E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

এ বিচ্ছিন্নতার গল্প নয়

২০২২ মার্চ ০৯ ১২:৫১:০২
এ বিচ্ছিন্নতার গল্প নয়

পীযূষ সিকদার


‘কবিয়াল’ একটি মুক্ত প্লাটফর্ম। ‘কবিয়াল ট্রাস্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। উদার সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে। কবিয়াল সেই ট্রাস্টের কর্ম-উদ্যোগের একটি শাখা। ললিতকলার নানা শাখা নিয়ে এগিয়ে যাবে। এটিই কবিয়ালের মূল সুর অথবা মূল সূত্র। বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য- কবিয়ালের মূল প্রেরণা।

কবিয়ালের শিল্পকলা চর্চা বাংলা থিয়েটারে এক অনন্য সংযোজন। বাংলা নাটক তথা থিয়েটার তার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। ভালো নাটক ও পেশাদারিত্ব এই দলের প্রধান উদ্দেশ্য। যেখানে গ্রুপ থিয়েটার পেশাদারিত্বর কথা বললেও পারেনি পেশাদারিত্ব আনতে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কেবা চায়! এই হাল-চাল পেশাদারিত্বের।

ড. অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক থিয়েটারকে পেশাদারিত্বের আওতায় আনতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। গ্রুপ থিয়েটার যেখানে শূণ্য হাতে নাট্যকর্মীদের মূল সময়টা কেড়ে নিতেন। সেখানে ‘কবিয়াল’ একটি মুক্ত প্রতিবাদ। এই রিপার্টরি থিয়েটার ‘কবিয়াল’-কাউকেই শূণ্য হাতে ফিরায় না। অভিনেতা,নির্দেশক, কলাকুশলীরা তাদের ন্যায্য পাওনা নিয়ে ঘরে ফিরে। আশার আলো এইখানেই। যদিও আমাদের দেশে রিপার্টরি কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেছে অনেকেই! ফলাফল শূণ্য!

আশা করি ‘কবিয়াল’-একদিন পেশাদারিত্বের আলো জ্বালবে। সুন্দর সুন্দর শিল্প সৃজন করবে। এ আশাবাদ ব্যক্ত করতেই পারি। ‘কবিয়াল’- একটি সম্ভাবনার নাম। অন্যভাবে বলতে গেলে- ‘কবিয়াল’ একটি বাতিঘর। সেই সম্ভাবনার বাতিঘরে যারা কাজ করছেন তারা সম্পূর্ণই পেশাদারিত্বের ভিত্তিতেই কাজ করছেন।

‘সুখ’ নাটকটির মূল লেখক আবদেল মোনেম সেলিম। রুপান্তর: তারিক আনাম খান। নির্দেশনা: ইউসুফ হাসান অর্ক।

‘সুখ’ নাটকটি কবিয়ালের একটি অসাধারণ প্রযোজনা। আমি ইউসুফ হাসান অর্কের ‘সুখ’ নাটকটি দেখে বুকের বা দিকটা চিনচিন করে ব্যথা অনুভব করি। ‘সুখ’ নাটকটি দেখে দুঃখের পাল্লাটা ভারী মনে হয়! একই ছাদের নীচে লুনা ও কবিরের বাস। তবু কত দূরে। স্বামী আর স্ত্রীর দূরত্ব এক দেয়ালে বন্দী। দুজনের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় এক ঘরে থেকেও তারা যোজন যোজন দূরে। খাটের উপর বসে দুজন দুদিকে তাকিয়ে মোবাইলে কথা বলছে। তখন বুঝে নিতে কষ্ট হয় না! এক ছাদ। কাছ থেকেও তাদের ভাবনা লক্ষ যোজন দূরে! ভালোবাসা আছে। শেষ পর্যন্ত গিয়ে তাদের মধ্যে নির্দেশক পার্টিশন এঁকে দেয়। বুকের ব্যথাটা বাড়ে। কষ্ট হয়। দুজনের জন্য। মনে হয়-এ যেন তারকাঁটার বেঁড়ার মধ্যে আটকে পড়ে আছি।

লুনা ও কবিরের মধ্যে সম্পর্কের টানা পোড়েন চলতে থাকে। একজন মাছ পছন্দ করে আরেকজন মাংস। একজন গান শুনতে পছন্দ করে আরেকজন সিরিয়াল পছন্দ করে। একজন চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ে। আরেকজন চেয়ারের বায়না ধরে। লাল টকটকে চেয়ার। এভাবে ঘরের প্রতিটি জিনিসই দুটো করে কেনা হয়। খাট আলাদা হয়। একসময় চাই চাই করে ঘরের সব আসবাব দুটো করে হয়। একই ছাদের নীচে থেকে স্বামী আর স্ত্রী ভাবনার বৈপরীত্যে- এ যেন সম্পর্কের মহাশ্বসান নির্মিত হয়। একে অন্যের পছন্দ মেনে না নিয়ে নিজের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লুনা ও কবিরের মধ্যে লেগে যায় যুদ্ধ।

