E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একলা পৃথিবী

২০১৪ অক্টোবর ১০ ১১:৪৪:৪৯
একলা পৃথিবী

| মুশফিকা মোশাররফ শিলু |

মাধবী চোখ খুলেই দেখে তাদের ঝেলম ট্রেন থেমে আছে বিহারে। বিহারটা খুব রুক্ষ আর শুষ্ক কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে মাধবী। খুব বিরক্তও লাগছে তার। এরই মধ্যে তিন দিন পার হয়ে গেছে; আরো একদিন বাকি জম্মু পৌঁছুতে। উফ! এই বুড়া ট্রেনটা থেকে কখন যে নামবো?- খুব ক্লান্ত লাগছে মাধবীর। ট্রেনের ভেতর আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। ঝেলমটা কেমন একটা বুড়া লোকের মত আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছে! যেন ম্যারাথন রেস শুরু করেছে। ঠাণ্ডারও কোন রকমফের দেখছি না। অসহ্য লাগছে...।
হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অবাক বিস্ময়ে চোখ আটকে যায় মাধবীর। কি-রে বাবা, এ তো দেখি ময়ূর! পেখম মেলে হাঁটছে। ময়ূর তো জানি বৃষ্টি না হলে পেখম মেলে না! বিহারের মত এমন নাই নাই একটা দেশে যত্রতত্র এমন সুন্দর প্রাণী ঘুরে বেড়ায়! উত্তেজনা ধরে রাখতে পারে না মাধবী। জুবিনকে ডেকে বলে, ‘বাবা দ্যাখ একটাঁ ময়ূর! কী সুন্দর দেখতে! তোমার বাবা কই?’ জুবিন কিছু না বুঝেই জানালায় মাথা গলিয়ে বলে, ‘কোথায় আম্মু? ময়ূর কোথায়?’
জুবিন মাথা বের করে হাঁ-করে মুখের ভেতর থেকে কুয়াশা বের করে খেলছে, আর একটু পর পর বলছে, ‘কই ময়ূর কোথায়?’ জুবিন ঠিকই দেখছে তারপরও মায়ের সাথে দুষ্টুুমি করছে। ‘জান আম্মু বিহারের ময়ূর কিন্তু বৃষ্টি না হলেও পেখম ম্যালে। তোমার বন্ধুদেরও বলার মত একটা বিষয় তুমি পেয়ে গেলে।’
মাধবী বোঝে ছেলে তার সাথে মজা করছে। ‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছিরে বাবা, তোমার ফ্রেন্ডদেরকেও তো বলা যাবে, নাকি?’
জুবিনের বাবা ট্রেন থেকে নিচে নেমেছিল। হাতে করে পাতার বাটিতে করে আলুর তরকারি আর গরম গরম কচুরি নিয়ে এলো। বাংলাদেশে এই কচুরিকে বলা হয় পুরি। মাধবী কচুরি আলুর ঝোলে ডুবিয়ে খেতে শুরু করলো। এমন ক্ষিধে পেয়েছিল যে খাবার দেখে আর থাকতে পারলো না। আর সেই উত্তেজনা নিয়েই বলতে লাগলো, ‘দেখ সপ্তর্ষি ঐখানে কয়েকটা ময়ূর! আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বাচ্চাদের মত উল্লাসে মাতামাতি করছে। সপ্তর্ষিও ভীষণ মজা পায়। আসলেই তো ময়ূর! এত কাছ থেকে, প্রকৃতিতে এমন ময়ূরের রীতিমত সমাবেশ- মানে বেশ কয়েকটা একসঙ্গে দেখা যাবে তা আশাই করেনি সে। ঢাকায় চিড়িয়াখানায় গিয়ে ময়ূর দেখেছে ওরা, কিন্তু চিড়িয়াখানার ময়ূর তো খুব একটা পেখম মেলে না।
ময়ূরের এমন ঘোরাফেরা দেখতে দেখতেই ঝেলম ট্রেন যাত্রা শুরু করল। আবার শুরু হলো অশীতিপর বৃদ্ধের ম্যারাথন রেস!
চার দিন পর যখন ওরা ট্রেন থেকে জম্মুতে নামলো তখন দুপুর ১টা বাজে। মাধবী ট্রেনের বোরিং জার্নি থেকে মুক্তি পেলেও শীত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ভীষণ ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা তাদের। সপ্তর্ষি ছেলেকে আরো দুটো গরম জামা পরিয়ে মাধবীকেও আরেকটা সোয়েটার বের করে দিল। নিজেও আরো গরম জামা পরে চলতে শুরু করলো।
ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই জম্মুর পরিবেশে কেমন ভয় ভয় লাগছে। বিশাল দেহী আর্মিগুলো সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। আর বন্দুক, রাইফেল তো তাক করাই আছে।
বাইরে মানুষজন কম, মেয়েদের তো কোন দেখাই নেই। মোড়ে মোড়ে ভেটকি মাছ ভাজা হচ্ছে। মানুষজন এগুলো মুলো কুচি আর বীট লবণ দিয়ে খাচ্ছে। মাধবীরও ভীষণ খেতে ইচ্ছে করছে। ভুর ভুর করে মাছ ভাজার গন্ধ কুয়াশায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ভুলেই গেছে সে আর্মিদের সতর্ক অবস্থান।
মাধবীর এই একটা স্বভাব, বাইরের সব খাবারই তার খেতে ইচ্ছে করে। ইনফেক্ট খাবারের গন্ধ পেলেই ওর ক্ষিধে পেয়ে যায়। যদিও সে খায় খুব অল্প, তবে এ খাওয়াটা চলে কিছুক্ষণ পর পর। সারাদিন একটু একটু করে খাওয়ার অভ্যাস মাধবীর। এখানে নিজের ক্ষুধার কথা বলতে লজ্জা করছে তার। তাই ছেলের নাম করে বলে ‘সপ্তর্ষি, জুবিনের তো ক্ষিধে লেগেছে, মাছ ভাজা কিনবা?’ সপ্তর্ষি বলে, ‘দাঁড়াও একটু পর কিনছি। দেখ না আর্মিগুলার অবস্থা?’ এ কথা শোনে মাধবীর আবার ভয় লাগতে শুরু করল। ওর গলটা কেমন শুকিয়ে আসছে। ‘সপ্তর্ষি, এভাবে একা একা এসে কি ভুল করলাম, ভয় লাগছে খুব?’ সপ্তর্ষি মাধবীকে সাহস দেয়- ‘নাহ্ ভয়ের কিছু নেই, এরা তো সবসময়ই এমন। দাঁড়াও শওকতকে ফোন করছি।’ সাথে সাথে মাধবী বলে ‘গতবার যে এসেছিলাম তখন কিন্তু এত ভয় লাগেনি। তখন অবশ্য আমাদের সাথে শওকত ভাই ছিল, সেজন্য হয়তো এসব খেয়ালই করিনি।’
