E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মরিচা ধরা ট্রাংক

২০২২ ফেব্রুয়ারি ১৪ ১৭:২০:৪৭
মরিচা ধরা ট্রাংক

পীযূষ সিকদার


আশ্বিন আসি আসি করে। গোলাপনগর তখন দুর্গা পূজার আসি আনন্দে সবাই মেতে উঠে। গ্রামে গ্রামে দুর্গার কাঠাম ও মূর্তি গড়ার ধুম পড়ে যায়। চৌধুরী বাড়িতে এ আনন্দের ঢেউ লাগে। চৌধুরী বাড়ির উত্তরে উত্তর পাড়া। দক্ষিনে দক্ষিন পাড়া পাড়া। এই উত্তর দক্ষিন পাড়ার আসল নাম কেউ মনে রাখে না! উত্তর পাড়ার গ্রামটির নাম হলুদবাড়িয়া ও দক্ষিন পাড়ার গ্রামটির নাম বেলেশ্বর।

আকাশে মেঘ। কিছু সময় পরে শুভ্র ফেনার মতো মেঘেরা নিপূণ শিল্পীর হাতে বিভিন্ন চিত্রপট এঁকে যায়। দক্ষিন পাড়ার ধীমান সেন প্রকৃতির নানা রুপ বৈচিত্র দেখতে দেখতে আকাশ সমান দুঃখ নিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়ায়। এতোগুলো ভাই-বোন-ছেলে সরোজ ওদের খাওয়াবে কী! সামনে দুর্গাপূজা। বাজারে আসার সময় তার স্ত্রী রঙমালা তার জমানো টাকা থেকে এক হাজার টাকা ধীমানের হাতে দেয়। ধীমান বলে, এতো টাকা কোথায় পেলে? রঙমালার হাসি কে দেখে! হ্যাঁ, ধীমান সেন এ হাসির মাজেজা বোঝে! চুরি করিনি ব’লে হাসতে থাকে। সে হাসিতে স্বর্গের দেবদেবীরা ভয়ে কেঁপে উঠে।

ধীমান সেনের গোলাপনগর বাজারে পৈত্রিক একটি দোকান আছে। অভাবে তার অর্ধেকটা বেচে দেয়। এখন কোনো রকম ক’রে দোকানটি চালায়। বংশ পরাম্পরায় কাপড়ের ব্যবসা। কাপড়ের ব্যবসা ক’রে দুবেলা অন্ন জোটে। রঙমালা আর ধীমান কোন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়েছে যেন। ধীমান সেন হাঁটে। এক পীঠে দুঃখ ও আরেক পীঠে কষ্ট নিতে নিতে। এই একহাজার টাকা দিয়ে কী করবে ভাবে! শেষমেষ নিজেই নিজেকে অতিক্রম ক’রে নিজেকেই বলেবা টাকাটা ব্যবসায় খাটাবো। অকালের ঝরো হাওয়ার মতো এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে দোকানে যায়। টিনের ঘর। ঝাপওয়ালা। তালা খুলে ঘরে ঢোকে। ঘর ঝাড়– দেয়। আগরবাতি জ্বালায়। প্রণাম করে ঠাকুরকে।

ঠাকুর কী ধীমানের ভাষা বোঝে! হয়তো বোঝে অথবা বোঝে না। তারপরও ঠাকুরের প্রতি তার ভক্তি কমে না। আজ দুটি শাড়ি বিক্রি হলো। অন্যদিন কোন শাড়ি বিক্রি না ক’রেই দুপুরে ফিরতে হয়। ফিরবার পথে প্রতিদিনই মুদি দোকানদার ঘটু বিশ্বাসকে বলে,কেমন আছো? ঘটু প্রতিদিনকার মতো নির্বিকার উত্তর দেয়, ভালো আছি। দোকানের কর্ণারের দিকটা তারই ছোট ভাই বীরেন সেন প্রতিদিনকার কাগজ গেলে। ভালো লাগে ধীমান সেনের। বীরেন সেন খবরের কাগজের দিকে মুখ গোজে। বীরেন সেনের হাটে হাটে কাপড়ের ব্যবসা। ধীমান সেন ভাইকে কিছু বলতে যেয়ে বলে না। মাথা নীচু ক’রে কিছু কাচা বাজার ক’রে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আর ভাবে এই টাকাটা দিয়ে ব্যবসা বাড়াবো নাকি টাকাটা বিপদে আপদে কাজে লাগতে পারে। তির তির করে হাওয়া বয়। নানান ভাবনা মগজের চারদিকে ঘুরতে থাকে। বাড়ি আসে। রঙমালা বাজারের ব্যাগটি ধরে বলে, যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও। খুধা পায়নি?

