষ্টে ধার-দেনা করে ছোট ছেলেটাকে বিদেশে পাঠায় সে। ফলে গত তিনবছর ধরে সংসারের অবস্থা ফিরেছে। মাঝের দশ বছর হাড়ভাঙা খাটুনির কারণে সালেহার শরীরে বার্ধক্য নেমে এসেছে। তাই সালেহাকে এখন আমার ক্লাসমেট মনে হচ্ছে না। আমি একবার অতীতে যাই আবার বর্তমান জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকে। পকেটে করে যে টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম তা আর ওকে দেয়ার সাহস পাই না। আমার মনে হলো, ওর সচ্ছলতার মাঝেও টাকাটা দিতে পারলে আমি কিছুটা স্বস্তি পেতাম।

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test