E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘কবি’ বাংলা নাট্যের স্বকীয় সুরটির অনুরণন তোলে/পীযূষ সিকদার

২০১৪ সেপ্টেম্বর ২৪ ১১:৩৮:৪৮
‘কবি’ বাংলা নাট্যের স্বকীয় সুরটির অনুরণন তোলে/পীযূষ সিকদার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের চতুর্থ পর্ব স্নাতক সম্মান পরীক্ষা ২০১৩ প্রযোজনা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কবি’র নাট্যায়ন ও নির্দেশনা দিয়েছেন অধ্যাপক ড.ইউসুফ হাসান অর্ক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের ল্যাব-৩ নামক স্টুডিও-তে ‘কবি’ নাটকটি প্রদর্শিত হয়। কুখ্যাত অপরাধ প্রবণ ডোম বংশজাত সন্তানের অকস্মাৎ কবি হয়ে যাওয়ার গল্পই এই নাটকে উঠে এসেছে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি পড়েননি এমন উদাহরণ পাঠককুলে খুবই কম পাওয়া যাবে। ‘কবি’ এক অসাধারণ প্রেমের উপন্যাস। ডোম বংশের ছেলে নিতাই তার বংশের গতানুগতিকতার বাইরে পথ হেঁটেছেন। সে গান গায় গান বাঁধেন। প্রেমের পথটাকেই ধর্ম বলে জেনেছেন, মেনেছেন। পরস্ত্রী ঠাকুরঝির প্রেমে যেমন পড়েন তেমনি বারবণিতা বসনের প্রেমে তাকে নিয়ে সংসার বাধার স্বপ্ন-তার প্রেম ধর্মকেই যেন উসকে দেয়।
তাইতো দেখি ‘কবি’ নাটকের প্রধান চরিত্র নিতাই গান বাঁধেন-
এই খেদ আমার মনে
ভালবেসে মিটিল না আঁশ-কুলাল না এ জীবনে
হায় জীবন এতো ছোট কেনে?
এই ভূবনে?
চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল আর্তনাদ হয়ে ঝরে পড়ে! হয়ত পড়ার আগেই দর্শক মুছে ফেলে জল! আমিও মুছেছি চোখের কোণের জল! সত্যিইতো জীবন এতো ছোট কেনে? ভালোবেসে মিটিল না আঁশ-কুলাল না এ জীবনে...এই সব টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলি অনুভূতির অধিক আরো গভীর জীবন বোধের প্রশ্নের সম্মুখীন করে আমাদেরকে। এ প্রসংগে নাট্য নির্দেশক অধ্যাপক ড.ইউসুফ হাসান অর্ক আরো সুন্দর সাবলীলভাবে গভীর মননে বলেছেন, ‘‘প্রযোজনাটি নির্মাণ করতে গিয়ে আরো একবার বঙ্গীয় জনপদের মানুষগুলোর সাথে নতুন করে বসবাস হলো কিছুদিন; নিতাই, ঠাকুরঝি, বসনদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল যে, আমরা আমাদের বাংলাদেশটাকে কোন এক অগোচরে হারিয়ে ফেলেছি। ‘ভালবেসে মিটিল না আঁশ, কুলাল না এ জীবনে’ কথাগুলোর সাথে দিনাতিপাত করতে গিয়ে আবারো বুঝলাম যে, বাঙলার নদী বিধৌত জনপদে জীবনকে যাপন করার এক স্বকীয় সৌন্দর্য-দর্শন বিরাজ করে বলেই নিতাইগণ ভাল বাসতে বাসতে নিজেকে স্রষ্টার সমান উদার করে তোলে, যে ভালবাসার মধ্যে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোন পাটিগণিত নেই।’’
কবি নাটকটিতে নিতাই যখন গান তোলেন তার কণ্ঠে তখন ‘প্রেম’ নামক প্রপঞ্চটি- শরীরের পাওয়ার চাইতে না পাওয়াটাই সত্যকার প্রেম হয়ে ওঠে। প্রেম তখন নারী-পুরুষের ওমের বাইরে-ধরা ছোঁয়ার বাইরে অনুভবের বিষয় হয়ে ওঠে।
প্রযোজনাটি শুরুই করেছেন নির্দেশক এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যেখানে কবি নিতাই গেয়ে ওঠেন-
চাঁদ তুমি আকাশে থাকো
আমি তোমায় দেখবো খালি
ছুঁতে তোমায় চাই না কো হে চাঁদ
তোমার সোনার অঙ্গে লাগবে কালি।

নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্কের হাতের ‘কবি’ নাটকটি এক অসাধারণ নাট্যসৃষ্টি বলে আমার মনে হয়েছে। দর্শকের মনে আগে থেকে কবি’র যে রুপকল্প আছে সেই রুপকল্পকে রেখেই বর্ণনাত্বক বাঙলানাট্যের শ্রুতিময়তার যে শক্তি এই নাট্যে তাকেই আরো একবার ঝালাই করে নেবার প্রবণতা বা নিরিক্ষা লক্ষ্য করা গেছে।