পেয়েছে। ধীমান সেনেরা চার ভাই বোন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বোনের নাম সুরমালা। স্বামী মরে যাওয়াতে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিছু বিদ্যে ছিল তার। বারান্দায় ছেলে মেয়েদের কল কাকলীতে মুখর ছিল। ধীমান সেন বড়, মেজো মাইনে সেন এবং ছোট ভাই বীরেন সেন । এদের নিয়ে গবেষকদের গবেষণার অন্ত নেই! এভাবে ঐতিহাসিকগণের গবেষণায় সত্যটা মিললো। এই গ্রামে প্রথম চাকরি করতো সরকারের ঘরে। বেতন অপ হয়ে যায় মাইনে। সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়াতে ছেলেপুলে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে যান। ঐদিকে ঘটু দাসের দোকানে চলে আড্ডা। বীরেন সেন একের পর এক সিগারেট হাওয়ায় উড়ায়। প্রথমে গোল্ড ফ্লাক। পয়সা কমে এলে বক মার্কা সিগারেট। যখন পয়সা কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় তখন বাজারে এলো কেটু সিগারেট। ধুয়ার বৃত্ত কেবলি বড় হতে হতে শূণ্যে মিলায়। ঘটু দাস আর বীরেন সেন কোন এক ঈশ্বর ইশারায় বা কৌতুকে কৌতুকে বাজার গরম। বীরেনের কথায় খই ফোটে। বীরেন সেন কাপড় বেচতে চলে যান খলিল পুর অথবা রামসুন্দরপুর।

জীবনে দৈন্যতার ছাপ কোনদিন পড়ে নাই। হাসতে হাসতে সিগারেটে টান দেয়। খল খল ক’রে হাসতে হাসতে সিগারেটের ধুয়া হাসির সাথে শূণ্যে মিলতে মিলতে কখন জানি সাদা মেঘ হয়ে ভাসতে ভাসতে শূণ্যে উড়ে। ঘটু দাস বন্ধুর হাসিকে উপেক্ষা করতে পারে না। চলে গল্প। সকাল থেকে রাত অবদি। বীরেন সেন কেটু সিগারেটে টান দিয়ে নিজের অজ্ঞাতে অথবা জ্ঞানত তার ছেলে মহাদেবের নাম হয়ে যায় কেটু। কেটু বলতে বলতে এক সময় নামের অপভ্রংশ হয়ে যায় কেতু। ধীমান সেন তার ছোট ভাই বীরেন সেনের নাম কীর্তন করতে করতে সময় পার। বীরেন সেন যাত্রা খুব ভালোবাসতেন। ভালো বাসতে বাসতে কখন নিজেই নিজের অগোচরে প্রম্টার হয়ে যান। এত সুন্দর প্রম্টিং তার। প্রত্যেক চরিত্রের প্রবেশ প্রস্থান ছিলো মুখস্থ। দশ চরিত্র নিজেই হয়ে যেতেন। তার নাম এখনো গোলাপনগর গ্রামে অথবা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোন এক রাত্রিতে যাত্রা কমিটির কাছ থেকে ব্যথা পেয়ে আর কোন দিন যাত্রার পথ মাড়াননি। যাত্রায় মেয়েদের নাচ যখন প্রকট হয়ে ওঠে,তখন সে সরে আসেন যাত্রা থেকে। তারপর থেকে নিজেকে সঁপে দেন দৈনিক পত্রিকার পাতায়। ঘটু দাসের দোকানের সামনে চেয়ারে বসে। কথা বলে নিউজপ্রিন্টের কাগজে।

ধীমান সেন খেয়ে দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার স্ত্রী রংমালা খাটের উপরে বসে। এতো কী ভাবো তুমি? ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখো। ব’লে ধীমানের মাথার চুল ছোঁয়। এদিকে পূজা এসে গেল। মাথার পেছনে দুহাত রেখে খালি ভাবনা আকাশে আকাশ ছোঁয়। পারবে কী পারবে না! কপালের রেখারা নদী হয়ে যায়!

