E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দহন

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬ ১৫:০৭:১৯
দহন

ইমতিয়াজ আহমেদ
১.
প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ। এই মাত্র চলে গেল বিদ্যুৎ। ধুলোর আস্তরণ পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। দীর্ঘ ঘট ঘট শব্দ থেমে যাওয়ায় এক ধরণের নিরবতা নেমে এসেছে ছোট্ট এই ঘরটায়। গরম অনুভূত হওয়ায় ঘুমটা চট করে ভেঙ্গে গেল রূপালির। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলো হাতল ভেঙ্গে যাওয়া হাত পাখাটা। না পেয়ে একরাশ বিরক্তি জেঁকে ধরলো বিক্ষিপ্ত মনটায়। এমনিতেই কয়েক দিন ধরে মনের আকাশটা ভালো যাচ্ছে না। বার বার মেঘ করে বেড়াচ্ছে সেখানে। ঝড় উঠছে মাঝে-মধ্যে। আবার শান্ত হয়ে আসছে। তবে পুরোপুরি থেমে যাচ্ছেনা ওই ঝড়।

বিরক্তি নিয়েই বিদ্যুতের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে বিছানা থেকে নেমে আসলো রূপালি। সবে ১৮ তে পা দিয়েছে মেয়েটি। গায়ের রংটা একটু শ্যামলা। মাঝারি উচ্চতা। গোলগাল মুখ। চোখ দুটো অসম্ভব মায়াময়। মায়াময় বলতে ,যে চোখের দিকে তাকালে সহজেই ফিরিয়ে আনা যায়না দৃষ্টি। এক কথায় প্রথম দেখাতেই ভালো লাগতে হবে এই মেয়েটিকে।
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল। বাইরে কড়া রোদ। বাতাস নেই বললেই চলে। যেটুকু বাতাস আসে তা আশেপাশের উচু অট্টালিকায় বাধা পেয়ে পৌছাতে পারে না ও রূপালিদের ছোট্ট এই দুই কামরার আশ্রয়টিতে।
বিছানা থেকে নেমে ঘরের একটি মাত্র জানালা খুলে দিল রূপালি। ঘরের ভেতরের আবছা অন্ধকারটুকু যেন একটু কমলো।
প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। মাটির কলস থেকে মগে পানি ঢেলে নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল। ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা পানির বিন্দু গায়ের উড়না দিয়ে মুছতে মুছতে আবার বিছানায় বসে পড়লো।
আজকাল মাটির কলসে পানি রাখে না কেউ। পানি রাখার জন্য মাটির কলস নিয়ে আসায় সেদিন বাবার সাথে কি বাজে আচরনই না করেছে সে। অথচ বাবা বলেছে গরমে মাটির কলসে পানি ঠান্ডা থাকে। কাজ করে এসে একটু ঠাণ্ডা পানি খেলে প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় মন। আজ তা বুঝতে পেরে মনে মনে কষ্ট অনুভর করছে রূপালি বাবার সাথে খারাপ আচরণ করার জন্য। বাবা কিন্তু একটুও মন খারাপ করেনি সেদিন। হাসতে হাসতে বলেছে কয়েকদিনে মধ্যেই তোকে সুন্দর একটা জগ কিনে দেবো। তুই সেই জগে করেই পানি খাস।

মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা কেমন যেন হয়ে গেছে। তার সব কিছু ঠিক আছে কিন্তু বাবাকে দেখলেই মনে হয় তার মনটায় বয়ে যাচ্ছে কোন কষ্টের স্রোত। অথচ বাবা কখনোই বুঝতে দিতে চান না তার কষ্ট। কিন্তু আমি তো বুঝি; আমিতো তার মেয়ে!