সপ্তর্ষি একটা টাটা সমু জিপের কাছে গিয়ে আধা ইংলিশ, আধা হিন্দিতে ড্রাইভারকে বোঝাতে লাগলো তাদের গন্তব্যের কথা। ড্রাইভার মনে হয় হালকা-পাতলা বুঝলো এবং ওদের তিনজনেরই বসার ব্যবস্থা করলো। এবার সপ্তর্ষি মাছ ভাজা কিনে নিয়ে এল। ক্ষুধা পেটে জিনিসটা অমৃতের মত লাগছিল। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এরা এমন শীতের মধ্যে মুলো চিবিয়ে চিবয়ে খায়! ওদেরও ভীষণ মজা লাগলো। খেতে খেতেই মাধবীর চোখে আরো একটা খাবার ধরা পড়লো; কিন্তু সপ্তর্ষিকে বলতে লজ্জা লাগছে... কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ‘এ্যাই দেখ না, ওখানে ওরা কী বিক্রি করছে?’ সপ্তর্ষি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই বললো, ‘চিচিঙ্গা। ওরা চিচিঙ্গা বেচতেছে।’ মাধবী প্রায় চিৎকার করে বলে, ‘আরে না, দেখ ওটা ছিলে তাতে লবণ ছিটিয়ে খাচ্ছে।’ সপ্তর্ষি এগিয়ে যায়। হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করে, ‘ইয়ে চিজ কেয়া হ্যায় ভাই?’ বিক্রেতা বলে, ‘ইয়ে হ্যায় কাকড়ি, আপকো চইয়ে?’ সপ্তর্ষি একটা কিনে নিলো। ওমা একদম শশার মত! দেখতে সত্যিই চিচিঙ্গা আর খেতে শশা। উম! সপ্তর্ষি আর মাধবী চিচিঙ্গা-শশা মজা করেই খাচ্ছে।
ওদের গাড়ি প্যাসেঞ্জারে ভর্তি হয়ে গেছে। ফের দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়েছে তাদের। তাওয়াই নামক একটা জায়গায় এসে জুবিনের বমি হয়ে গেল। ড্রাইভার গাড়ি থামায়। জুবিনের বমি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার পর গাড়িতে উঠতেই সপ্তর্ষিও বমি করে ফেলল। মাধবী সব পরিষ্কার করলো; কিন্তু ভয় পেল ওরা না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে!
মাধবী ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে ‘ইয়েতপের কতা দূর হ্যায়?’ ড্রাইভার জানায় রাত ১টা বাজবে। কপাল কুচকে প্রশ্ন করে, ‘প্যাঠে বাসান? (কোথা থেকে এলে?) ছ্যায় জানতা কাশ্মিরি? (কাশ্মিরি জানো?)’ মাধবী কাশ্মিরিতেই উত্তর দেয়, ‘এস্ ছ্যি আমিত বাংলাদেশ পাঠ্যে।’
জুবিন শীতে কাহিল তবুও বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা আম্মু কী বলে?’ সপ্তর্ষি বিদ্রুপ করে বলে, ‘তোমার আম্মু কাশ্মিরের ভাষা প্র্যাকটিস করছে।’ জুবিনের খুব মজা লাগে; সেও মাধবীর সাথে সাথে কাশ্মিরি ভাষা উচ্চারণ করে। মাধবীর মনে শুধু একটা চিন্তাই ঘুরঘুর করছে- সপ্তর্ষি খুব স্ট্রং, তবুও সে বমি করে ফেললো! ড্রাইভারকে আবার বলে, ‘ম্যায় ছুগাছুন লালচক (আমরা লালচক যাবো), আম্মিদিস প্যাইরেসান ফাকাই (আমার খুব চিন্তা হচ্ছে ওরা না অসুস্থ হয়ে পড়ে)।’ ড্রাইভার বলে ‘সুমুরার ফিক্যেয় পারবাই, উচাইসে সুহলিয়াত ছ্যায় (চিন্তা করার কিছু নেই, উঁচুতে এমন হয়)।’ সপ্তর্ষির ভালোই লাগে যে মাধবী বেশ বলছে কাশ্মিরি, কিন্তু কোন প্রশংসা করে না; চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে।
রাত ১টা বেজেছে। ড্রাইভার ওদেরকে ঠিক জায়গামতোই নামিয়েছে। লালচকের ঘুণ্টিঘরে শীতে ওরা তিনজনেই কাবু; একদম দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। শীত যেন হাড়ের ভেতরে গিয়ে কামড়াচ্ছে। সপ্তর্ষি ফোনে ওর বন্ধু শওকতকে ট্রাই করছে। দু’বার ফোন করতেই শওকত ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে এলো। শওকতকে মাধবীর ত্রাণকর্তার মত মনে হলো। শওকত বাসা থেকে মোটা মোটা দুটো কম্বল নিয়ে এসেছে। ঐ কম্বল পেঁচিয়ে ওরা তিনজন বেবিট্যাক্সিতে চড়লো। শওকত আর উমার মোটরসাইকেলে আগে আগে যেতে থাকলো। ১০ মিনিটের রাস্তা, ওরা নারবারায় (শওকতের বাসা) পৌঁছেই যে অভ্যর্থনা পাবে তা মাধবী কল্পনা করতে লাগলো। আরো দু’বার ওরা শওকতের বাড়ি এসেছে। এরা একদম লোকাল কাশ্মিরি। এত আতিথেয়তা এদের মধ্যে কল্পনা করা যায় না। মাধবীর কল্পনা বেশি দূর এগোয়নি তার আগেই ওরা পৌঁছে গেল। মাধবীর কল্পনা করার যা কিছু ছিল তা যেন সিনেমার দৃশ্যের মত ঘটে যেতে থাকলো। গরম ভাতের সাথে টক দই দিয়ে সেদ্ধ করা ভেড়ার মাংস, সেই সাথে ডুমো করে কাটা গাজরও আছে; অপূর্ব স্বাদ! পালং শাকের সাথে চৌকো করে কাটা পনির, ইশ! ক্ষিধের সময়ে এমন আতিথেয়তার সাথে এই খাবার অমৃতই লাগছে মাধবীর। হঠাৎই জুবিন বারবার বলতে লাগলো, ‘আমি মাংসই খাবো, গাজর খাব না... না না।’ মাধবী লজ্জা পেতে লাগলো। ছেলেটা বড় আর হলো না! কিন্তু বিস্মিত হলাম শওকতের মা, বোন আর বোনের মেয়ের জুবিনের প্রতি যত্নবান হতে দেখে! ওরা জুবিনকে সামলাচ্ছে আর ওর পাতে মাংস তুলে দিচ্ছে! ওদের ভাষায় কী জানি বলছে ওকে। এতবার যাওয়া হলো ওদের বাড়ি তবুও ওদের ভাষাটা শেখা হলো না। উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি দিয়েই চালাতে হয়। জুবিন হিন্দিতে ফ্লুয়েন্ট আর মাধবী অল্প অল্প কাশ্মিরি বলতে পারে। জুবিন সমানে বাংলা বলছে আর ওরা সমানে ওদের ভাষায় কথা বলছে... কারোরই কোন সমস্যা হচ্ছে না। কমিউনিকেশন চলছে দারুণভাবে। সবাই সবাইকে বুঝতে পারছে।
শওকতের ভাইয়ের ছোট একটা মেয়ে খাওয়া শেষে হাতে করে একটা কমলা এনে জুবিনকে বলছে, ‘সারতাং খেউ... বাইসা সারতাং খেউ’ মানে ‘ভাইয়া কমলা খাও’। সেই রাতে মাধবী ভেবেই আশ্চর্য হয় এরা এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে মাধবীদের জন্য বসেছিল!
