E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বটতলা’র  নাটক ‘খনা’ সত্য উন্মোচনের দৃশ্যকাব্য

২০১৪ সেপ্টেম্বর ১৫ ২৩:২৪:৪০
বটতলা’র  নাটক ‘খনা’ সত্য উন্মোচনের দৃশ্যকাব্য

পীযূষ সিকদার : টিকটিকি টিক্ টিক্ করে উঠলেই ছোটবেলায় কাঠে টোকা দিয়ে ঠিক ঠিক এই তালে সত্য সত্য বলে উঠতাম। গল্প চলছে হয়তো পরিবারে নয়তো বন্ধুদের আড্ডায় বলছি হয়তো এরকম- পরাণ দা বিষ খেলো আসলে দেনার দায়ে যখন আর পেরে উঠছিলো না...কি আর করা তাই পরাণদা  আত্মহত্যা করলো... এমন সময় টিকটিকি টিক্ টিক্ করে উঠলো।

তার মানে এই কথা গুলো সত্য, তাই টিকটিকি টিক্ টিক্ করে উঠলো! একটু বড় হলে প্রশ্ন জাগলো টিকটিকি মানুষের সত্য কথা বোঝে কিভাবে? ঠাকুমা বলেছিলো, অনেক আগে সত্যবাদী একজন মেয়ে ছিলো।তার নাম ছিল খনা। সত্য কথা বলার দায়ে তার স্বামী তার জিব কেটে দিয়েছিলো আর সেই জিব টিকটিকি খেয়েছিলো আর তখন থেকেই টিকটিকি হয়ে গেল সত্যের সংকেত দাতা। এমনটিই জ্ঞান ছিলো আমার খনা সম্পর্কে। এর বাইরে ওই সময় তাকে নিয়ে ভাবনার বিস্তরণ ঘটেনি। জেনেছি শুধু এইটুকুন খনার বচন।সত্য। টিকটিকি টিক্ টিক্ করলে বুঝেছি আমি যা বলেছি তা সত্য। এর বাইরে আর বেশি দূর আমার জ্ঞানের দৌড় এগোয়নি। কিন্তু এই সময়ে এসে শিল্পকলার স্টুডিও থিয়েটার হলে বসে বটতলার ‘খনা’ নাটক দেখলাম , আমি কেঁদেছি, হাহাকার করে কেঁদেছি খনার জন্য। সত্যবাদী মেয়েটার জন্য। হায়রে খনা! হায়রে নারী! হায়রে পুরুষ ঘেরাটোপে বন্দী খনার মতো হাজার হাজার নারী! না, খনা বন্দী জীবন মেনে নেয়নি। প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা মেয়ে যা সত্য তাই বলেছে। তার শ্বশুর জ্যোতিষী বরাহর গণনা মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। জ্যোতিষী বরাহ তার ছেলে মিহিরকে দিয়ে খনা তথা লীলাবতীকে ক্ষমা চাইতে বলেছে কিন্তু খনা তার সিন্ধান্তে অটল,স্থীর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যা সে সত্য বলে মেনেছে, জেনেছে তাই সে বলেছে। তার হত্যার পরিকল্পনা সে জানতো! তবু সে সত্য থেকে সরে আসেনি। তার স্বামী মিহিরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষটিই তার বাবা বরাহর হুকুমে তার স্ত্রীর জিব কেটে দিয়েছিলো! যাতে তার সত্যবচন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়! খনা সত্যের সাথে থেকেছে বলেই ‘খনা’ এক বিদূষী নারী হয়ে উঠেছে। কাল থেকে কালে।

বটতলার ৩য় প্রযোজনা ‘খনা’। এই নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা। প্রথমে অভিনন্দন জানাই নিত্রাকে, যিনি এমন একটি কালজয়ী(আমার ধারণা) নাটক উপহার দিয়েছেন বাংলা থিয়েটারকে। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। হাজারো ধন্যবাদ তাকে। ‘খনা’ বাংলা নাটকের হাজার বছরের গতি প্রকৃতি অনুধাবন নিমিত্ত্ব এক আধুনিক কালের থিয়েটার সৃজন করেছেন। ধন্যবাদ মোহাম্মাদ আলী হায়দারকে। মঞ্চে এ জুটি হোক নতুন কালের থিয়েটার ভাবনার অগ্রসর সৈনিক।