দুর্গা পূজা। ঢোল আর বক্সের তাল ও গান হয়ে মদের নেশা জমে উঠে দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়। দুর্গা মা এ বছর এসেছিল ঘোটে ক’রে গেল নৌকায়। এর মর্মকথা বোঝে না ধীমান। কেবলি এর মর্মার্থ অন্ধকার থেকে অন্ধকারে যেয়ে যেয়ে বিলীন হয়। ধীমানের বন্দীদশা আর কাটে না! পূব আকাশ জানান দিলো আশ্বিনের শেষে তার দ্বিতীয় সন্তান আসছে। ধীমানের আনন্দ ও কষ্টের মিহি সুতোয় নিজেকে জানান দিয়ে যায়, বিধি তুমিই জানো! ধীমানের প্রথম সন্তান সরোজ। দ্বিতীয় সন্তানের নাম কী হবে,ভাবনা পেখম মেলে। ছেলে না মেয়ে হবে। তারপর নাম। ফাল্গুনের এক দুপুরে সন্তান আসে। কন্যা সন্তান। আনন্দ আর ধরে না ধীমান সেনের। পঞ্জিকার দিন ক্ষণ দেখে নাম রাখা হলো দুর্গা। যে রকম প্রতিমাতে দেখি দুর্গা সে রকম নয়। কালো কিন্তু আকাশবিদারী হুংকার। দুর্গা জন্মানোর সাথে সাথে কুমার খালির এক কাপড়ের বড় ব্যবসায়ীর সাথে ভাল সম্পর্ক হয়। বিনা বাক্যব্যয়ে প্রচুর টাকার শাড়ী দিয়ে দেয়। বনমালী পান চিবোতে চিবোতে বলে। বলার সাথে সাথে কালো দাঁত স্পষ্ট হয়ে উঠে। বনমালী বলে, পৈত্রিকসূত্রে ব্যবসা। চেহারা দেখেই বলে দিতে পারি কে টাকা মেরে দেবে আর কে মারবে না! আমি তোমার ভেতর শান্ত শিবের মুরতি দেখি। ব্যবসার মূলে দেয়া নেয়া। হিসেব ঠিক রেখো। তাহলে সব ঠিক। তোমার দোকানে ভিখিরি আসবে। কাউকে ফিরায়ো না। ঈশ্বর কিন্তু ভিক্ষুক বেশে আসবে। ধীমান বিস্ময় সহকারে শোনে। এতদিনের যে ধর্ম বিশ্বাস একটু হোচট খায়। গোলমেলে ঠেকে। যাই হোক কথাটি মনে ধরে। মাল নিয়ে নৌকায় উঠায়। দূরের পথ। নদীতে স্রোত। হা ভগবান। তোমাতেই শরনাপন্ন। দোকান সাজায়ে ব্যবসা হলো লক্ষ লক্ষ।

মনে মনে বলে, মেয়ে আমার সাক্ষাৎ দেবী। দক্ষিণ পাড়ার মধ্য দক্ষিণে ধীমানের বাড়ি। দুর্গাকে নিয়ে প্রশস্তি রচনা হলো। শুরু হলো নিজ বাড়িতে দুর্গা পূজা। ধীরে ধীরে দেবী দুর্গাই হয়ে উঠলো। দুর্গা। রুপে যতই কালো হোক না কেন।

দিন যায়। বছর যায়। ধীমানের বাড়ি যেন বাড়ী নয়। এ যেন থরো থরো সাজানো পূজা মন্দির। দক্ষিণ পাড়া থেকে রাজার বাড়িটি খুব বেশী দূরে নয়। জমিদার নাই। জমিদার আছে। কিন্তু সেই জমিদাররা মনো বৈকুল্যে ভোগে। সবার কাছ থেকে দুজন ব্যক্তিকে আলাদা করা যায় না। তারা হলেন কোন এককালে বিশ্বকর্মার হাতে মানুষের ছাচে তৈরি হয়েছিল। একজন প্রমথ চৌধুরী আরেক জন গৌরসুন্দর চৌধুরী। কাকা ভাতিজা চায়ের কাপে কাপে ধুয়া তুলেন।
মাস যায়। বছর যায়। প্রকৃতি তার নানা বৈচিত্র নিয়ে মানুষের কাছে ধরা দেয়। প্রকৃতির এই লীলা কেউ বোঝে কেউ বোঝে না। তাতে প্রকৃতির কিছু আসে যায় না। প্রকৃতি তার কাজে অটল। সর্বদাই বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে চলে। কাকা শোনো, ভগবান শ্রীকৃেষ্ণর কথা। ভাতিজা আরমোড়া ভাঙ্গে। এক পা আগালো কী আরেক পা পেছালো তাতে দুই পায়ের মধ্যে কোন অহংকার তৈরি হয় না। ডান পা আগালো বাম পা পেছনে। বাম পা একটু পরেই এগিয়ে গেলো। অহংকারের মধ্যে মুক্তি নেই। মুক্তি আসে মানুষকে ভালোবাসায়। দু পায়ের অবস্থান হাঁটা সাপেক্ষে একই। এই কাজের মধ্যে অহংকার নেই লজ্জাও নেই। এই সব তত্ত্বকথা জানে প্রমথ চৌধুরী। চিন্তার বলি রেখায় যা অভ্রান্ত। গৌরসুন্দর যা বুঝে নেয়ার তা বুঝে নেয় বন্ধুর বলিরেখায়। প্রমথ ভাবে, এই যে প্রণব গাঙ্গুলী অন্যের হাতের কররেখায় ভাগ্য খোঁজেন! এ কী সত্য! ভাগ্য রেখা কী হাতে থাকে। নাকি যার যার কর্মে পুরো জীবনটাই হয়ে উঠে জীবনমুখী ললাটের বলি রেখায় ভাগ্য না হস্তের মধ্যে ভাগ্য! হঠাৎ মনের অজান্তেই ব’লে উঠে প্রমথ, মিথ্যে ডাহা মিথ্যে কথা! গৌরসুন্দর প্রমথ’র এই রুপ ভাবনা কিছুটা বোঝে আবার কিছুটা অজানাই রয়ে যায়। এভাবে গল্প, বই, চা, আড্ডা,থিয়েটার। তাদের কথা খই হয়ে ফোটে।