পর দিন সকালে সবাই রেডি হচ্ছে গুলমার্গ যাবে বলে। বরফের মধ্যে দিনভর স্কিইং করবে! সে­জে চড়বে! তাই আনন্দের ঝিলিক মাধবীর চোখে-মুখে। ঘর থেকে বের হতেই সবার দেরি হচ্ছে।
এ বছর বরফ বেশি পড়েছে। ঘরের উঠোন বরফে ঢেকে আছে। উজমার ঘরের জানালা খোলা যায়নি আজ। কারণ জানালা বাইরে থেকে বরফে ঢেকে আছে। ওয়াশরুমে গিজার অন করা হয়েছে প্রায় ১ ঘণ্টা হল কিন্তু জল বেরুবার কোন খবর নেই। উজমার মা, মানে শওকতের বোন খিচুড়ি আর ডিম ভুনা করে বক্সে নিয়েছেন। রান্না শেষ হয়েছে মাত্র ১৫/২০ মিনিট হবে, এরই মধ্যে খাবার ঠাণ্ডাও হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় প্রায় ৩/৪ ইঞ্চি বরফ জমা হয়েছে। শ্রীনগর মানে কাশ্মিরের রাজধানী মিউনিসিপ্যালটি বরফ কেটে কেটে রাস্তার দু’ধারে সরিয়ে দিয়ে গেছে; কিন্তু হিম পড়া বন্ধ হচ্ছে না। গাড়ি খুব সাবধানে চালাতে হবে বলে ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছে শওকত।
নারবারা থেকে গুলমার্গ পৌঁছুতে ওদের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। সেখানে পৌঁছেই মাধবী বরাবরের মত এবারও ভুলে গেল যে সে পৃথিবীতে আছে। বরফে যে খুব সাবধানে হাঁটতে হয়, এটা কিন্তু মাধবী ভোলে না। জুবিনকেও সাহায্য করছে সে। বরফে পায়ের গোড়ালি আগে ফেলতে হয়। সপ্তর্ষিকেও বারবার বলেছে মাধবী, কিন্তু সপ্তর্ষি মাধবীকে পাত্তা দেয়নি। প্রথম তিন স্টেপেই একদম চিৎপটাং! সবাই হেসে গড়াগড়ি। সপ্তর্ষি অবশ্য এরই মধ্যে কয়েকবার পড়ে গেছে।
যতদূর চোখ যায় দুধ সাদা গুঁড়ি গুঁড়ি লবণের মত বরফ সবুজ গাছের গায়ে আর পাতায় ওপর পড়ে আছে। গাছের পাতায় নাড়া দিলেই ঝুরঝুর করে লবণ দানার মত বরফ পড়তে থাকে। এখানকার রেস্টহাউজগুলোর সব ছাদ সবুজ রং করা। ডিমার্গেশন লাইনগুলো লোহার নক্সা করা রেলিং, সেগুলোও সবুজ রঙের। সাদা বরফে সবুজের কম্বিনেশন অসাধারণ লাগে মাধবীর। রেস্টহাউজগুলোর ছাদ বেয়ে যে শিশির নেমে যাচ্ছিলো সেগুলো প্রায় ১২ ইঞ্চি থেকে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়ে জমাট বেঁধে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে চিকন চিকন কাচের কাঠি ঝুলছে! তার মধ্যে সূর্যের নরম রশ্মি পড়ে যেন হীরে চিকচিক করছে! কী অপূর্ব দৃশ্য! মানুষ কি এমনিতেই এক বলে এটা পৃথিবীর স্বর্গ! এটাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ডও বলা হয়। মাধবী অনেকবার সপ্তর্ষিকে আহ্লাদ করে বলেছে, ‘চলো না, আমরা আমাদের সেকেন্ড হোম এখানেই বানাই।’ সপ্তর্ষি সম্মতও হয়েছিলো।
ঘন সাদা বরফের মধ্যে লুটোপুটি মাধবীর চিরকালের পছন্দ। মাধবীর বৃষ্টিও খুব পছন্দের। ঠাণ্ডার প্রোবলেম থাকলেও বৃষ্টিতে ভিজতে তার দারুণ লাগে। আর পৃথিবীর এই সুন্দর জায়গাগুলোতে স্বামী-সন্তানের সাথে ফ্যামিলি ছবি তোলাও ওর প্রিয় শখগুলোর একটি! বারবার জুবিনকে নিয়ে ফটো তোলার বায়না করছে মাধবী। সপ্তর্ষি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার; কিন্তু তার আজ ফটো তোলায় কোন আগ্রহই নেই। মাধবী ছবি তুলতে চাইলেও ধমক দিচ্ছে। এরই মাঝে অবশ্য দু-একটা তুলে দিয়েছে সে। জুবিন দৌড়ে এস বাবাকে ধরে টানাটানি করছে ‘বাবা, চল আম্মুর সাথে ফটো তুলবা।’ সপ্তর্ষি জুবিনকেও ধমক দেয়। মাধবী স্কিইং শুরু করেছে অনেকক্ষণ। হঠাৎ সপ্তর্ষির কাছাকাছি এসে চিৎকার করে বলছে, ‘এই দ্যাখো, আগের বারের চেয়ে অনেক ভাল করতে পারছি আমি।’ মায়ের এমন আনন্দে জুবিনেরও চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক! ‘আম্মু, আরো জোরে কর কর...’ বলছে আর হাততালি দিয়েই চলছে।
মাধবী সত্যি সত্যিই খুব ভালো স্কিইং করছে। বাবাকে বারবার তাগাদা দিয়ে দিয়ে মায়ের সাথে কয়েকটা ছবি তুলিয়ে নিয়েছে জুবিন। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে না খেয়াল করলো জুবিন। আরো অনেক বিদেশীও স্কিইং করছে। তারা বারবার ফিরে ফিরে আসছে কিন্তু মাধবী ফিরছে না অনেকক্ষণ! জুবিন খুঁজছে ওর মাকে। বাবাকে বলতে যাবে যে তার মা কেন আর আসছে না। ফিরে তাকিয়ে দেখে বাবাতো ওখানে নেই!!!