মা মারা গেল, তখন আমার বয়স মাত্র ১২। তবে সংসার জীবন তারও আগে থেকেই বুঝতে শিখেছি। বুঝতে শিখেছি কোন কিছুর জন্য শখ জাগলেও তা পূরণ করা যাবে না। বুঝতে শিখেছি পরনের জামা-কাপড়ের যত্নের কমতি করা যাবে না। দুপুরের খাবারে মাছ না থাকলেও আপত্তি করা যাবে না।
হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে মায়ের চলে যাওয়া আমার ছোট্ট মনে যে কষ্টের পাহাড় তৈরি করে দিয়েছে তা আজও বুক চাপা দিয়ে রেখেছে আমাকে। মা যেদিন চলে গেল সেদিন আমাকে জড়িয়ে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বুকের পাঁজর বের হয়ে যাওয়া আমার বাবার সে কি কান্না! অথচ আমি, সেই বারো বছরে বালিকা; যার চোখ দিয়ে ঝরে পড়েনি এক ফোঁটা অশ্রু। সেদিন কোথায় ছিল আমার চোখের জল? যে জলে এখন ভিজে যায় মায়ের হাতের কাজ করা আমার প্রিয় বালিশটার কভার। কাঁদতে পারিনি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম তখন থমকে গিয়েছিল আমার সময়, আমরা চারপাশ, আমার সবকিছু। থমকে গিয়েছিলাম আমি। সেদিন কাঁদিনি। অথচ সেই কান্নাই আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এখনও।
মা মারা যাওয়ার পর বাবার একমাত্র যক্ষের ধন এই আমাকে নিয়ে বাঁচার সংগ্রামে যান্ত্রিক এই নগরে চলে আসা। যেখানে কেউ করো দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পায় না। সবারই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমারও অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। এখন আর হয় না। মানুষের সহ্য করার ক্ষমতা অনেক।
বিছানায় বসে বসে এসব ভাবছে রূপালি।
ঘামে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া জামাটা এখন আঠার মতো লেগে আছে শরীরের সাথে। কখন থেকে যে ধুলোর আস্তরণ পড়া ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করেছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসেছে বিদ্যুৎ। ঘট ঘট আর ক্যাচ ক্যাচ শব্দটা মাঝে মাঝে বাড়ছে আবার কমছে।
দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা এখন তিনটা ছুঁই ছুঁই করছে। সকালের রান্না করা খাবার খেয়ে রূপালি ঘুমিয়েছিল। বাবার ফিরতে বিকেল হবে। আর রাতের খাবার রান্না করতে হবে এখন। বাবা এসে খাবে।
আজ রূপালি ছুটি নিয়েছে কাজ থেকে। একটানা ভালো লাগে না কাজ। কিন্তু ভালো না লাগলেও যে করতে হয়।
‘বাবাতো সেই যে কবে থেকেই কষ্ট করছে। তার কষ্টটা একটু কমানোর জন্যই তো আমার কাজ করা। বরং কষ্ট লাগতো আমি কাজ করতে না পারলে। বাবা কাজ করছে বলেই আমি মাঝে-মধ্যে কাজে না গিয়েও থাকতে পারি। বেতন কাটা গেলেও কষ্ট লাগে না। বাবা যে পুষিয়ে দেন সেটুকু।’


২.