ধীমান-এর ব্যবসা তুঙ্গে। জমিদারী তার নেই। তবে টাকায় টাকায় হাতের কররেখার দিকে তাকায়। দুর্গা মা। তোর জন্মের শুভক্ষণে এই আমি ছিলাম রিক্ত। তুই এলি সব হলো। দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। দুর্গা বড় হয়। দুর্গাকে পছন্দ প্রমথ’র। এ কথা জানায় প্রমথ গৌরসুন্দরকে। গৌরসুন্দর কিছুটা গম্ভীর কিছুটা হেসে দিয়ে বলে,ভাল হয়। যথারীতি প্রস্তাব গেলো ধীমান সেনের কাছে। ধীমান আশু আনন্দে নড়ে চড়ে বসে। ছেলে পক্ষের কোন চাওয়া পাওয়া নেই। ধীমান যত খুশি তার চেয়ে বেশী খুশী রংমালা। প্রমথ’র মা উষা বালা এই শুভ কর্মে দারুন খুশী। তার কারণ দুর্গা নামটি তার মনে ধরেছে! দেবী দুর্গা। গায়ের বরণ শ্যামলা তাতে কী কিন্তু দেখতে স্বাক্ষাৎ দেবী দুর্গা। গ্রীষ্ম, বর্ষা এভাবে যায়। দু পক্ষের দু পাক্ষিক কথোপকথনে। অগ্রহায়ণের ৪ তারিখে বিয়ের দিন পড়লো। দুর্গা, দুর্গা মন্দিরে ঢোকে। নিজের সাথে দুর্গার তুলনা করে। উপরে ঈশ্বর হাসেন। সে হাসি ঈশ্বরের স্বর্গ রাজ্যে কাঁপন না ধরলেও! ঈশ্বর পাথর।

ধীমান সেন মেয়ের নাম রাখলেন দুর্গা। দুর্গার জন্মের পর কাপড়ের ব্যবসা জমজমাট। তার পরের বছর দেবী দুর্গার পূজা দেন। এখন দুর্গা এখন বড়। বিয়ে অগ্রহায়ণে। ধীমানের কষ্ট হয়। যার জন্মের সাথে সাথে ললাট পাল্টে গেলো। মা দুর্গা দশ হাত দিয়ে দুর্গা পরিবারে অনেক দিয়েছে। ধীমানের চোখের কোণ ভেজে। এক আনন্দঘন আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে প্রমথ চৌধুরীর ও দুর্গা সেনের বিয়ে হয়। গোত্রে না মিললেও মহা ধুমধামে বিয়ে হয়। গ্রাজুয়েন করে প্রমথ বিয়ে করে। পাশ করার পরেই রেলে চাকুরি পায়। বাড়ি থেকে অফিস দূরে হওয়াতে রেলের চাকরি ছেড়ে দেয়। ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট গ্রাজুয়েটে। জনশ্রুতি এই স্ত্রীর উৎসাহে প্রমথ চৌধুরী পড়াশোনায় ব্রতি হন। এভাবে দুজনের জীবন ভালই কাটে। এম এ ডিগ্রি করে পুরো মনটা থিয়েটারে সঁপে দেয়। অনেক অনেক কাজের ভীড়ে গোলাপনগর গ্রামের শিক্ষা বিস্তারে মনটা ঢেলে দেয়। দেখতে দেখতে হরিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। প্রধান শিক্ষক হয়ে আবার কর্মজীবন শুরু করে।

প্রমথ চৌধুরী কবে থেকে থিয়েটারে মন দিয়েছে কেউ না জানলেও প্রমথ জানে। নীল চাষ না করাতে একজন কৃষককে মেরে ফেলে ইংরেজ। এ সংবাদ যখন প্রমথ’র কানে পৌঁছে। নির্ঘুম রাত কাটে তার। চোখের জলে বালিশ ভেজে। দুর্গা ভাবে, কবে কোন কৃষক নীল বিদ্রোহ করেছে। ইংরেজরা মেরে ফেলে লতীফকে তাই নিয়ে বালিশ ভেজায়! দুর্গা বলে, তোমার মন এত কমল! মেয়ে মানুষ যখন আঘাত পায় তখন এমনি ক’রে বালিশ ভেজায়।

প্রমথ বুঝে নিয়েছে একমাত্র বলার জায়গা থিয়েটার। লিখে ফেলেন নীলদ্রোহ। বিভিন্ন স্থানে শো হল। এ যে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার সামিল। অনেক ভয়ভীতি দেখায় ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা! দুর্গার কাজ বেড়ে যায়। বিকেল থেকে অনেক রাত্রি অবদি চা চলে।