বটতলা’র নাটক ‘খনা’র কাহিনীটি এরকম- এক বিদূষী নারী খনা যার অন্য নাম লীলাবতী। তিনি একজন জ্যোতিষী। স্বামী মিহিরও একই বৃত্তিধারী। শ্বশুর যশস্বী জ্যোতিষী বরাহ মিহির। পুত্র জায়ার যশ, খ্যাতি ও বিদ্যার প্রভাব দর্শনে বরাহের হীনমন্যতা ও ঈর্ষা। তার এই হীনমন্যতা ও ঈর্ষার কারণে বলি হতে হয়েছে খনা তথা লীলাবতীকে। নাটকের কাহিনী এগিয়েছে চন্দ্রকেতু গড়কে কেন্দ্র করে। সেখানে আজো আছে খনা মিহিরের ঢিবি। প্রায় পনেরোশো বছরের পুরনো এ গল্পে বরাহ মিহির বালহন্ডার দেউল নগর বা দেউল নগরের রাজা ধর্মকেতুর রাজা জ্যোতিষী। যিনি পুত্র মিহিরের জন্মকোষ্ঠী বর্ণনা করে তাকে ভাসিয়েছিলেন বিদ্যাধরীর জলে। লঙ্কাদ্বীপ থেকে সেই মিহিরকে নিয়ে খনা হাজির হন তার পিতা বরাহের সামনে। ভুল প্রমানিত হয় বরাহের গণনা। ধর্মকেতুর জনসভায় পরিচিত হন মিহির ও লীলাবতী। রাজ সভাসদ পদও লাভ করেন। বরাহ মেনে নিতে পারেন না পুত্রবধুর এই উথ্থান। অন্যদিকে খনা নতুন দেশের নতুন মানুষদের সাথে মিশে যান বাঁধনহারা। প্রাকৃতজনদের কৃষি সংক্রান্ত জ্ঞানভান্ডের বিকাশে গেঁথে চলেন বচনের পর বচন। পূর্ব শর্ত অনুযায়ী বরাহ আদেশ করেন মিহিরকে খনার জিহ্বা কর্তন করে তাকে উৎসর্গ করতে। মিহির বাধ্য হয়। করেও তাই। কিন্তু খনা মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে বুক টান টান করে দাঁড়িয়েছেন সত্যের সাথে। সত্য বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নাকি এ খনার মৃত্যুনেশা নাকি একরোখা জেদ, নাকি খনা নিজেই নিজেকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেন? এ প্রশ্ন তোলা রইল পাঠকদের জন্য।

খনা বা লীলাবতী চরিত্রে সামিনা লুৎফা নিত্রা অসাধারণ অভিনয় লীলা দেখিয়েছেন। তার প্রেম, দ্রোহ, সারল্য, প্রশ্ন, উত্তর, বচনের পর বচন, জেদ, বচন ভঙ্গিমা এ এক অনবদ্য দেহকাব্যবচন সৃজনে সৃজনে তালে তালে নবরস সৃষ্টি করেছেন। বরাহ চরিত্রে মোহাম্মদ আলী হায়দার, মিহির চরিত্রে- খালিদ হাসান রুমি, কংকনা চরিত্রে-শেউতি শাহ্গুফতা, ধুমকেতু- তৌফিক হাসান ভূঁইয়া, সুমিত্রা- কাজী রোকসানা রুমা, মন্ত্রী বীরেন্দ্র- মিজানুর রহমান, সভাকবি বলরাম- চন্দন লাল, রাজকবিরাজ গুনীন্দ্র- ইভান রিয়াজ, জ্যাঠা- আব্দুল কাদের। রাখাল চরিত্রে আবেদীন রাখাল, দ্বাররক্ষী রঘুনাথ ও ঘোষক বলরাম- পঙ্কজ মজুমদার,হারান-বাকীরুল ইসলাম, পঞ্চী-কাজী রোকসানা রুমা, জগা চরিত্রে সুবীর কুমার বিশ্বাস, বিশু-হাসনাইন শিকদার। সর্বোপরি নাটকটির সেট, আলো, আবহ সংগীত, অভিনয় বর্নণ সব মিলিয়ে‘খনা’ প্রযোজনাটি একটি ভিন্ন ভাষা আঙ্গিক এবং একটি ভিন্ন নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। যার ভেতরে গেঁথে দেয়া গীতধর্মীতার সাথে বচনের পর বচন ‘খনার বচন’। অসাধারণ নাট্যবচন।

আষাঢ় নবমী শুক্ল পখা
কিসের এত লেখাজোকা
যদি বর্ষে মুষল ধারে
মধ্য সমুদ্রে বগা চরে
যদি বর্ষে ছিটে ফোঁটা
পর্বতে হয় মীনের ঘটা
যদি বর্ষে রিমিঝিমি
শস্যের ভার না সহে মেদেনী
হেসে সূর্য বসে পাটে
চাষার বলদ বিকোয় হাঁটে।।
ষোলে চাষে মূলা তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান বিনা চাষে পান।।
থেকে গরু না বায় হাল
তার দুঃখ চিরকাল।।
থোড় তিরিশে ফুল বিশে
ঘোড়াগুলো তেরো দিন।

লেখক : অভিনেতা।
Email: [email protected]
Mobile: 01762193378

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test