জুবিনের ঘোর কাটলো টেলিফোনের কড়া রিংটোনে। মাকে হারানোর পুরো ঘটনাটা ওর মনে আছে। একদম সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত করে মনে করতে পারে। তখন সে ৮ বছরের। সেবারের কাশ্মির বেড়ানোর স্মৃতির প্রতিটা ঘটনা জুবিনের মেমোরিতে স্পষ্ট গেঁথে আছে। কোন কিছুই মানসপটে হালকা হয়ে যায়নি। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না জুবিনের। কেটে দিল লাইনটা। এই সময়টা ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময়। সন্ধ্যে বেলায় জুবিন ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে। চিরন্তন সেই হাসি মাধবীর। ঠোঁটে সিঁদুরের মত লাল রঙের লিপস্টিক মাখা। অসম্ভব স্মার্ট। সিল্কি চুলগুলো খোলা। মাথায় সাদা পালক ঝোলানো নীল টুপি, চোখে সানগ্লাস পরা। সাদা বরফে নীল রঙের কোল্ড প্রটেক্টর ড্রেস পরে স্কিইং করছে আর যেন দুনিয়াবাসীকে তার আনন্দের ভাগ দিতে চাইছে। একদম আইসকুইনের মত লাগছে জুবিনের মাকে। এমন একটা ছবি হাতে জুবিন মায়ের সাথে শেয়ার করছে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি।
‘আম্মু আমার জয়েনিংয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে, আমি এবার থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট চালাবো, তুমি খুশি হয়েছো আম্মু? আমার প্রথম ফ্লাইট আমেরিকায়। সেখানেও অনেক বরফ আছে আম্মু।’ আজ মা কথা বলছে না, কেমন সানগ্লাস পরে তাকিয়েই আছে জুবিনের দিকে।
প্রতিবারের মত আজও জুবিনের মনে হয়, ওই দিন মাকে বাবাই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল! কারণ, বাবাকে যেদিক থেকে আসতে দেখেছিল প্রথম দিন, চারদিন পর মাকে ঐখানেরই একটা নির্জন ঢালে পাওয়া গিয়েছিল। বাবাতো প্রথম দিনেই ঐদিক থেকে ফিরছিলো। ঐদিনসহ তিনটা দিন বাবাসহ আংকেলরা সবাই, উদ্ধার বাহিনীর সদস্যরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মাকে পেলো না। চার দিন পর বাবাই সবাইকে নিয়ে ঐ নির্জন ঢালে গিয়ে মাকে খুঁজে বের করলো। অথচ আরো যারা স্কিইং করছিলো তারা কেউ সেই দিকে স্কিইং করছিলো না। মাকেও তাদের সাথেই কয়েকবার ফিরে ফিরে আসতে দেখা গেছে, হঠাৎ করে অন্য পাশে মাকে পাওয়া গেলো কেন? তবে কি মাকে সেখানে বাবাই ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো? আর মাকে ফেলে দিয়ে ফিরে আসার সময় জুবিন তা দেখলো!
জুবিন যখনি মাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আম্মু তোমাকে বাবাই ধাক্কা দিয়েছিলো না?’ মাধবী ছেলের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলেছে অথবা চলে গ্যাছে। তাই এখন জুবিন ওর মাকে আর এটা জিজ্ঞেস করে না। সতর্ক থাকে মা যদি আর না আসে! জুবিনের পৃথিবীতে তার মা আসে সেই না-ফেরার দেশ থেকে। তাকে বিরক্ত করলে জুবিন একলা হয়ে পড়ে, তাই মাকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় না। কিন্তু বিশ্বাস করে বাবাই মাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং জুবিনের একলা পৃথিবী তৈরি করে দিয়েছে।
কী ভয়াবহ ছিল সেই দিনগুলো। সে সময় মাধবীকে খুঁজে পেতে চার দিন লেগে গেল! বরফের মধ্যে ওর সুন্দর, ঠোঁটে সেই সিঁদুর লাল লিপস্টিক মাখা, চুলগুলো সিল্কি আর খোলা, মাখনের মত ফর্সা জুবিনের মায়ের লাশ একটা নির্জন ঢালে পড়েছিল! মায়ের লাশ বাংলাদেশে আনা গেল না। দুই দেশের দূতাবাসের ঝামেলার কারণে কাশ্মিরেই আরো অনেক রকম ঝক্কি-ঝামেলার পর শওকত আংকেলেদের পারিবারিক কবরস্থানেই মাকে সমাধি করা হলো। শওকত আংকেলরা সবাই এত আন্তরিক যে, তারা মাকে ওখানে রেখে দিতে পারছে বলে খুব আনন্দিত ছিল। ওদের কান্না জুবিন আজও ভুলতে পারে না। আজও তারা মার মৃত্যুদিনে বাংলাদেশে ফোন করে, দোয়া পাঠের আয়োজন করে। সেইসব দিনগুলোতে জুবিন দেখেছে, ওর বাবা দেশের সবার সাথে কী ব্যস্ততায় কাটিয়েছে। দেশে ফিরে অবশ্য সবার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছে বাবা; কিন্তু এর পর আর বাবাকে কোনদিনই মাকে স্মরণ করতে দেখেনি জুবিন। জুবিনের নানাবাড়ির সবাই ওর বাবাকে সেই ভালোবাসা আর আদর দিয়েই গেছে। সবাই বিশ্বাস করেছে মাধবী নিছক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। জুবিন ভাবে- ‘আচ্ছা শওকত আঙ্কেলরা কি একবারও ভাবেনি যে মাকে কেন ঐ নির্জন ঢালে পাওয়া গেল? আর বাবাকেই বা কেন ঐদিক থেকেই আসতে দেখা গেল?’ জুবিনের একলা পৃথিবীতে এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। কিন্তু জুবিন এই প্রশ্নটা মুছেও ফেলতে পারে না। কেননা, ও নীরবে দেখেছে ওর বাবা দেশে ফিরে এসেই রিমঝিমের সঙ্গে কতটা আনন্দে সময় কাটিয়েছে। এক বছর ব্যস্ততার ভান করে জুবিনকে স্কুলে নিয়ে যায়নি সপ্তর্ষি। জুবিনের দাদা একাই কষ্ট করেছে। তিনিই নিয়ে গেছেন জুবিনকে স্কুলে। ঠিক এক বছর পর সপ্তষি বিয়ে করলো রিমঝিমকে। নুতন বৌ নিয়ে বাড়িতে কতই না উচ্ছলতা! শুধু জুবিনের দাদা নুতন বৌকে পছন্দ করতে পারেননি। বাবাকে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘সপ্তর্ষি, মাধবীর ধারে-কাছেও তো নয় রিমঝিম। স্বভাবেও বোধকরি ভালো হবে না। তুমি জুবিনের কথাটা একবারও ভাবলে না?’ বাবা সেদিন চুপ করে ছিল; কিন্তু নুতন বৌকে নিয়ে বাবার উৎসাহ জুবিনের চোখ এড়ায়নি। জুবিন বোঝে ওর বাবা রিমঝিমকে মাধবীর বর্তমানেই ভালোবেসে ছিল।