একদিন ঝড়ে বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেলে প্রমথ চৌধুরী জানতে পারে তার প্রথম সন্তান আসছে। এ আনন্দে নেচেছিলো সেদিন প্রশস্থ ছাদে জ্যোৎস্নায় মাখামাখি করে প্রমথ! সেই ক্ষণে ভেতরে ও বাহিরে চাঁদ ঢুকেছিল চাঁদের বিপরীত কোণে দাঁড়িয়ে। একদিকে স্ত্রীর প্রতি সজাগ দৃষ্টি অন্যদিকে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার মহড়া। চলে স্কুল। মানুষ। প্রকৃতির ঘ্রাণ নাকে শুকে শুকে বহুদিন যাত্রার সাথে তার বিচ্ছিন্নতা তাকে পীড়া দেয়। বেদনাভারে যখন নুজ্যমান তখন প্রমথ চৌধুরী দলে ভেড়ান তার ঘনিষ্ট বন্ধুকে। এখানে তার পরিচয় দেবার প্রয়োজনীতা বোধ করছি না। বীরেন সেন বলে, আমি তো যাত্রার মানুষ পারবো কী ক’রে থিয়েটার। অপারবেন। অবশ্যই। যাত্রার সংলাপ এগিয়ে গিয়ে চেচিয়ে বলা। আর থিয়েটার যা তাই। এক মানুষ অন্য মানুষকে বলছে চলতি ভাষায়। থিয়েটারে অভিনয় আছে। অভিনয়টা বাদ দিলে যা হয় তাই। বীরেন সেন অবাক হয়! কী সুন্দর ক’রে অভিনয়টা বুঝিয়ে দিলো! প্রমথ বলে, থিয়েটারে প্রম্টিং নেই। এতদিন তো হাজার রকম অভিনয়ের প্রমটিং করেছেন। থিয়েটার আরো সহজ কাকা। আর শিল্প যা কিছু এ ধরায় তার ভেতর বাহির এক। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা । এই তো থিয়েটারের হাল চাল।

আশ্বিনের কোন এক মঙ্গলবার। সকাল সন্ধ্যা রাত একাকার ক’রে দিয়ে প্রমথ’র প্রথম সন্তান বারিন ভূমিষ্ট হলো দেড় তলা সিঁড়ির অন্ধকার ঘরে। তারা পীঠাপীঠি পাঁচ ভাই-বোন। নামে নামে দেবতা হাসেন। হাসি ও কান্নার মিশেল।
থিয়েটার জমে উঠে চৌধুরী বাড়িতে। সেই সাথে নাচে দুর্গা ও কালী। বারিন বেড়ে ওঠে স্বপ্নে সুনীল। যুদ্ধের দাদামা বেজে উঠে। কত ঘর জ্বললো। কত মায়ের ছেলে হারালো! তা ছায়া লেখকের কলম কেবলি নামে। কান্নায় বুকের ভেতরে পাথর জন্মে। এইরুপ লিখতে গিয়ে কলমরুপ লেখক নিজেকে চিতায় সাজায়। হরি বোল । বল হরি। হরি বোল। এই যে গল্পটা বললাম গল্পের ভঙ্গিতে। তা হতে পারে ”গল্পনাট্য’’। একে নাটক, নাটক, কবিতা, ছবি,গীত , কথা, সংলাপ, গল্প একই অঙ্গে বহুরুপ তার। একে একে দুর্গার পাঁচ ছেলে-মেয়ে ঘর আলো করে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে স্নেহাশীষ ছোট। মুক্তি যুদ্ধের সময় ছয় মাস।

বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে আগুন। হিন্দুদের ঘর বাড়ি জ্বালাও পোড়াও। মানুষ খতম। রাতারাতি পীর বনে যায়। গৌরসুন্দর বলে,চলো আমরা পালাই। নইলে আমাদের মেরে ফেলবে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার ফজলু মুন্সী ওতার দল বল। ওরা পাকবাহিনীকে তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে। সেই তর্জনী কাকা আমাদের দিকে। চলো পালাই কাকা! প্রমথ-এর মনে এরুপ ধারণা ছিলো। আমাদের কে মারবে! জীবনে কাউকে তো ক্ষতি করি নাই! কিছুক্ষণ আগে আকাশ ফর্সা ছিলো। হঠাৎ পুরো আকাশ মেঘে ঢেকে দিল। হালকা বৃষ্টি। কাকা, গৌরসুন্দর বলে। চল পালাই। প্রমথ বলে, পালায়ে কই যাবো? ছোট ছেলে স্নেহাশীষ কাঁদছিলো! খিদের যন্ত্রণায়। প্রমথ আসে পুরাতন বাজারে। দুধ কিনতে! পড়নে-নীল লুঙ্গি ও সাদা পাজামা পড়ে! কিন্তু রক্ষা পায় না প্রমথ-রাজাকারদের তর্জনী পড়ে প্রমথ’র উপরে। প্রমথ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। পাক বাহিনীরা। স্নেহাশীষ খুঁজে ফেরে তার বাবাকে! একটু বড় হলে বোঝে আমার জন্যই বাবা নিখোঁজ! নিজেকেই স্নেহাশীষের খুনি বলে মনে হয়। নিজেকে ধিক্কার দেয় এবং বলে, কেন তুই খুদার জ্বালায় কাঁদছিলি! সেই থেকে স্নেহাশীষের খুদা লাগে না। দুর্গা । স্নেহাশীষের মা স্বামীহারা হয়। আরস্নেহাশীষ বাবাহারা হয়। স্নেহাশীষের ঠাকুমা শর্মিলী পুত্র শোকে পাথর! আর বাকী সব ইতিহাস! এক নির্মম পরিহাসে ঈশ্বর বিপন্ন বোধ করে। ঈশ্বরের কান্না-হাসি বোঝা যায় না! দুর্গার পাঁচ সন্তান ও শাশুড়ীকে নিয়ে অতবড় দালান ছেড়ে জমিদারীর চৌহদ্দি পেরিয়ে অথবা মাড়িয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। পেছনে পড়ে থাকে মস্ত বড় ইতিহাস! দুর্গা, দুর্গা মন্দিরে যায়। নিজের সাথে দেবী দুর্গাকে মিলায়। নিমিষেই দুর্গা নীল বর্ণ ধারন করে। চোখে জল নেই কোনো। ঠাকুর,তোমার কী দয়া হয় না। আমাকে দেখে! ধীরে চোখের জল মোছে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। আমার জন্মের দুর্গা পূজা হয়। হে দেবী তোমার কী দয়া হয় না! স্নেহাশীষ দেখে, ঠাকুমা আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভাবে! হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি হয়ে কাঁদে। দুর্গার চব্বিশ ঘন্টায় বিরাম নেই। এক ছেলে ভিক্ষায় নামে। দুর্গা খামে কপাল ঠেকায়। আর কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে গিরি খাদ হয়ে যায়। বীরেন সেন খেজুর পাতার পাটিতে বসে। নাটকের সংলাপ আওরায় আর কাশে। কেটু সিগারেট ধরায়। পড়ন্ত বিকেলে এসে স্মৃতিপটে নানা চিত্র এঁকে যায়। কাশির দমকে দমকে দুর্গার মনে পড়ছে দূর অতীতের কথা! চা বানিয়ে রেখে দৌঁড়ে যেতো নাট মন্দিরে। তার স্বামীর অভিনয় দেখতে। স্বামীর সুন্দর অভিনয় দেখে একা একা মজা পেতো। স্বামীর এ প্রতিভা নিজেকে শুধু আয়নার সামনে দাঁড় করায়। কী সৌভাগ্য আমার! একজন গুণী মানুষ তার স্বামী। বিস্ময়ে বিস্ময়ে ভবিষ্যত গোণে!

আজ আমার স্বামী নেই! কষ্ট তাকে নীল শাড়িতে পেচিয়ে ধরে। মানায় না। ও যে নিজেই বিষে বিষে নীল। স্নেহাশীষের এক পাগলি মা। হাসে কাঁদে কথা কয়। দুর্গার এই যে হাসি আবার কান্না আবার কথা গীত হয়ে বসন্তের বাতাসে বাতাসে মিশে লীন হয়। দুর্গা গান গায় সতিনাথের সুরে-‘‘দরদিয়া তুমি চলে গেলে দরদী আমি কোথা পাবো। কারে আমি এ ব্যথা জানাবো।’’ এ- গানটি কানে বাজে। দুর্গা হাসে কাঁদেÑবলে চলে তার স্বামীর অভিনয় কীর্তির কথা। তবে বলি। ‘‘ বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অথিপতি, তুমি না বলেছিলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না। তুলে নেবে হিরে জহুরত। তখন তখনতো বুঝতে পারিনি...। আজ সত্যে পরিণত হলো জীবন-মরণ।’’

