E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাহিত্য শিল্পের ত্রৈমাসিক : প্রতিকথা’র গাজা সংখ্যা

২০১৪ নভেম্বর ৩০ ১২:৪০:১৮
সাহিত্য শিল্পের ত্রৈমাসিক : প্রতিকথা’র গাজা সংখ্যা

| আনোয়ার কামাল |

লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাস্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পত্রিকা এক নজরে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। তার মধ্যে সবচে’ বেশি যে ক’টি পত্রিকা পাঠককে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে ‘প্রতিকথা’ সেসবের মধ্যে অন্যতম। প্রতিকথার সম্পাদনা করেছেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক হানিফ রাশেদীন।
প্রতিকথা সর্বশেষ সংখ্যাটি বের করা হয়েছে ৩য় সংখ্যা জুলাই ২০১৪ হিসেবে। সম্পাদকীয় বিহীন প্রত্রিকাটি শুরুতেই কবি আবুল হাসানকে স্মরণ করে তার মাতৃভাষা কাব্যগ্রন্থের ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে; আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা/ ভালবাসার কী মাতৃভাষা/ বেদনার কী মাতৃভাষা,/যুদ্ধের মাতৃভাষ।/....../ শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,/ আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা ক্ষুধা। এ পত্রিকার মোড়ক উল্টালেই আবুল হাসানের কবিতা পড়ে পাঠক প্রথমেই নিশ্চয় চমকিত হবেন। এ সংখ্যা ‘গাজা’ সংখ্যা হিসেবে বের করা হয়েছে। এ সংখ্যায় কবি, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক এ টি এম মোস্তফা কামাল বিশ্ববিখ্যাত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, ভাষাবিজ্ঞানী, লেখক ও নোয়াম চমস্কির একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সুখপাঠ্য লেখা “গাজায় ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলা সম্পর্কে ‘ডেমোক্রেসি নাউ’- এর টকশোতে নোয়াম চমস্কির সতর্কবার্তা” মূল সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যা লেখক গাজায় ইসরাইলি হামলার শুরুর পর থেকে এটিকে একটি ভয়ঙ্কর পাশবিকতা, নির্মম, আক্রোশপূর্ণ রক্তপাত বলে আখ্যায়িত করে বর্ণনা করেছেন।
গত ৭ আগষ্ট ‘ডেমোক্রেসি নাউ’ এ গাজায় ইসরাইলি হামলা সম্পর্কে একটি টকশোতে অংশ নিয়েছিলেন নোয়াম চমস্কি। তার সাথে ছিলেন অ্যামি গুডম্যান ও হুয়ান গনসালেস। সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এ আলোচনায় নোয়াম চমস্কি ইসরাইলকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আঙিনায় ঘাস কাটা’ বলে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধ বিরতির কথা বলে হামাস যুদ্ধবিরতি করলো, আর ইসরাইল যুদ্ধবিরতি অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করবে। সে যুদ্ধ বিরতি ভেঙে যায় ইসরাইলি উসকানি আর হামাসের প্রতিক্রিয়ায়। এবারের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন আরো বেশি ধ্বংসকামী এবং আরো বেশি পঙ্কিল হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র নগ্নভাবে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার খর্ব করে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এ লেখায় সহজ ভঙ্গিমায় ভাষান্তর করে প্রকৃত নোয়াম চমস্কির জবানির সুস্পষ্ট প্রতিফলন করেছেন এ টি এম মোস্তফা কামাল। সুন্দর সাবলিল অনুবাদ, পাঠকদের পড়ার সময় ধৈর্য্যচ্যুতির কারণ হবে দাঁড়াবে না।
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন “ইসরাইলি গণহত্যাবিরোধী লড়াই সকল নিপীড়িত মানুষের”। এ প্রবন্ধে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের জন্য ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে দেখিয়ে নিজের মতলব হাসিল করবার পুরনো কৌশলকেই তুলে ধরেছেন। ইসরাইলের মতো আত্মরক্ষার কথা বলেই যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, নিকারাগুয়া, চিলি, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বহুদেশে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এ লেখায় আনু মুহাম্মদ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন, রাজতন্ত্রী মার্কিনি ভৃত্য সৌদি আর মুসলমান যেমন এক নয়, তেমনি ইহুদিবাদী ইসরাইল আর ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষ এক কথা নয়। ‘ইহুদি’ মানেই ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের এই খুনি ভূমিকার সমর্থক নয়, আবার ‘মুসলমান’ মানেই দখলদার আধিপত্যবিরোধী প্যালেস্টাইনের মানুষের প্রতিরোধ লড়াইয়ের সমর্থক নয়। কাজেই সারা বিশ্বে ইসরাইলী আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অবিশ্বাসীদের পাশাপাশি অনেক ইহুদিকেও প্রতিবাদে শরিক হতে দেখা যায়, এমন কি ইসরাইলেও তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ সবই তুলে ধরেছেন আনু মুহাম্মদ।