জুবিন মায়ের ছবিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা আম্মু, তুমি কি জানতে যে বাবা রিমঝিমকে ভালোবাসে?’ এবার মাধবী উত্তর দেয়, ‘হুম, জানতাম তো’ কিন্তু তুমি এখনো আমার সঙ্গে কথাই বলবে? তোমার তো গ্রাউন্ডে যেতে হবে!’ জুবিন মেনে নেয় মায়ের কথা। তবুও জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মু, তুমি আজ এত দেরি করে এলে কেন?’ মাধবী বলে ‘এই কষ্টের জগতে এত সময় ব্যয় করো না বাবা, তুমি পুথিবীটা জয় কর।’ জুবিন মাকে আদর করে (জুবিনের মাকে ভীষণ ধরতে ইচ্ছে করলেও ধরে না, কারণ মা বলেছিল ওকে ছুঁয়ে দিলে আর কখনও আসতে পারবে না) বলে, ‘ঠিক আছে আম্মু, যাই তাহলে?’ ছবিটা মোছে যত্ন করে। নিজের চোখের জলও মোছে। মুখ-হাত ধুয়ে রেডি হবে বলে ওয়াশরুমে যায়।

রিমঝিম বিকেলের নাস্তা সাজাচ্ছিলো টেবিলে। ওর দুই মেয়ে রায়া আর মায়া জমজ। নাস্তা খেতে বসে রায়া মাকে বলে, ‘মা, জুবিন ভাইয়ার জন্য বাড়লে না?’ রিমঝিম বিরক্ত হয়, ‘তোমাদের ভাইয়া কি কখনো নাস্তা খায় বাসায়? সব সময় তো শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা...’ রায়া রেগে যায়, ‘মোটেই না মা, ভাইয়া আড্ডা দেয় না, তুমি ভাইয়াকে নাস্তা দাও।’ রিমঝিম রাগে গজগজ করতে করতে ডায়নিং থেকে চলে যায়। এরই মধ্যে সপ্তর্ষিও টেবিলে আসে। মায়া বাবাকে বলে, ‘বাবা, তুমি বসো, আমি এনে দিচ্ছি।’ রায়া তার খাবারটা নিয়ে জুবিনের ঘরে গিয়ে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে আহলাদে গলে গিয়ে বলে ‘ভাইয়া, প্লিজ নাস্তাটা খেয়ে যাও।’ জুবিনের মায়া লাগে বোনের জন্য। ওর দুই বোনই ওকে খুব ভালোবাসে। রায়াটা মায়ের সাথে প্রতিবাদ করে আর মায়া চুপ থাকে, কিন্তু ভাইয়াকে ভালোবাসে। জুবিন নাস্তাটা খায় আর শুনতে পায় ডায়নিং টেবিলে বাবা আর রিমঝিমের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। জুবিন বোঝে ওকে নিয়েই রিমঝিমের যত সমস্যা। জুবিন হাতে ঘড়িটা পরছে এমন সময় সপ্তর্ষি ঢুকলো- ‘কি তুমি বাইরে যাচ্ছ?’ জুবিন নরম গলায় উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ বাবা, গ্রাউন্ডে যাবো। ৯ তারিখ তো আমার ফ্লাইট, কিছু কাগজপত্রে সাইন করতে হবে।’ সপ্তর্ষি বলে, ‘সারাটা দিন বাসায় থাকলে তো শুধু মায়ের পূজা করতে থাকো; রিমঝিমও তো তোমার মা, তাকে কোন দিন মায়ের মর্যাদা দিয়েছো? এটা বুঝি তোমার মায়ের থেকে শেখা?’ জুবিনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। কাটকাটভাবে উত্তর দেয়, ‘আমার মা তো আমাকে কিছু শিখানোর সুযোগই পাননি, তার আগেই তাকে এই পৃথিবী থেকে বিদেয় করা হয়েছে; আর আমি আমার মায়েরই পুজো করবো। তাছাড়া উনার সঙ্গে কোন দিন কোন খারাপ আচরণ করেছি বলে তো মনে পড়ে না আমার।’ রায়া বাপ-বেটার কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘প্লিজ বাবা, ভাইয়াকে যন্ত্রণা দিও না তো’- বলেই জুবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। ‘যাও ভাইয়া তুমি ঘুরে আসো, আর আমার জন্য প্লিজ একটা ক্যাডবেরি নিয়ে এসো।’ জুবিন বোঝে রায়া বাবার সাথে ঝগড়াটা হতে দিলো না। এরা দুই বোন সবসময়ই এমন করে। দুজনই ভাইয়াকে ভালোবাসে, হারাতে চায় না কোনভাবে। তাই প্রতিনিয়ত ওদের মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন যায়। জুবিন ভেবে পায় না এর কী সমাধান, ও বেরিয়ে পড়ে।
গ্রাউন্ডের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পুরো পথটায় জুবিনের ভাবনায় সিনেমার মত ভাসে ওর বাবার কর্মকাণ্ডগুলো। নানাবাড়ির লোকজনের সামনে মায়ের কথা তুলে বাবা বারবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়তো। এছাড়া আর কখনো বাবাকে মাকে ফিল করতে দেখেনি জুবিন। কিন্তু রিমঝিমকে খুবই সমীহ করে বাবা। মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কখনো তাকে কাছে ডাকেনি। স্নেহের পরশ দেয়নি। বাবার নানা আচরণেই জুবিন তা অনুভব করেছে। জুবিনের সঙ্গে সপ্তর্ষি নিত্যদিন দুর্ব্যবহার করেছে। জুবিনের সাথে অন্য কারো যেমন ছোট ফুপি, ছোট চাচ্চুর কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া হলে সপ্তর্ষি জুবিনকেই সব দোষ দিয়েছে, অপমান করেছে, শাস্তি দিয়েছে। জুবিন তার চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদের প্রতি তার বাবার স্নেহ, আদর, প্রশ্রয় দেখে নিজের অধিকার দাবি করলে সপ্তর্ষি নিষ্ঠুরভাবে বলেছে, ‘মায়ের স্বভাব পেয়েছো না? আমি ওদের জন্যই করবো, আমার আদর পাওয়ার তোমার কোন যোগ্যতা নেই...।’
এভাবে অপমানে জ্বলতে জ্বলতেই জুবিন বড় হয়েছে। এখন ভাবনা আসে, মাকে যতটা সময় পেয়েছে সে, মায়ের সবকিছুই তার ভালো লাগে। মার এমন কী খারাপ ছিলো যে বাবা সব সময় এমন করেই বলে?