দেশ স্বাধীন হলো। মানুষ স্বাধীন হলো না। যে ভ্রাতৃত্ব বোধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো! সাধারণ ক্ষমার মধ্যে পড়ে শহীদ পরিবার আবার ধ্বংসের মুখে পড়লো। শুধু শহীদ পরিবার কেনো গোটা জাতির মনুষ্যত্ব গভীর সমুদ্রের মধ্যে পড়ে নাভিশ্বাস তোলে। যাদেরকে আপন মনে করে শেখ মুজিব কাছে টেনে নিয়েছিল তারাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবকে সপরিবারে মেরে ফেললো! বাংলাদেশ নামের ভূ-খন্ডটি পুনরায় ক্ষতের সৃষ্টি হলো। এই দিনটির কথা স্নেহাশীষের খুব মনে আছে। আকাশে এরোপ্লেন ঘুরছে। ভয়ে আতংকে দুর্গা তার শাশুড়ী শর্মিলা স্নেহাশীষদের আগলিয়ে রাখলো। দুর্গার আবার সেই ৭১-এর দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেলো!স্নেহাশীষ এই প্রথম জানলো তাদের রাষ্ট্রনায়ককে খুন করা হয়েছে। ভয় আর আতংকে তার মা সারারাত ঘুমালো না। শিমুলের ডালে লক্ষী পেচা ডেকে উঠে। আরেক অন্ধকারে দুর্গা নিমজ্জিত হলো। অন্ধকারে জেগে উঠে আবার অন্ধকারকেই প্রণাম জানায়। অন্ধকারের ভেতরে; আলোকছটা দেখতে পেলো কী! দুর্গা। ৭১ এ স্বামী হারানোর বেদনা দুর্গার শিরায় শিরায়। স্নেহাশীষ দেখে, মা একটি জং ধরা ট্রাংক নিয়ে মা বাঁচে। বহুকাল ধরেই ওই ট্রাংকটি সযতনে রাখে। টোপ খাওয়া মরিচা ধরা একটি পুরাতন ট্রাংকটিকে চায়না টিপ তালা দিয়ে আটকে রাখে। প্রতিদিন ট্রাংকটির উপরে তুলসি বেলপাতা দেয়। স্নেহাশীষের কৌতুহল বাড়ে। কৌতুহলের পরিসমাপ্তি এইভাবে টানে স্নেহাশীষের মা তবুও বাঁচুক। মা বিনেস্নেহাশীষ কল্পনাও করতে পারে না। ২০০১ সালে দুর্গা আবার ক্ষত বিক্ষত হলো। সে কথা বলবার আগে অথবা পরে পরে লেখা যাবে।

সেই ছোট বেলাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর স্নেহাশীষের জীবনে অশ্রুসজল রেখাপাত করে যায়। বাবার সাথে মেলাবার চেষ্টা করে। মেলে না। ছোট মানুষ। ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট। সেতো বড় মানুষের সুখ দুঃখ কষ্টের মেলে না।স্নেহাশীষ একবার মায়ের দিকে আরেকবার বড়ভাইয়ের দিকে তাকায়। ১৫ আগস্টের পর শেখ মুজিবের কমদামী ফ্রেমে আটা সব ছবি খান খান হয়ে যায়। কেউ ভেঙ্গে ফেলে , কেউ নদীতে ফেলে দেয়। শুরু হয় খুন খারাবি। ডাকাতি চলে সমান তালে।স্নেহাশীষ বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। সংলাপ আওড়ায়।

আজ কেন যে মা দুর্গা উপরের তাকে পড়ে থাকা ট্রাংকটি তার শোবার ঘরে নিয়ে আসে। যত্ন করে ধুয়ে মুছে রাখে খাটের কিনারে। বৈখাখের ঝড় বৃষ্টি হয় না। এই রাতে শুধু মেঘ গর্জন। স্নেহাশীষের মার ঘুম আসে না। রাত গভীর দুর্গার ভয় বাড়ে। গভীরতর রাতে আবার নতুন করে বিপদ আসে। বিপদের কী হাত পা আছে! ভাবে দুর্গা। মেঘ গর্জন সেই সাথে গুলির আওয়াজ। মা ঘাবড়ে যায়। আবার কী হলো।।স্নেহাশীষ মুক্তিযুদ্ধে বাবাসহ ১৪ জনকে হারায়। ভাবে মা, আবার নতুন ক’রে কী হলো! ‘‘ দরজা খোল নইলে ভেঙ্গে ঢুকবো। মা ভয়ে সব সন্তানদের মুরগীর পাখায় আগলে রাখে। দরজা খোল ,দরজা খোল। গুলির আওয়াজ বেড়ে যায়। একসময় দরজা খুলে যায়। ডাকাত দলের সবার মুখে মুখোশ। দুর্গার কাছে ৭১-এ সব হারানোর পর কিছু অবশিষ্ট ছিলো ছিলো। দামী যা ছিলো নিজেই ডাকাতদের হাতে তুলে দেয়। ডাকাত সরদারের হঠাৎ চোখ যায় বিছানার উপরে। কী এর মধ্যে! দুর্গা চিৎকার ক’রে উঠে। না না আমার জীবন থাকতে ট্রাংকটি দেবো না। দুর্গা দৌঁড়ে গিয়ে ট্রাংকটি বুকে জড়িয়ে ধরে। ধস্তা ধস্তি শুরু করে।

