E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাশার জর্জিস: নির্মাণে যার নন্দনের ছোঁয়া

২০২৩ জুলাই ১০ ১২:৪৮:৫১
বাশার জর্জিস: নির্মাণে যার নন্দনের ছোঁয়া

মো. সাইরুল ইসলাম

আড়ালের কারিগরেরা থেকে যান আড়ালেই। পর্দার সামনে কী আর আসা হয়? হয় না। কিন্তু মজ্জায় যার নির্মাণের নেশা, চিত্রের ভাঁজে কি আর তাঁর আশ মেটে! নান্দনিকতা যার নিউরনে লেপ্টে আছে, টুকিটাকিতে কি তাঁর মন ভরে! আকাশে ওড়তে শিখলে, আকাশ ছুঁতে যেমন ইচ্ছে করে। ঠিক তেমনই, নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদে একজন নির্মাতাও ছুঁতে চান নন্দনকে।

হ্যাঁ, একজন নির্মাতাকে নিয়েই বলা হচ্ছে।

শহরের অলিতে গলিতে ফেরিওয়ালার হাঁকডাক। মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা আর তর্কের বাহার। চারপাশে কত হাসি, কত কান্না। ভবনের প্রতিটি ইটে লেগে আছে কতশত জীবনের গল্প। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ যেন সেসব গল্পই শুনিয়ে যায়। গল্পকে যিনি চিত্রায়িত করে সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে চান, তিনি কি এসব দেখে বসে থাকতে পারেন?

না, পারেন না। পারেননি আড়ালের কারিগর হয়ে দীর্ঘদিন সবাইকে বিনোদিত করা বাশার জর্জিসও।

ভিডিও এডিটর হিসেবে শুরু করেন পথচলা। দুই দশকের পথচলায় কখনো ভিডিও এডিটিং করেছেন, কখনো ছিলেন সহকারী পরিচালক, লিখেছেন গল্প, বানিয়েছেন ওয়েব সিরিজ। সম্পাদনার টেবিলেও বসেছেন কতবার। নাটক পরিচালনায়ও নিজেকে পরখ করেছেন বেশ কয়েক বার। আর এখন তাঁকে বলা যেতে পারে একজন পুরোদস্তুর নির্মাতা। নান্দনিকতার মিশেলে বলছেন বাস্তববাদী গল্প।

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির বাংলাদেশের প্রথম ডার্ক কমেডি থ্রিলার ‘ওভারট্রাম্প’ (২০২৩) নির্মাণ করে। এতে অভিনয় করেছেন ‘হাওয়া সিনেমার - চানমাঝি’ খ্যাত চঞ্চল চৌধুরীর মতো তারকা অভিনেতা। এর প্রযোজনায় ছিলেন আরেক গুণী নির্মাতা রেদোয়ান রনি। তবে এই ‘ওভারট্রাম্প’ হচ্ছে বাশার জর্জিসের সর্বশেষ কাজ। এর আগে দুই দশকে তিনি চষে বেড়িয়েছেন কত মাঠ।

সেদিকে যাওয়ার আগে বাশার জর্জিসের জীবনের শুরুর দিকে একটু ক্যামেরা ঘুরানো যাক।

১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া বাশার বেড়ে ওঠেছেন ঢাকার মিরপুরে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশুনা সেরেছেন প্রখ্যাত এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজে।

ছেলেবেলাতেই সিনেমার প্রতি টান কাজ করতে শুরু করে বাশার জর্জিসের। একটু বড় হয়ে এই লাইনেই শুরু করেন পড়াশুনা। সিনেমা বানানো, স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শুরু করে ভিডিও এডিটিংও শিখতে শুরু করেন। নাটক সিনেমার প্রতি জর্জিসের এই টান তাঁকে নিয়ে যায় সুদূর যুক্তরাজ্যে।

যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্রিজ একাডেমি থেকে ডিজিটাল ফিল্ম মেকিংয়ে ডিপ্লোমা করেন বাশার জর্জিস। দীর্ঘদিন এ লাইনে পড়াশুনার কারণে তাঁর মননে সিনেমা বানানোর নেশা পেয়ে বসে। একই সঙ্গে নির্মাণ ও সম্পাদনার কাজ জানার কারণে তৈরি হয় চমৎকার এক মানসপট, যা তাঁকে আজকের প্রথিতযশা নির্মাতায় পরিণত করেছে।

সহকারী সম্পাদক (অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর) হিসেবে বাংলাদেশের অডিওভিজুয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেন জর্জিস। সম্পাদনায় বিখ্যাত ব্যক্তি ইকবাল কবীর জুয়েলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কাজের প্রতি বাশারের ডেডিকেশন ও প্রতিভার ঝলকের সুবাদে পরে তাঁর কাজ করার সৌভাগ্য হয় নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সঙ্গেও।

২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অভিতাভের সঙ্গেই কাজ করেছেন বাশার। শতাধিক বিজ্ঞাপনে কাজ করার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারে দারুণ কিছু অর্জন হয় তাঁর। এ ছাড়া দুইটি রিয়েলিটি শো এবং কয়েকটি টেলিফিল্মেও কাজ করেছেন তিনি।

আর এ সময়ই সবার নজরে আসে, ‘আরে, এর কালার গ্রেডিং তো চমৎকার!’