এ প্রসঙ্গে নাট্য নির্দেশক বলেন,‘‘ সবচাইতে ভাবনার বিষয়টি ছিল এই যে, উপন্যাসটি সকলেরই অতি প্রিয় এবং গল্পটি নিয়ে সকলেরই নিজস্ব রুপকল্প তৈরি আছে। প্রযোজনা নির্মাণের ক্ষেত্রে তাই সেই রুপকল্পগুলো ছুঁয়ে যাবার কোন প্রচেষ্টাই করা হয়নি। সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী বাঙলা বর্ণনাত্বক নাট্যের প্রবণতা যে ‘শ্রুতিময়তার শক্তি’ তাকে পরখ করবার নিরিক্ষা-লিপ্সা জাগ্রত হলো মনে। এ নাট্যে তাই ইমেজ বা রুপকল্প নির্মাণের পরিবর্তে মূহুর্তকে উচ্চকিত করবার প্রয়াসসহ সময়কে থামিয়ে দিয়ে জীবনকে অনুধাবনের অবকাশ দেবার প্রচেষ্টা করা গেছে সচেতনভাবে। পাশাপাশি, বাঙলা নাট্যের সঙ্গীতের দ্যোতনাকে মূল অভিব্যক্তি কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে।’’
গীত, বর্ণনা, অভিনয়, কম্পোজিশন, আলো- অন্ধকার, প্রেম অপ্রেম-শ্রুতিমধুরতার যে কাব্য একটি ফ্রেমে গেঁথেছেন ইউসুফ হাসান অর্ক যেখানে সময়ের ঐক্য নয় বরং সময়কে থামিয়ে এক মহাসময়ের মধ্যে আমাদের দাঁড় করিয়েছেন অভিনব কায়দায়। যেখানে প্রেমই শেষ কথা। তাইতো দেখি নির্দেশকের হাতের ছোঁয়ায় প্রতি মূহুর্তে নিতাই-ঠাকুরঝি অথবা নিতাই-বসন আমাদের হাহাকারে হাহাকারে প্রসবসুন্দর মূহুর্তগুলো উপহার দিয়ে যান একের পর এক।
‘কবি’ নাটকটির কাহিনী সংক্ষেপ বলে নেয়া যেতে পারে, ডোম বংশের ছেলে নিতাই। তার পরিবারে চোর, গুন্ডা, বাটপারিতে সুখ্যাতি আছে। অনেক আগে থেকেই। কিন্তু নিতাই গান করেন গান বাঁধেন। কখনো কখনো ভগবৎ লীলার অনেক চরিত্রকেও হার মানায় নিতাই। নিতাই-এর ভাল লাগে গান গাইতে আর সুর করতে। তাই নিতাই পরিবারের বাইরে এসে বসত গাড়ে স্টেশনের পয়েন্টসম্যান রাজার বাড়িতে। সেখানেই পরিচয় হয় ঠাকুরঝির সাথে। পরস্ত্রী ঠাকুরঝির সাথে প্রেমের কথা জানাজানি হলে নিতাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় ঝুমুর দলে। ঝুমুর দলে বসনের সাথে তার পরিচয় হয়। জীবন কত জটিল ও কুটিল হতে পারে নিতাই ঝুমুর দলে এসে টের পায়। নিতাই বসন্তকে ভালবেসে ফেলে। তার সাথে সমগ্র জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু ততদিনে বসনের শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি। সুখের আতিশয্য নিতাইয়ের মনকে আকুল করে, মনে প্রশ্ন জাগে তার-‘‘ জীবন এতো ছোট কেনে? গভীর রাতে বেহালার সুরে যেন সেই অসমাপ্ত সুরের অনরণন শোনা যায়।
এই নাট্যের নিতাই চরিত্রে সানী ঘোষ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। চলায়-বলায়-গলায়। নিরন্তর অভিনয় ওর সাথী হোক।
ঠাকুরঝি চরিত্রে সায়মা সিরাজী স্বর্ণার অভিনয় সৃজন আমার ভালো লেগেছে। জানি একদিন ও প্রতিষ্ঠা পাবে অভিনয়ে।
বসন চরিত্রে জেরিন চেতনা রহমান ভাষা ভাল করেছেন। মঞ্চে মঞ্চে ও ফুল ফুটাক।
মাসি চরিত্রে ফারজানা হক জলির নিখুঁত নিপূণ অ্যাক্টিং আমাতে মুগ্ধ করেছে। মুখ থেকে মুখোশে আর মুখোশ থেকে মুখে দৃশ্যমান করুক মানুষের মূল মুখটিকে।
প্রযোজনা বিষয়ে একটি বিষয় না বললেই নয়। নিরাভরণ মঞ্চে কেবল অভিনয় আর স্পট লাইটের কিছু সুচিন্তিত প্রয়োগ দিয়ে এতো অনাবিল মূহুর্ত নির্মাণ সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে।
শেষে বলি, নাটকটির সেট, লাইট, কস্টিউম, আবহসংগীত,অভিনয়-এক কথায় অপূর্ব সুন্দর। সত্যি কথা কী এ নাট্যের টিমওয়ার্কটিই মনে রাখবার মতো। তাদের প্রচেষ্টা ও অধ্যাপক ড.ইউসুফ হাসান অর্কের অদৃশ্য সৃজন-সুতায় ‘কবি’ নাট্যটি হয়ে উঠেছে এক মহৎ নাট্য সৃজন। যার মধ্যে আছে মগ্নময়তা ও স্বপ্নময়তার আকাশ সমান অনুরণন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ সত্যিই প্রমাণ করলো বাঙলা নাট্যের স্বকীয় সুরটি কি রকম।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test