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রতনতনু ঘোষ “ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাই জনগণের মুক্তি” শিরোনামে লিখেছেন তথ্যভিত্তিক একটি লেখা। এ থেকে পাঠক ফিলিস্তিনিতে ইসরাইল বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা এবং তুচ্ছ বিয়য়কে কেন্দ্র করে ভারী মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান, পাবলিক স্থাপনা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানে জঘন্যতম হামলার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দেশে সামান্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সোচ্চার হয়। অথচ প্যালেস্টাইনে ইসরাইলি বাহিনীর নৃশংস তা-বে তারা নিশ্চুপ, তারা নীরব, নিষ্কিয়। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ২০১৪ সালে প্রায় ৫১দিন ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসী তান্ডবে পাঁচশ শিশুসহ দশ হাজার মানুষের মৃত্যুর বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এবার ইসরাইলি বাহিনী অবরুদ্ধ করে গেল ফিলিস্তিনির গাজা এলাকা। ১৪০ বর্গমাইল আয়তনের গাজা এলাকায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের ঘরছাড়া করার দৃশ্যাবলী পরিষ্ফুটিত করে পাঠকদের পাঠযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে এ নিবন্ধে।
আশরাফুল ইসলাম দুর্জয় লিখেছেন, “ফিলিস্তিনি জ্বলছে: প্রশ্নের মুখে মানবতা” দুর্জয়ের লেখায় সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইসরাইলি আগ্রাসনে মানবিক বিপর্যয়ের ঘৃণ্যতম ও ভয়াবহতম দিকগুলো তুলে ধরেছেন। আর জাতিসংঘের কর্তৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে এ নিবন্ধে। একদিকে বিশ্ব মোড়লরা মানবতার কথা বলছেন আর অন্যদিকে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সমর্থন দিয়ে গাজায় মানবিকতার বিরুদ্ধে প্রচ- চপেটাঘাত করছে। রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন, ধর্মীয় আগ্রাসন, জাতিগত আগ্রাসনের এই দুঃসময়ে বিশ্ব মানবতাকে এবং বিশ্ব মানবের এই হাল বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকেই তুলে ধরার আহবান জানানো হয়েছে তার লেখায়।
আকিম মহমদ এর একটি গল্প স্থান পেয়েছে “ অ্যা ডিসকোর্স অব ডিটেনশন” নামে। যা পাঠককে ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন আমেজের একটি গল্প উপহার দিয়েছে গল্পকার আকিম মহমদ। গল্পকারকে ধন্যবাদ এধরনের একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্য।
এছাড়া যেহেতু সংখ্যাটি ‘গাজা’ নিয়ে বিশেষ সংখ্যা কাজেই একঝাঁক কবির গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা রয়েছে এ সংখ্যাটিতে। পত্রিকাতে কবিদের যে ভাবে ক্রম অনুসারে পাতা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সে সূচি অনুযায়ী নাম তালিকায় রয়েছেন, মঈন চৌধুরী, মজিদ মাহমুদ, আরণ্যক টিটো, আনোয়ার কামাল, নাজনীন খলিল, কামরুল বাসার, শাফিক আফতাব, আহমেদ আলাউদ্দিন, রাজীব চৌধুরী, উপল বড়–য়া, বাবুল হোসেন, সেলিম আনোয়ার, জিয়াবুল ইবন, সালেহীন বিপ্লব, রইস মুকুল, মমিন মানব, সুজন হাজারী, এস এম মামুনুর রহমান, শিমুল আজাদ, পলিয়ার ওয়াহিদ, কুহক মাহমুদ, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম মামুন ও এনামুল হক।
সুন্দর ঝকঝকে ছাপা। পাঠক হাতে নিলেই অনিন্দ সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি সাহিত্য পত্রিকা দেখতে পাবেন। একটিও বিজ্ঞাপন নেই। সম্পাদক নিজেই পকেটের টাকা খরচ করে গাজার মানবিক বিপর্যয়ের সামনে প্রতিবাদী হয়ে প্রতিভাত হয়েছেন এ সংখ্যাটি বের করে। পত্রিকাটির দীর্ঘযাত্রা প্রত্যাশা করি।


প্রতিকথা : সম্পাদক- হানিফ রাশেদীন
উপদেষ্টা সম্পাদক : মঈন চৌধুরী
প্রচ্ছদ ও নামলিপি : মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য : ত্রিশ টাকা

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test