বাশারের সে সময়কার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে, ‘ইজ ইকোয়েল টু’, ‘মায়েশা’, ‘ইচ্ছে হলো’, ‘মায়া আর মৃত্যুর গল্প’, ‘শেষ আড্ডা’। আর এসব কাজের মধ্য দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত হয় বাশারের। আরও ২০০ টিভি বিজ্ঞাপনের সম্পাদনা করেছেন বাশার।

বাশারের সামনে তখন একের পর এক দারুণ সব কাজ আসতে শুরু করে। সিনেমা নির্মাণের সেই ভূত তখনো মাথায় ছিল। কিন্তু তিনি ভাবেন, আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া যাক। আড়াল থেকে একটু বের হওয়া যাক।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসির সঙ্গে যুক্ত হন বাশার। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্টের একজন প্রোগ্রাম এডিটর ও কালারিস্ট ছিলেন তিনি। এ সময়ে প্রতিভার আরও এক ঝলক দেখান। বাংলাদেশের প্রথম অতিপ্রাকৃত ডিটেকটিভ ড্রামা সিরিজ বিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাশারের নাম।

হ্যাঁ, খ্যাতিমান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের ভয়েস ন্যারেটিভে শুরু হওয়া বিটিভিতে প্রচারিত বিশ্বাস নাটকের কথাই বলা হচ্ছে। সেই আবির, জারা, লাবনী, ফেরদৌস চাচা আর বরুণের গল্প। মোহাম্মদ আলী আর শেহজাদের জটিল চাল।

সেই বিশ্বাসের কয়েকটি প্রোগ্রামের সম্পাদনার কাজ করেছেন বাশার। শুধু তাই নয়, কামালের কথা তো মনে আছে, তাই না? ইংরেজি শেখার সেই শো কি ভুলা যায়? সেই ‘বিবিসি জানালা মজায় মজায় শেখা’ নামক শো-এ এডিটিং আর কালার গ্রেডিংয়েও রয়েছে বাশারের নান্দনিক ছাপ।

বিবিসির সঙ্গে আরও একটি প্রশংসিত কাজ করেছেন বাশার। রাজনৈতিক বিতর্ক ভিত্তিক শো বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপেও যুক্ত আছে তাঁর নাম।

নির্মাতা হওয়ার যে সুপ্ত বাসনা বাশারের মনে ছিল, সেই সুযোগও এসেছে এই বিবিসির মাধ্যমেই। ২০১৪ সালে বাশারের পরিচালনায় প্রচারিত হয় জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘উজান গাঙের নাইয়া’। এ নাটকে নির্মাতা হিসেবে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি।

২০১৬ সালে জর্জিস তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ‘ইনোভাসি ফিল্মস’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের একাধারে লেখক, পরিচালক এবং সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ২০১৮ সালে তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের (ডিজিএফপি) জন্য ‘গ্রামের নাম শিমুলপুর’ শিরোনামের একটি ৪০ পর্বের নাটক লেখেন। এর পরিচালকও ছিলেন তিনি। এটি বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ডেইলি সোপ বলে মনে করা হয়।

বাশার জর্জিস ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের অর্থায়নে ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এগুলো পুনে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, গোয়া শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং টরোন্টোর দক্ষিণ এশিয়ার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত ও প্রদর্শিত হয়েছে।

এ ছাড়া বাশার জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ, ইউএসএআইডি, ইউনিসেফ বাংলাদেশ, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, প্ল্যান বাংলাদেশ, ইউএনওডিসি এবং প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক ভিডিও রচনা ও নির্মাণ করেছেন।

নির্মাণ এবং গল্প লেখায় ইদানিং বেশি সময় দিচ্ছেন বাশার। তবে তিনি তাঁর মূল ছেড়ে আসেননি। পোস্ট প্রোডাকশনের কাজে এখনো অনবদ্য এক নাম বাশার। হালের আলোচিত কোক স্টুডিও বাংলার প্রতিটি গানের ভিডিও এডিটিংয়ে আছে তাঁর ছোঁয়া। তাঁর পরশেই শ্রুতিমধুর আর নান্দনিক দৃশ্যপট উপস্থাপিত হচ্ছে সবার সামনে।

জর্জিসের অর্জনের ঝুলিও এরই মধ্যে ভরতে শুরু করেছে। সেরা ভিডিও এডিটর হিসেবে দুইবার প্রখ্যাত চারুনিরম টেলিভিশন ড্রামা অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন বাশার। এর মধ্যে একটি অমিতাভ রেজার ‘শেষ আড্ডা’ এবং আরেকটি নুহাশ হুমায়ূনের ‘হোটেল আলবাট্রস’–এ নান্দনিক কাজের সুবাদে।

সমাজের নানা সংকট নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন জর্জিস। প্রোডাকশন হাউস ‘ইনোভাসি ফিল্মস’–এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জর্জিস টিভি বিজ্ঞাপন এবং সংবেদনশীল সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় প্রেরণামূলক নাটক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আকর্ষণীয় গল্প বলার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো সবার সামনে নিয়ে আসছেন তিনি। আর এতে দর্শক যেমন বিনোদিত ও সজাগ হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিও এগিয়ে যাওয়ার রসদ পাচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test