E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিকামী মানুষের কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী

২০২৩ জুন ১০ ১৬:৪৪:৪২
মুক্তিকামী মানুষের কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী

বদরুল হায়দার


আপদমস্তক কবি, বিপ্লবী, সমাজসেবক সাম্যবাদী সাহিত্যিক রথীন্দ্রকান্তনাথ ঘটক চৌধুরী আজন্ম সংগ্রামী মানুষ। তিনি ছিলেন সত্যিকারের গণমানুষের কবি। আমৃত্যু সৃষ্টি করে গেছেন মানুষের মুক্তিকামী সাহিত্য। মানুষই ছিল তার সাহিত্যের প্রকৃত আরাধনা। মরমী প্রেমিকের মতো তিনি আমৃত্যু মানুষের অধিকার, সাম্য মৈত্রী, সত্য সুন্দর মানবতার জয়গান করছেন তার চিন্তা ও সৃষ্টিকর্মে। কবিতা গল্প প্রবন্ধ নাটক নাটিকা পত্র সাহিত্যে তার দুর্লভ রুচির পরিচয় মেলে আদর্শিক নীতি নিষ্ঠায়। সুসাহিত্য ও সুসংস্কৃতির লেখক হিসেবে সমাজের দায়বদ্ধতা সচেতনভাবে তার জীবন ও সাহিত্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কাগজ সম্পাদনা, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, প্রতিবেদন, কথিকাপাঠ, সঙ্গীত রচনা করেছেন অসংখ্য। 

কবি রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের ছাত্র হয়েও নিজের এলাকার মানুষের উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের স্বার্থে তিনি নিজ জেলা শরীয়তপুরের পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দীর্ঘকাল পালন করেছেন সততার সঙ্গে। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী ১৯২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ১১ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্রিটিশবিরোধী শ্রেণী সংগ্রামী, অন্যদিকে উঁচু মানের সাহিত্যের সমঝাদার ও পাঠক। রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরী পিতার আদর্শ অনুসরণ অনুকরণ করে সারা জীবনই সাম্যবাদী সাহিত্যিক ও সমাজ কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী গ্রন্থ নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পিতা সূর্যকান্ত চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যের আলেচিত সংগ্রহের বাইরে বালজাক টলস্টয়, শেলী, কীটস, গোর্কিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী লেখকের গ্রন্থে সমৃদ্ধ ছিল এ পাঠাগার। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সাহিত্যের হাতে খড়ি শৈশবে পারিবারিক পরিম-লে। তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও পারিবারিক শিক্ষার প্রেরণায় ব্রিটিশবিরোধী, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিপ্লবী অনুশীলন দলে যুক্ত হন।

১৯৩৯ সালে গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে পিতার হাত ধরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রম শিষ্যরূপে শান্তি নিকেতনে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। শান্তি নিকেতনে অধ্যয়নকালে ‘সাহিত্যিকা’ সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪০ সালে বিশ্ব কবির সভাপতিত্বে সাহিত্য সভায় রথীন্দ্রনাথ স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।

১৯৮৮ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ থেকে প্রকাশিত রথীন্দ্রকান্ত ঘটকের শান্তি নিকেতনের জীবন স্মৃতিÑরবীন্দ্র তরুমূলে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪১ সালে শান্তি নিকেতন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তির পর মার্কসীয় দর্শনের রাজনৈতিক, কবি, সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে। তিনি আমৃত্যু শ্রেণী সংগ্রাম ও বামপন্থী সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অবিচল বিশ্বাসী ছিলেন। কবিতা গল্প নাটক নাটিকা প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রহসন রচনা করেছেন অসংখ্য। প্রেমের কবিতায় তিনি জীবনের আশা ও সংগ্রামকে একাত্ম করেছেন।

প্রবন্ধ গল্পও তার কবিতার সহোদর ছিল আজীবন। প্রেম মানবতা উদারতা সেবার ব্যাপকতা তার সৃষ্টি কর্মে প্রতিফলন ঘটে। শিক্ষক ও সামজসেবক হিসেবে দীর্ঘকাল নিয়োজিত থেকেও তিনি সাহিত্য সংস্কৃতিকে জীবনের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে নিয়েছিলেন। নিজ এলাকায় আর্তমানবতার সেবায় লঙ্গরখানা রিলিফ আন্দোলন, মেডিক্যাল সেবা, হাসপাতাল দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, কুটির শিল্প চর্চার প্রচলনসহ অসংখ্য কল্যাণমুখী ও মহত্তর কার্যক্রমে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছেন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শ্রেণী সংগ্রামে তিনি বৃহত্তর ফরিদপুরে নেতৃত্ব দেন। ঋষি সুলভ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলে তার শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকে তিনি সেবা হিসেবে দেখতেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন- শিক্ষা রাজনীতি সমাজ কর্ম, সাহিত্য সৃজন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অঙ্গাঙ্গিভাবে গণসম্পর্কিত না হলে সমাজ মানস সমৃদ্ধ হয় না। গণমানসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী ত্যাগী মানুষ কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী। নিজ এলাকায় স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়াম, পাবলিক লাইব্রেরী, শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

আপাদমস্তক বিপ্লবী কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত থেকে আড়াই শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, শতাধিক ছোটগল্প, বেশ কিছু নাটক, নাটিকা, অর্ধ শতাধিক সঙ্গীত, কিছু প্রহসন রচনা করেন। দেশ আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, অমৃতবাজার, দৈনিক পাকিস্তানসহ দুই বাংলার অধিকাংশ ম্যাগাজিন ও দৈনিকে তার লেখা প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সহস্রাধিক পত্র ঘটক চৌধুরী গ্রন্থ নিকেতনে সংরক্ষিত রয়েছে। রেডিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত গীতিকার ও কথিকা পাঠক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ‘কয়েকজন লোক কবি ও প্রসঙ্গত’ (লোক গবেষণা গ্রন্থ) ‘পূর্বাপর’ (কাব্যগ্রন্থ) সুকান্তে হস্তাক্ষরে কবিতার পান্ডুলিপি (গবেষণা গ্রন্থ) ‘ঝরাপাতা’ (গল্পগ্রন্থ) ‘রবীন্দ্র তরুমূলে’ (শান্তি নিকেতন শিক্ষাজীবনের স্মৃতি) ‘পদক্ষেপ’ (কবিতা গ্রন্থ) ‘অভ্যুদয়’ (কবিতা গ্রন্থ) উল্লেখযোগ্য। ’৮৮ সালে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর মৃত্যুর পর- কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক কায়েস আহমেদ রচিত রথীন্দ্র জীবনী বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।

একজন প্রচারবিমুখ মানুষ হওয়ার ফলে রাজনীতি, শিক্ষকতা, সমাজ গঠনে তিনি সততা কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করলেও রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর স্বভাব ধর্ম ছিল সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী জীবন-কর্ম সবটুকু মানুষের কল্যাণে নিবেদন করে গেছেন। বিরল প্রজ মানুষ হিসেবে তিনি প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের কাছে চির জাগ্রত রয়েছেন। তার সৃজনশীলতা বাংলা সাহিত্য ভা-ারে এক অনন্য সংযোজন। তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম ভবিষ্যতের মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তার চিন্তা-চেতনা, সৃষ্টিশীলতা ও মানব প্রেম পশ্চাৎপদ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক : কবি।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test