E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একজন রাহেলা বানু

২০১৫ জানুয়ারি ০৮ ১৮:৫০:০৪
একজন রাহেলা বানু

আরিফুন নেছা সুখী : খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে. . .। ষাটোর্ধ্ব রাহেলা বানু বিছানায় শুয়ে একা একাই ছড়া কেটে ঘুম পাড়ায় নিজেকে। এক থেকে তিনবার এর বেশি ছড়া কাটা লাগেনা, ঘুম রাজ্যে ডুব দেয় সে। কিন্তু আজ কেন জানি তার ঘুম আসে না। বিছানা ছেড়ে উঠানে গিয়ে বসে।

জোছনায় পুরো উঠান আলোকিত, পূর্ণ তিথির চাঁদ আকাশে। ছয় ছেলের মা রাহেলা বানু, পুরো বাড়িতে একা। নিঃসঙ্গতা তাকে আজ আষ্ঠেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে। বার বার মনে করার চেষ্টা করে সবাই তার কাছেই আছে কিন্তু মন যেন আজ জেনে গেছে, রাহেলা বানু একা। ছোট ছেলেটার বয়স যখন ছয় কি সাত তখন বিধবা হন রাহেলা বানু। তারপর ছয় ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করেছে। সবাই আজ যার যার মতো সংসারী। শুধু রাহেলা বানুর সংসার নেই। কিন্তু তার তো আজ ভরা সংসার হওয়ার কথা। ছয় ছেলের ঘরে পনেরটা নাতি নাতনী। অথচ সে আজ একা। ছয় ছেলের ছয়টা ঘর তাকে গিলে খেতে আসে। ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে। কতবার ছেলের বৌদের বলেছে, ঘরে তালা না লাগিয়ে যেতে; কিন্তু বৌদের কেউ শুনেনি। উল্টো তাকে এর জন্য কথাও শুনতে হয়েছে।
আজ কেন যেন বারবার খারাপ স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু তার বর্ণিল জীবনে সুখের স্মৃতি ও রয়েছে ঢের, সেগুলো আজ ছোঁয়াছুঁয়ির খেলায় ধরা দিতে চাইনা। বারবার খারাপ স্মৃতিগুলো তাকে ধরে ফেলে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, রাত ভোর হতে এখনো ঢের সময় বাকি। আবার ঘরে চলে আসে...
খাটের নিচ থেকে মরচে পড়া একটা টিনের বাক্স বের করে। এটা তার বিয়ের বাক্স। খুব যত্ন করে রেখেছে বাক্সটিকে। বার বার ছেলের বৌরা ফেলে দিতে চেয়েছে এই সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কিন্তু রাহেলা বানুর এক কথা-আমার জিনিসে কেউ হাত দিবা না, আমি মরলে, আমার সাথে সাথে আমার জিনিসপত্র ফেইলে দিও, কিন্তু যৎদিন বাঁইচা আছি আমার লগে লাগতে আসবা না। এই ঘরে কৎদিন উঠো তোমরা, যে আমার জিনিস তোমাগো জ্বালা ধরায়?
ছেলেদের বলে বৌদের কে এ বিষয়ে কথা বলতে না করায় সে। অথচ তারা সকলেই তাদের জিনিসের মায়া ষোল আনা বুঝে। বড় বৌ বাপের বাড়ি থেকে একটা বসার পিঁড়ি এনেছে, এটা নাকি তার দাদীর। যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে শোকেসে। অবশ্য নতুন করে রং লাগিয়েছে। কিন্তু তার ছেলে-মেয়ের দাদীর জিনিসপত্রের যত্ন হয় না।
এই সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে...খুব সন্তর্পণে বাক্সটা খোলে। পুরান কাপড়ের গন্ধে কাশি ওঠে তার। অনেক বলার পর পাঁচ নম্বর ছেলের বৌ তাকে নেপথোলিন এনে দিয়েছে। একটা ভাঁজ করা কাপড় মুখের সাথে চেপে অনেকক্ষণ ধরে ঘ্রাণ নেয়। গন্ধটা তাকে মাতাল করে। দীর্ঘক্ষণ ঘ্রাণ নিয়ে সে আঃ করে একটা নি:শ্বাস ছাড়ে। এটা তার বিয়ের শাড়ি। শাড়িটার ভাঁজে ভাঁজে দাগ পড়ে গেছে। ভাঁজ খুলে গায়ের ওপর এলিয়ে দেয় শাড়িটা।...
মুহূর্তে সে হারিয়ে যায় পঞ্চাশ বছর আগের দিনে। এগার বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। কত সুন্দর দেখতে ছিল সে। শাড়িটা পরে জবুথবু হয়ে বসে আছে চকচকে কাগজ দিয়ে সাজানো একটা চৌকির উপর। এমন সময় তার বয়সের দ্বিগুণেরও বেশি একটা লোক তার ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেয়। ছোট্ট বৌটা বলে-আমি মা’র কাছে যাবো।
লোকটা তার পাশে এসে বসে বলে-তুমি তো আমার বৌ হয়ে গেছ, তাই আর মায়ের কাছে যাওয়া যাবে না।
বলেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে দুটো পুতুল বের করে দেয়।