ক্রমেই জুবিন দূরে সরে গেছে বাবা থেকে। খুব কষ্ট হয় জুবিনের। বাবাটা এত নিষ্ঠুর হল কেন শুধু ওর আর ওর মায়ের বেলায়? প্রশ্নটা ঘুরতে থাকে জুবিনের মনজুড়ে। ওর জীবনে কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর নেই। জুবিন তার একলা পৃথিবীতে একলাই চলতে থাকে। দুই বোন আর ত্রিধা ওর পৃথিবীতে একটু একটু ঘোরাফেরা করে। ত্রিধা জুবিনের ক্লাসমেট ছিল। এখন ও হায়ার স্টাডিতে সুইজারল্যান্ডে আছে। ত্রিধা বিদেশ থেকে ফোন করে, জুবিনের মায়ের খোঁজ নেয়, জুবিনকে কেয়ার করে।
জুবিন কষ্ট পায় আজ সে পাইলট হয়েছে; কিন্তু মা সেটা দেখে যেতে পারেনি। মা থাকলে আজ খুব খুশি হতেন। আচ্ছা, মা বেঁচে থাকলে এখন তাকে কেমন দেখাত? মা কি এমনই স্মার্ট থাকতেন? মাকে নিয়ে তার সারা পৃথিবী চষে বেড়ানো হলো না। একটা কষ্টের দলা গলায় জমে থাকে সব সময়, গিলে তা ভেতরে ঠেলে দিতে পারে না জুবিন।
সপ্তর্ষির কেন যেন আজকাল টেনশন হয়। জুবিন তো তখন ছোট ছিল, কী করে ও আন্দাজ করে? আচ্ছা, তখন জুবিনের বয়স কত ছিল? ৭-৮ ছিলো কি? সপ্তর্ষির মাথাটা ঝিমঝিম করে। বুকের মধ্যেও কেমন চাপচাপ লাগে। রিমঝিমকে বলে কোন লাভ নেই, খামাখা ঘ্যানঘ্যান করবে। চুপচাপ নাস্তাটা শেষ করে সেও বাইরে চলে যায়। যাবার আগে রিমঝিমকে বলে ‘আজ বৃষ্টি হতে পারে, জানলাগুলো লাগিয়ে দিও। আর রায়া-মায়ার কোচিংয়ে গিয়ে কোন কাজ নেই, ওরা বাসায় থাকুক।’
দুই বোনের খুনসুটি চলছে, আজ কোনো পড়াশুনা হয়নি। যেদিন ওদের মা জুবিনকে নিয়ে বিরক্ত হয় সেদিন ওদের দুই বোনের পড়তে ইচ্ছে করে না। রায়া-মায়া কাশ্মিরি ভাষায় কথা বলে, ‘রায়া ম্যাগ্যাছি তুরন্ত তৃয়েশ- রায়া আমি একটু ঠাণ্ডা জল খাবো, ছ্যয়?- তুমি? রায়া বোনকে বলে, দাঁড়া খাতাটা একটু দেখেনি। ভাইয়া কত সুন্দর করে বলে না? রায়া দৌড়ে গিয়ে খাতা নিয়ে আসে আর লিখে রাখে, ‘ম্যাগ্যাছি চ্যায়্যে- আমি চা খাবো’। রিমঝিম এসে মেয়েদের বকা দেয়। সারাদিন এসব কী ভাষায় কথা বল তোমরা? ফালতু! পড়াশুনা নেই, তোমাদের ভাইয়া কিন্তু চরম শিখরে পৌঁছে দেখিয়ে দিয়েছে। তোমরা তো আমাদের নাক কাটার জন্য তৈরি হচ্ছো তাই না? বকতে বকতে রিমঝিম চলে যায়। রিমঝিম ভীষণ বিরক্ত। মাধবীর ছেলে তো পাইলট হয়ে গেছে, আর নিজের দুইটা পড়েই না; শুধু সাজগোজ আর ভাইয়ের তাঁবেদারি। রিমঝিম কেমন যেন কমপ্লেক্সে ভোগে। জুবিনের পাইলট হয়ে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারে না। পাইলট গ্রাউন্ডে ভর্তির টাকাটা পর্যন্ত রিমঝিম সপ্তর্ষিকে দিতে দেয়নি। জুবিনকে টাকা দিয়েছে ওর নানু। মাধবীরও কিছু টাকা ছিল জুবিনের নানুর কাছে, সেগুলো মিলিয়ে জুবিনের পড়া কমপ্লিট করেছে। জুবিনটার কপাল ভালো, নানু তাকে কত ভালোবাসে! আপসেট লাগে রিমঝিমের।
রায়া-মায়া মাকে পাত্তাই দেয় না। দুই বোন খুশি মনে বলে, ‘আমরা একজন হ্যান্ডসাম পাইলটের বোন।’ গর্বে দু’বোনের পা মাটিতে পড়ে না। দু’বোনের গল্প আবার শুরু হয়ে যায়। রায়া বলে, ‘মায়া, ভাইয়াকে বলেছি ক্যাডবেরি আনতে। জানিস, আমার ক্যাডবেরি পছন্দের চেয়েও বেশি হলো অভ্যেস! ভাইয়া যদি বাসায় না আসে সেজন্য এই অর্ডারটা দিয়ে রাখি, অন্তত আমাদের জন্য তো ভাইয়া বাসায় আসবে, তাই না?’ মায়া বলে, ‘তুই ভাবিস আমি এটা বুঝি না? বুঝি, শুধু বুঝি না মা কেন ভাইয়াকে পছন্দ করে না! জানিস, আমার তো ভাইয়ার মাকে খুব ভালো লাগে, কী সুন্দর ছিলেন তিনি! বাবা কী করে ভুলে গেল বুঝি না।’