দু’জনের সহমর্মিতা, বোঝাপড়া, আপোষ- এই নিয়েই সংসার নামক ভূখন্ডটি রচিত হয়। ‘আমরা’ একটি পজিটিভ ভাবনা। কিন্তু ধীরে ধীরে আমিতে রুপান্তরিত হয়ে। আমি আমার করতে করতে সর্বশান্ত হয় লুনা ও কবিরের পরিবার। ভালো লেখক অজান্তেই প্রথম পৃষ্ঠাতেই শেষের ইংগিত রেখে যায়। নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক প্রথম দৃশ্যেই নাটকটির শেষের আভাষ রেখে যান। ইউসুফ হাসান অর্ক নিপূণ হাতে কাজটি করেছেন। টানা নাটকটি এক ঘন্টা ধরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয়। দর্শক টান টান উত্তেজনা নিয়ে শ্বাস বন্ধ করে নাটকটি দেখে। ‘কবিয়াল’-এর বৈশিষ্ট এখানেই। থিয়েটার করে ফতুর হয়েছেন এমন অনেক থিয়েটারকর্মী আমার চোখে পড়েছে! ড.অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক শুধু বিচ্ছিন্নতার গল্প বলে না। গল্প বলে সহমর্মিতার। প্রেমের। শ্রদ্ধার।

তবু আমরা কেমন জানি একা হয়ে যাচ্ছি। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। লুনা ও কবির গল্পের নায়ক-নায়িকা তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একে অপর থেকে। তাদের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। চাওয়া ও পাওয়ার হিসেব যখন মেলে না তখন পার্টিশন টেনে দেন একে অপর থেকে। হল ভর্তি অডিয়েন্স বুকে ব্যথা নিয়ে হল থেকে বেড়িয়েছেন। আমি তার বাইরে নই! সেট ডিজাইনার মুন্সিওনার পরিচয় দিয়েছেন। আলোক পরিকল্পক আলো আঁধারের খোলসে একাকীত্বের চৌকস আলো ফুটিয়ে তুলেছেন।

রেঁনেসা আমরা পেয়েছি একটি ধনাত্বক চিন্তা হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি একাকীত্বে হৃনাত্বক হয়ে ওঠে। ভিন্নরুচির দুইজন মানুষ। কবির ও লুনা। তারা স্বামী স্ত্রী। ব্যক্তিগত সুখ দেখতে দেখতে তারা একা হয়ে পড়ে। একাকীত্বের নামই কি ‘সুখ’? সুখের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একসময় আমরা, আমি হয়ে যাই। তারপর আমার হয়ে যাই। ‘কবিয়াল’-এর প্রযোজনা ‘সুখ’বেদনায় উদ্ভাসিত হলেও নির্দেশক শেষ পর্যন্ত আনন্দের ফল্গুধারা আমাদের জন্য রেখে যান। হল থেকে বেরুতে বেরুতে দর্শক ভাবে। ভাবনার আকাশে ডুব দেয়। এখানেই নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্কের কীর্তি। সুন্দর মোড়কে স্বামী-স্ত্রীর দ্বাদ্বিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন। নিপূণ কলা কুশলতায়।

লুনা কবির কি দেয়ালে দেয়াল তুলে বাঁচবে! নাকি একা একা হতে হতে আরেক সম্ভাবনার ভিত্তি রচনা করবে!

‘কবিয়াল’- রেপার্টরির ‘সুখ’ একটি অনন্য প্রযোজনা। এক শহর থেকে আরেক শহরে চলুক প্রদর্শনী। এ বিচ্ছিন্নতার গল্প নয়। বিচ্ছিন্নতা ভেঙ্গে এক হবার গল্প ‘সুখ’। থিয়েটার যখন মুখ থুবরে পড়ে আছে। তখন ড.অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক পেশাদার দল গড়লেন ‘কবিয়াল’। সময় আসবেই। আমরা বিচ্ছিন্নতা ভেঙে এক হবার গল্প বলবো। লুনা ও কবির একাকীত্ব থেকে বেড়িয়ে এসে এক হও! ইউসুফ হাসান অর্কের জয় হোক। জয় হোক থিয়েটারের।

(পিএস/এএস/মার্চ ০৯, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test