মেয়েকে পাল্কীতে উঠিয়ে দিয়ে বাবা চুপিচুপি পুতুল দুটো তুলে দিয়েছে জামাইয়ের হাতে। তা না হলে যে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে আদরের মেয়ে।
পুতুল দুটো পেয়ে খুশীতে আত্মহারা হয় সে। আস্তে আস্তে বুঝে এ মানুষটা খুব ভাল, এই মানুষটা তার খুব কাছের। কিন্তু কাছের মানুষটাকে বেশি দিন কাছে রাখতে পারলো না। যখন বুঝল স্বামী কি? তখনই স্বামী নামের কাছের মানুষটা অনেক দূরে চলে গেল। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে বিধবা হলো সে। তারপর থেকে শুরু হলো একা হাতে সংসার চালানো। ছয় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন পাষাণ প্রতিমা। কেননা সে ভেঙে পড়লে ছেলেদের কে দেখবে?
কাপড়টা গায়ের সাথে জড়িয়ে ধরে আছে এমন সময় চোখ পড়ল একটা কাগজের প্যাকেটের ওপর। প্যাকেট টা খুলতেই দেখা পেল একজোড়া রাবারের জুতার। এ সময় তার সামনে হাজির হলো আরেকটা স্মৃতি।
মেজবৌ একদিন ঘর গোছাতে এসে জুতা জোড়া ফেলে দিতে চেয়েছিল, শুধু ফেলে দিতেই চাইনি এই জন্য মেজছেলেকে বেশ কটাক্ষ করে বলেছিল
তোমার বাবা রাবারের জুতা পরতো এটা পৃথিবী সুদ্ধ সবাইকে জানান দেয়াটা কি খুব জরুরী?
ছেলে তার জবাবে একটা কথাই বলেছিল- তোমাদের মত কি বাবার জন্য নতুন করে এ্যাপেক্সের জুতা এনে সাজিয়ে রাখব!. . .
চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে রাহেলা বানুর। আর ভাবতে পারে না সে। জুতা জোড়া আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে বাক্সে রাখে।
এবার হাতে নেয় একটা হুঁক্কা। মনে পড়ে সোনালী অতীত। এই হুঁক্কা টানা নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে প্রায়ই গন্ডগোল বাধতো। দিনের মধ্যে দশবার হুঁক্কা সাজিয়ে দিতে হতো আর শুধু কি হুঁক্কা এর সাথে ছিল জর্দা দেয়া পান। পান খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটোর কথা মনে পড়ে তার। হাত বুলায় হুঁক্কাটার গায়ে।
পাশে রাখা পিতলের পানের বাঁটা। স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকে পান খাওয়াটাও ছেড়ে দিয়েছে সে।
পানের বাঁটাটা সরাতেই চোখ পড়ে কাপড়ের একটা ছোট্ট পুঁটলির দিকে খুব সাবধানে উঠায় ওটা। মনে করতে পারে না কি আছে এর মধ্যে। দুর্বল হাতে গিঁটটা খুলতে পারে না। বাধ্য হয়ে দাঁত লাগায়। এবার খুলে যায় পুঁটলিটা. . .
মনে পড়ে সেই রথের মেলার কথা, স্বামীর আনা এক ডজন কাঁচের চুড়ি। কি যে নাজেহাল করেছিল বেচারাকে সেদিন।
বুড়ো বয়সে আমি কাঁচের চুড়ি পরবো, তোমার কি মাথা খারাপ।
স্বামী তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- শুধু আমার জন্য।
চুড়িগুলো কখন যে হাতে পরে ফেলেছে টের পায়নি রাহেলা বানু। শাড়িটা এখনও গায়ে জড়ানো। হঠাৎ করে সে যেন বিশ বছরের তরুণী হয়ে উঠে। এমন সময় নিজের শরীরে কারো স্পর্শ অনুভব করে। স্পষ্ট শুনতে পায় কেউ যেন বলছে- কেমন আছো বৌ?
উপস্থিতি টের পেলে ও পুরো ঘর জুড়ে দেখা মেলেনা কারো। হাতড়ে ফেরে রাহেলা বানু। আস্তে করে বলে- আপনে কয়? আমারে দেখা দেন না কেন?
এবার যেন সত্যিই দেখা পায় সে। স্বামী তাকে আদর করে, সুখ দুঃখের গল্প করে. . .।
গল্পের এক ফাঁকে উঠে দাঁড়ায় রাহেলা বানু। বলে- আপনে বসেন, আমি পান নিয়া আসি।
বলেই বাইরে আসে।
হঠাৎ তার মনে হয়- আমি তো পান খাই না, তই পান পামু কই?
ছুটে এসে ঘরে ঢোকে। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজে কাউকে। কিন্তু ঘর যে একেবারেই ফাঁকা। ধুপ করে বিছানায় বসে পড়ে সে। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠে। মাঝে মাঝে মনটা মানতেই চাইনা সে একা পুরো একা। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। আস্তে আস্তে বিছানায় এলিয়ে দেয় শরীরটাকে।
. . . . . . . . .