রায়া বোনের কোলে মাথা রেখে বলে, জানিস না, সুন্দর ছেলেদের রুচি খুব খারাপ হয়। কেন বলছি? দ্যাখ, মা কেমন খিচখিচ করে! সত্যি বলতে কি, আমাদের মা কিন্তু দেখতে মাধবী আন্টির ধারে-কাছেও না; তবুও বাবা মাকেই ভালোবাসে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া। একটু থেমে আবার বলে, ‘মাধবী আন্টি থাকাকালেই কিন্তু মায়ের সাথে বাবার অ্যাফেয়ারটা হয়ে গিয়েছিল।’ রায়া বলে, ‘জুবিন ভাইয়াও তো বাবার মতই সুন্দর, বাবার মতই লম্বা। ভাইয়াও কত হ্যান্ডসাম! পাড়ার সব মেয়ে আমাদের দুই বোনকে কত সমীহ করে বুঝিস সেটা? সব কিন্তু ভাইয়ার জন্যই! আর ভাইয়া তো কাউকে পাত্তাই দেয় না। এ্যাই জানিস, কয়েকদিন আগে ভাইয়া ফোনে কাকে যেন বলতেছিল, ‘ম্যায় ছুক চ্যুয়্য খুশকারান’- মানে কি জানিস? মায়া হেসে প্রশ্ন করে, নাতো জানি না; বলতো লিখে রাখি। রায়া থেমে বলে, আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি। বুঝলি শেষমেষ কি জানি একটা বিয়ে করে নিয়ে আসে কে জানে?
মায়া বলে, ভাইয়ার সাথে বাবাও কী নিষ্ঠুর ব্যবহার করে বল? বাবা বড় চাচ্চুর ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব পালন করে, ফুপি, ছোট চাচ্চু, দাদুর ব্যাপারে খুবই কনসার্ন। এ ব্যাপারে মার-ও কত অভিযোগ! আমাদের কেউ ভালই খেয়াল করে। কিন্তু ভাইয়াকে একদম কেয়ার করে না। রায়া বলে, আচ্ছা রাখ সেসব কথা। আমরা তো ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি। ‘দ্যাখ তো কয়টা বাজে?’ ‘বেশি না, ১০টা বাজে মাত্র’। দুই বোন ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করে আর ভেবে পায় না বাবা আজ এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো কেন?
সপ্তর্ষি ঘুম থেকে জেগে ঘড়ি দ্যাখে। ‘এ্যা মা, মাত্র দুটা বাজে? কিন্তু ঘুমটা ভেঙে গেল কেন?’ সপ্তর্ষির বুকে কেমন জ্বালা করছে। কি জানি কেন এমন অস্থির লাগছে। ছেলেটা পরশু চলে যাবে তার প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট! ১৫ দিনের জন্য আমেরিকায় থাকবে। সপ্তর্ষির আজ গর্ব হচ্ছে তার পাইলট ছেলের জন্য! ছেলেটা খুব পরপর হয়ে থাকে। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ওর। সপ্তর্ষি ডায়নিংয়ে গিয়ে এক জগ পানি খেল তবু তৃষ্ণা মেটে না। ভাবছে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকবে। বারান্দাটা খোলা, উঁচু রেলিং দেয়া, সিকিউরড। বাকি রাত এই বারান্দাতেই বসে কাটিয়ে দেবে।
জুবিনের খুব পছন্দ এই খোলা বারান্দা। ওর ঘর থেকে বের হলেই বারান্দাটা। মাধবীর খুব বাগানের শখ ছিল। জুবিনেরও সেরকম! কী সুন্দর বাগান করেছে। ছোটবেলায় জুবিন একা কত ভয় পেত! বাবাকে ছাড়া ঘুমাতোই না। মাধবী চলে যাবার পর ও কেমন একা একাই থাকে, ভয়-টয় পায় না। ছেলেটা কোন ফাঁকে বড় হয়ে গেল খেয়ালই করেনি সপ্তর্ষি। হঠাৎ ও খেয়াল করে জুবিনের ঘরে দুজন কথা বলছে। এত রাতে জুবিনের ঘরে কে? রায়া-মায়া তো ঘুমোচ্ছে। সপ্তর্ষি দরজায় টোকা দিয়ে জুবিনকে ডাকে। জুবিন হন্ত-দন্ত হয়ে দরজাটা খুলে বলে ‘কি বাবা, ঘুমাওনি?’ ‘নাহ, শরীরটা কেমন ভাল লাগছে না। আচ্ছা, তোমার ঘরে কে জুবিন? কার সঙ্গে কথা বলছো?’ জুবিন খেয়াল করে বাবা ঘামছে। টাওয়েল এগিয়ে দেয়। এসি তো চলছেই। ‘বাবা আমি মার সাথে কথা বলছি’। সপ্তর্ষির চোখ বড় হয়ে যায়! ‘তোমার মা? কোথায়?’ জুবিন দেখিয়ে দেয় ওর মা বসে আছে জুবিনের খাটের পাশে। সেই ফর্সা, ইনোসেন্ট, হাস্যময়ী সিল্কি চুলের মাধবী! ওর চুলে এখনো সেই দিনের লবণ গুঁড়া কুচি কুচি বরফ লেগে আছে? সপ্তর্ষি নিজেকে বোঝায়, না! এটা তার ভ্রম! মাধবী হতেই পারে না। ১৮ বছর আগে ও মারা গেছে! জুবিন বলে, ‘বাবা এমন ঘামছো কেন? সপ্তর্ষি স্পষ্ট শুনতে পায়, মাধবী বলছে, ‘সপ্তর্ষি, ঠাণ্ডা আর পরিষ্কার পানি খাও। তুমি এক গাদা পিঁপড়ে ভাসা পানি খেয়েছো।’ সপ্তর্ষি ঠোঁটে হাত বুলিয়ে সত্যিই পিঁপড়ে পেল। ঘামটা বেড়েছে আরও। ও উঠে দাঁড়ালো, মাথাটা খুব ঘুরছে। তবুও জবাব দিল আবার মাধবী কোন উত্তর দেয় কিনা তা বোঝার জন্য। ‘তুমি কথা বলছ? তুমি কি বেঁচে আছ?’ মাধবী উত্তর দেয় ‘নাহ, বেঁচে নেইতো সপ্তর্ষি, কিন্তু কথা বলতে পারি। জুবিনের কথার উত্তর দিতে দিতে শিখে গেছি। জুবিনকে তো তুমি একদম খেয়াল করতে পারো না, তাই আমিই ওকে দেখি। ওকে কাঁদতে দেই না একদম!’ মাধবীর এতগুলো কথা শুনে সপ্তর্ষি এবার জ্ঞান হারালো। জুবিন কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তার লৌহমানব, রোবট বাবা আজ কেন হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন? জুবিন তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মু কী করবো এখন?’ ‘তুমি রিমঝিমকে ডেকে তোল, আর সকালে বাবাকে ডক্টর দেখিয়ে নিও। আজ আমি যাই বাবা?’ জুবিন মাকে বাই বলে।