গরমের তেজটা কমে এসেছে একটু। সূর্যটা এখন আর মাথার উপর নেই। হেলে পড়েতে শুরু করেছে পশ্চিমে একটু একটু করে। ঘড়ির কাঁটা তিনটে পার করেছে কিনা তার সঠিক হিসেব জানা নেই রহমত মিঞার। তবে মনে মনে ভাবছে সাড়ে তিনটার কম হবে না এখন। আজকে গরমের মাত্রা দুপুরে ছিল অনেক বেশি। ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে হাঁপিয়ে উঠেছিল অন্যান্য দিনের চাইতেও বেশি। তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি ফেটে যাবে বুকের ছাতি।
হাড় গুনতে পারা বুকের খাঁচাটা নেহাতই নরম নয় তার। পেশিবহুল শরীর না হলেও রোগাক্রান্ত নয় রহমত মিঞা। আগের চাইতে এখন পরিশ্রমের দিকে নজর দিয়েছে বেশি। কাজ করছে বেশি। কিভাবে কাজ খুঁজে পাওয়া যাবে তার দিকেও এখন আলাদা খেয়াল।
নিয়মিত গ্রাহকদের পাশাপাশি নতুন গ্রাহকদের কাজও যাতে করতে পারে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। মেয়ের বয়স হয়েছে তার। বিয়ে দেবার একটা চিন্তা মাথার অনেকটাই এখন দখল করে নিয়েছে। চার সন্তানের পর একমাত্র বেঁচে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে অনেক ভাবনা তার। ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করাবে মেয়ের। কিন্তু তা আর হলো না। মেয়ের বারো বছর বয়সে মারা গেল তার স্ত্রী। গ্রামের অনেকেই আবার বিয়ে করার জন্য চাপাচাপি করছিল। কিন্তু মনে সায় দেয়নি। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চলছে তার জীবন সংগ্রাম।
তপ্ত পিচঢালা পথ থেকে গরম তাপ লাগছে পায়ের তলায়। ক্ষয় হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের স্যান্ডেলের তলানিতে কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। পায়ের পাতা মাঝেমাঝে লেগে যাচ্ছে তলানি ভেদ করে তপ্ত পিচে। তখন মনে হচ্ছে কে যেন কয়েকটি সূচ গেঁথে দিচ্ছে পায়ের নিচে। তবে হাঁটার গতিতে সবসময় এমনটা লাগছে না।
কোত্থেকে যেন একটু বাতাস এসে লাগলো চোখে-মুখে। হালকা ঠাণ্ডা-গরম মেশানো বাতাসটায় অন্যরকম এক প্রশান্তি বোধ করলো পরিশ্রমী শরীরটা।
আজ সন্ধ্যের আগেই ফিরে যেতে হবে। আজ দুইটি খ্যাপ বেশি দিয়েছে সে। একটু একটু করে জমানো হচ্ছে টাকা। আর এ জন্য পরিশ্রম তো বেশি একটু করতেই হবে। মনে মনে ভাবলো রহমত মিয়া।
আজ ঠেলার মালিক ও তার সহকারীকে দেবার পরও নয়শত ত্রিশ টাকা তার নিজের থাকছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে তা ভালোই বেশি। মনে মনে বললো, এরকম যেন রোজই হয়।
আজ এ টাকা থেকে মেয়ের জন্য ক্ষীরের সন্দেশ নিয়ে যাবেন তিনি। মেয়েটা তার ক্ষীরের সন্দেশ খুব পছন্দ করে। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। ওর মারও পছন্দ ছিল ক্ষীরের সন্দেশ।
কিন্তু ক’দিন খাইয়েছিল রহমত মিঞা ক্ষীরের সন্দেশ! বুঝতে শেখার পর কখনো আবদার পর্যন্ত করেনি তার বুকের ধন কোন কিছু নিয়ে। অভাবী সংসার; ভেবেই মেয়েটা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর সবসময়। বাবা হয়ে তারও তো মনে চায় মেয়েটাকে ভালো-মন্দ কিছু দিতে। কিন্তু বাস্তবতা যে একটু কঠিন। চাইলেই শখ পূরণ হয় না তার সংসারে।
অর্থ-কষ্টে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারেনি সে। মরণব্যাধি শরীরে নিয়ে যে ক’দিন বেঁচে ছিল কখনোই ভেঙে পড়তে দেননি স্বামীকে। বুঝতে দিতেও চাননি এমন ভাবে চলেছে সে।
কিন্তু রহমত মিঞার অন্তর তো ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বারবার। যতবার তাকিয়েছিল প্রিয়তম স্ত্রীর মুখের দিকে।