কি রে বেলালের মা, খালেকের মা রে সকাল থেকে দেখছি না যে? তুই কি দেখছিস?
না চাচী বুড়িকে আজ দেখি নাই। চলো বাড়ির মধ্যে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। বাড়ির মধ্যে ঢুকেও কোন প্রকার সাড়া শব্দ পায় না তারা। চোখ পড়ে রাহেলা বানুর শোবার ঘরের দিকে। তারা ছুটে এসে দেখে ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ। বার কয়েক ধাক্কা দিয়েও ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ পায় না। তাদের কথাবার্তা ও চিল্লাপাল্লাতে আশেপাশের মানুষ ছুটে আসে বাড়ির মধ্যে।
. . . . . . . . .

কখন থেকে মোবাইলটা বাজছে, ছুটে এসে রিসিভ করে আনিসুর রহমান। রাহেলা বানুর বড় ছেলে। এক মিনিট কথা বলেই মোবাইলটা নিয়ে কোথায় যেন ফোন দিল তারপর চাকরীজীবী স্ত্রীকে বলল- শুনছো আজ অফিসে যাওয়া হবে না, খোকার স্কুল ও না করে দাও। একবার বাড়ি যেতে হবে।
. . . . . . . . .

নিঃসঙ্গ রাহেলা বানুর খালি বাড়িটা আজ লোকে লোকারণ্য। তার ছয় ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি-নাতনী সবাই এসেছে। দরজা ধাক্কা দিয়েও কোন লাভ হয় না। আর ব্যস্ত মানুষের সময় কোথায় এতক্ষণ অপেক্ষা করার। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সবাই ধরেই নিয়েছে রাহেলা বানু আর নেই। তাই তাকে শেষ বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হচ্ছে। কবর খোঁড়ার জায়গা নির্বাচন নিয়ে খানিক বাকবিতণ্ডাও হয়ে গেল ছয় ছেলের মধ্যে, কেউ বলে বাড়ির সামনে, কেউ বলে পেছনে, কেউ আবার নিজেদের জমির সাড়ে তিন হাত নষ্ট করার কোন মানেই খুঁজে পায় না তাই বলে- গোরস্থানই সবচেয়ে ভাল। আর ও দিকে ছোটছেলে মায়ের জন্য শেষ পরিধেয় কাপড় কিনে এনে খানিকটা জোর গলায় বলে বাড়ির সামনেই মা’র কবর হবে, তার শেষ ইচ্ছা বাবার কবরের পাশেই যেন তাকে রাখা হয়। কি আর করা সবাই বাধ্য হলো ছোট ছেলের কথা শুনতে। কিন্তু বাবার প্রায় নিশ্চিহ্ন কবরের সীমানা খোঁজা নিয়ে বাধল আরেক ঝামেলা, কেউ বলে এটা, তো কেউ বলে ওটা। খানিকটা ধারণার ওপর ভীত করেই কবর খোঁড়া শুরু হলো।
ছেলের বৌরা তাগাদা দিল- সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল একটু তাড়াতাড়ি কর। আর ঘরটা খোলার ব্যবস্থা করো, উনার গোছলের ব্যবস্থা করতে হবে না!
ছোট বৌটা হঠাৎই বিলাপ জুড়ে দিল- আম্মাগো আপনি আমাদের রেখে কোথায় চলে গেলেন, ও আম্মা আম্মা।
মা’র কান্না দেখে তার ছেলে সিয়াম বলল- মামনি দাদী কোথায় চলে গেছেন।
মেজ বৌটা খানিকটা ধমকের সুরেই ছোট বৌকে থামিয়ে দিল। বলল দেখ্ ছোট চুপ কর, ওরা সবাই ছোট মানুষ, মৃত্যু সংবাদ শুনে ভয় পেয়ে যাবে, তাইতো আমি কাঁদছিনা আমার ও তো কষ্ট হচ্ছে। ওর বাবাও তাই লাশ বের করতে দেরি করছে।
. . . . . . . . .

বাড়ির পেছনে বড় হাঁড়িতে নিমপাতা বরই পাতা দিয়ে পানি গরম করা হচ্ছে। পাড়ার মহিলারা নিজ দায়িত্বে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করেছে। উৎসুক লোকজন বারবার জানতে চাচ্ছে লাশ বের করা হয়েছে কিনা। এবার আসে সেই মুহূর্ত দরজা ভাঙতে হবে। সব কাজ শেষ। শুধু লাশ বের করে গোছল দিলেই. . .।
দরজা ভাঙার চেষ্টায় রত কয়েক জন দরজা নিয়েই ভূপাতিত হলো। দরজা খুলে পড়ার শব্দ শুনে আড়মোড়া ভেঙে রাহেলা বানু পাশ ফিরে শুয়ে বলে উঠলো- এই কে রে?
. . . . . . . . .

ওদিকে মাইকিং হচ্ছে, একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ. . . .।


পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test