ডাক্তার সপ্তর্ষির শরীরে তেমন কোন সমস্যা পেলো না; তবে প্রেসার একটু হাই। মানসিকভাবে সে খুব অস্থির। রায়া-মায়া বাবাকে যত্ন করছে। জুবিনের আর সময় নেই, যেতে হবে। একদিন আগেই অফিসে রিপোর্ট করতে হবে।
জুবিন আজ রাতেই চলে যাবে, কারণ রাত ৩টা ৪০-এ ওর ফ্লাইট। জুবিন নিজের মত তৈরি হয়। সারাদিন বাবাকে খেয়াল করেছে। রাতে ফুপির কাছে খেয়ে সবাইকে বাই বলে চলে গেল। আজ সপ্তর্ষি এই প্রথম ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছে!

১৫ দিন পর ফিরে এসে জুবিন বাবাকে খুবই অসুস্থ পায়। জুবিন যাবার ৩ দিন পর থেকেই অসুস্থতা বাড়তে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই সপ্তর্ষি জুবিনের ঘরে ঘুমিয়েছে। জুবিনের ঘরে শোয়া নিয়ে রিমঝিম অনেক কাণ্ড করেছে। রায়া-মায়া সব সামলালেও বাবা ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছে। মায়া জুবিনকে সব খুলে বলল, ‘ভাইয়া, তুমি যাবার ৪ দিনের দিন বাবা মাধবী আন্টির সাথে কথা বলেছে। আমিও তোমার ঘরে মেঝেতে বাবার সাথে শুয়েছি। দেখি বাবা মধ্যরাতে উঠে আন্টির সাথে কথা বলা শুরু করে। আমি বাবার একতরফা কথা শুনতে পাই, আর কারো কথা শুনতে পাই না। বাবা বারবার বলতে থাকে ‘মাধবী তুমি কি করে কথা বল, কি করে এই পৃথিবীতে আসা-যাওয়া কর? জুবিনের কাছে এমন করে এলে ও-কি আর সুস্থ থাকতে পারবে?’ আমি বুঝতে পারি, বাবা মাধবী আন্টির সাথেই কথা বলে। মায়া থামে একটু। চোখে পানি এসে গেছে। গলার স্বর নামিয়ে অসহায়ের মত জুবিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা বারবার আন্টির কাছে ক্ষমা চাইছিল। ভাইয়া, বাবাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ!’ ওর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবার জন্য মায়ার বড় কষ্ট হয়। একটু ধৈর্য নিয়ে থেমে বলে, ‘ভাইয়া, বাবা তো পাগল হয়ে যাচ্ছে, মেন্টাল কাউন্সেলিং দরকার। তুমি বাবাকে সুস্থ করে দাও ভাইয়া।’ অঝোরে কাঁদতে থাকে মায়া। ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে আছে সে, যেন বাবার সব কষ্ট ভাইয়াই ঠিক করে দিতে পারে। জুবিন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। জুবিন বুঝতে পারে ওর বাবা ওর একলা পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে। বাবাও মাকে দেখতে পাচ্ছে! না কিছুতেই হতে পারে না। বাবাকে জুবিন স্পেয়ার করবে না। মা শুধু ওর; বাবা মাকে কোনদিন ভালবাসেনি, সম্মান করেনি, মার কোন প্রতিভার কদর করেনি। মা কী অসম্ভব সুন্দর গান গাইতো! অথচ বাবা ঘরে থাকলে মা কখনোই গাইতো না। মা খুব চেপে রাখতো তার গান গাইবার ইচ্ছে। মাকে খুব সন্তর্পণে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে বাবা। পৃথিবীর কেউ এটা বিশ্বাস না করলেও জুবিন বিশ্বাস করে, বাবাই ওর মাকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। আর আজ বাবা নিজেই সেটা প্রকাশ করতে চলেছে। কিন্তু রায়া-মায়া জুবিনের জন্য একটা ফ্যাক্টর। এ দুইবোন ছোটবেলা থেকে জুবিনকে ভীষণ ভালোবাসে আর নিজেদের গুণেই জুবিনের পৃথিবীতে হাঁটাহাঁটি করে। তাদের জন্য হলেও বাবাকে ট্রিটম্যান্ট করাতেই হবে। তাছাড়া, ওর আর মাধবীর পৃথিবীতে কিছুতেই বাবাকে জায়গা দেয়া যাবে না। জুবিনের একলা পৃথিবীতে মাধবী আর সাদা বরফ থাকবে সেখানে বাবার থাকার কোন অধিকার নেই।
বোনকে সান্ত্বনা দেয় জুবিন, ‘ভেবো না তোমরা, বাবাকে সাইকোলজিস্ট দেখাবো। এ পৃথিবীর যেখানে বাবাকে নিতে হয় নিয়ে যাবো। কেঁদো না তোমরা, বাবা ভালো হয়ে যাবে...’

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test