স্নেহাশীষের মা বলতে থাকে সাহসে ডানায় ভর ক’রে। না- জীবন থাকতে-এ ট্রাংকটি দেবো না। বিছানার পাশে ভয়ে কাঁপন ধরে অন্য ভাইবোনদের। নৈঃশব্দে নিরবতা। ‘আম গাছের পাতা টিনের চালে পড়ে সেই শব্দও ভয় করে। দুর্গা অবিচল। আমার শেষ সম্বলটুকু আমি দেবো না! এযে আমার স্বামীর একমাত্র স্মৃতি অথবা সম্বল। দুর্গার চোখ আশ্বিনে শরতে যে রকম অথবা নিজেই কালী হয়ে উঠে। সবাই এই ট্রাংকটি নেবার জন্য জবরদস্তি করতে থাকে। ডাকাত সরদার বলে, ট্রাংকটিতে বহু মূল্যবান জিনিষ। ডাকাত দলেরা যত ধস্তা ধস্তি করে। দুর্গা গভীর সমদ্রের মতো আস্ফালন ক’রে উঠে। সবাই কে খুটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। শর্মিলা হাসেও না কাঁদেও না। দুর্গার চিৎকারের শব্দ ওই খাল বাগান পর্যন্ত চলে যায়। না, আমি দেবো না। এ আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ভয়ে পরিবারের অন্যরা চুপসে যায়, কাঁদে। চুপ। কান্নাকাটি করবি না। নইলে গুলি করে দেবো। গুলির প্রকট শব্দ। কান্না থামে। দুর্গা ট্রাংকটি সজোরে বুকের সাথে লেপ্টে রাখে। ওই ট্রাংকটি দে। নাহলে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারবো।স্নেহাশীষ মনে মনে ভাবে, তাদের জীবনে দুর্ঘটনার দুর্ঘটনা তাদের জীবনে বারবার আসে। ভয়েস্নেহাশীষ কুকড়ে যায়। ঈশ্বরও কেঁপে ওঠে। আজ আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। থেকে থকে বৃষ্টি নামে। আকাশ মেঘে ঢাকা। দুর্গার সাহস দমে না। হঠাৎ দুর্গার হাত থেকে ট্রাংকটি ছিনিয়ে নেয়। দোহাই ভগবানের এটি নিয়ে গেলে আমি বাঁচবো কেমন করে। ডাকাত দলের সবাই চলে যায়। দুর্গা তাদের পেছন দৌঁড়াতে থাকে। আমার ট্রাংক। একদিন যে জন্মে ধীমান সেনের ঘর আলো করেছিল। আজ সেই সাদা কাপড়ে শুধুই দৌঁড়ায়! ডাকাতদল রক্ষাচন্ডী মন্দিরের সামনে মরচে ধরা ট্রাংকটি তালা খোলা অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। এ তার স্বামীর অভিনীত নাটকের পোষাক। পরম মমতায় পোষাকগুলি বুকে জড়িয়ে ধরে। চোখের জল কেবলি গড়ায়। দুর্গার কান্না। মা রক্ষাচন্ডী, কেন এমন হলো! দুর্গার কান্না ঈশ্বরের কর্ণ কুহরে পৌঁছায় কিনা জানে না দুর্গা।

ডাকাতদল চলে গেলে; গ্রামের মানুষ আসে। দুর্গা; মন্দিরের খামে ঘষে রক্তাক্ত হয়। গ্রামের সব মানুষ ভীড় করে।
: এ আর এমন কী!
: যা বোঝেনা তা বোলো না!

দুর্গা কাঁদে আর হাসে। হে ভগবান, আমাকে আর জনম দিও না! আমার জন্মের লোভ শেষাবধি আমাকে কালী বর্ণা করলে। ভাবে, বলতে গিয়ে কাঁদে। গৌরসুন্দর আসে। বলে, যে নেই সেতো নেই। আছেওবা। বিশ্বকর্মা বলে, যে আছে। সে সবখানে। যে নেই কোথাও নেই। বিশ্বকর্মা, হাসলো না কাঁদলো বোঝা গেলো না। এই যে দুর্গা সব হারিয়ে ট্রাংক নিয়ে বেঁচেছিলো। বিশ্বকর্মা ভাবে, এভাবে বেঁচে থাকা যায়! বিস্ময় জাগে মনে। বিস্ময়ঘোর কাটেনা,বিশ্বকর্মার।
তাই আজ আশ্বিনের ঢোল বাজে না। দুর্গা বলে, বাজাও ঢোল। আজ আমি সব কান্না মুছে ফেলেছি। সাদা কাপড়ের আঁচলে চোখ মুখ মোছে দুর্গা। দুর্গা নেচে গেলে। আজ পূর্ণিমার চাঁদ ফিকে হয়ে আসে।

আজ কী চাঁদও বুঝে গেলো! নাকি ওর কাজ জনম জনম ধরে যা করছে তাই করছে। একবারও কী বিরক্তি লাগে না। স্নেহাশীষ কাঁদে। কাঁদতেই থাকে। দুর্গার চোখের জল শুকায়! তার স্বামীর নাটকের কস্টিউম জড়িয়ে ধওে পরম মমতায়।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test