যুবক বয়সে রহমত মিঞার যৌবন ছিল টগবগে। ফর্সা শরীর রোদ্রের তাপে ধারণ করেছিল তামাটে বর্ণের। তার মরে যাওয়া স্ত্রী পারুল তামাটে বর্ণের শরীর,কালো কুচকুচে চুল ও নজরকাড়া চাহনি দেখেই এক রকম প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল । রহমত মিঞাও সাড়া দিয়েছিলেন। তবে ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো এই রহমত মিঞা চাননি তার অভাবী-কষ্টের জীবনে পারুলের মতো রুপবতী একটা মেয়েকে জড়িয়ে কষ্টের সাগরে ভাসতে।
কিন্তু তারা যে ভালোবেসেছিল পরস্পরকে। সত্যিকারের ভালোবাসা। কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিতে প্রস্তুত ছিল পারুল।
যৌবনের কথা ভাবতে ভাবতে সময়ের কথা ভুলে গিয়েছিল রহমত। তার যে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে আজ।
মেয়ে রয়েছে তার জন্য পথ চেয়ে। মেয়েটা আজ কাজে যায় নি। মাসে দু’এক দিন যায় না। বাবাকে রান্না করে খাওয়ায় সেদিনগুলোতে। তাছাড়া রহমত মিঞাকে দুপুরের খাবার খেতে হয় রাস্তার পাশের ফুটপাতের কোন সস্তা হোটেলে। অধিকাংশ দিনই খাবারের তালিকায় থাকে ডিমের ঝোল,একটি কাঁচা মরিচ,পেঁয়াজ আর দু’টুকরা লেবু। রোজ রোজ একই খাবার খেতে কার ভালো লাগে। যেদিন মেয়েটা তার জন্য রান্না করে সেদিনের খাওয়া হয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খাবার। এমনই ভাবে এই পরিশ্রমী মানুষটা।
‘নাহ্ আজকে বেশিই দেরি হয়ে গেল’ বিড় বিড় করে বললো কথাটা। সূর্যটা বড় বড় অট্টালিকার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। মাঝে মাঝে আসছে বাতাসের একটু-আধটু ঝাপটা। তবে বেশির ভাগ সময়ই থাকছে গরমের তেজ। শরীর জ্বালা করা গরম। ঠেলাগাড়িটা মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে কপাল ও গালে ঘাম শুকিয়ে জমে থাকা লবনের কণা ঘামে ভেজা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি বলতে ভাড়া করা ছোট্ট দু’কামরার একটা ঘর। খুব বেশি দূরে নয়; হাঁটলে বড়জোড় দশ মিনিটের পথ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটা শুরু করলো ঘরের দিকে। ততক্ষণে রাস্তার পাশের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে।


৩.
বছর হতে লাগলো ওর সাথে রুপালির পরিচয়। প্রথম যেদিন ছেলেটিকে এক নজর দেখে সে দিনই আটকে গিয়েছিল তার দুচোখ। পুরো এক মিনিট তাকিয়েছিল ছেলেটির দিকে। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। বড় বড় চোখের পাপড়ি, গভীর কালো দু’চোখ। প্রথম দেখাতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠেছিল রূপালীর। অদ্ভুত ভালো লাগায় সেদিন ছেয়ে গিয়েছিল রূপালির সমস্ত সত্তা। মনের ভেতরে সেদিন বেজে উঠেছিল কেমন এক রিনিঝিনি বাঁশির সুর। পরক্ষণেই আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। মনে মনে ভাবে কি সব ভাবছে আজেবাজে।
এরকম ভাবনা কি তার আসা উচিৎ মনের ভেতর। নাহ্ এত দিনের এই আমি যে কখনো এই সবের ধারে-কাছে যায়নি। কত জনের কত কথা, দেয়া কত আশ্বাস, কত জনের রক্তচক্ষুর চাহনি, কত জনের ‘তোমায় ছাড়া এ জীবন বৃথা’ টাইপ কথায় নিজেকে নড়তে দেয়নি। সেই আমি কেমন করে নতুন এই ছেলেটা, যাকে চিনি না-জানি না, আজই যাকে দেখলাম, তাকে নিয়ে এই ভাবনা, কোনমতেই ভাবা ঠিক হয়নি। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিল রূপালি। ছি.ছি.ছি!
নয়ন নামের এই ছেলেটি যেদিন প্রথম কাজে এসেছিল; সেদিন থেকেই উলট-পালট হয়ে গিয়েছিল রূপালির সত্ত্বা। রূপালি চায়নি, এমনটা হোক। কিন্তু কোত্থেকে কিভাবে যে হয়ে গেলো তা বোঝার সময়টুকুও পায়নি সে। তবে প্রথম সে বুঝেছিল যেদিন অসুস্থ থাকায় নয়ন কাজে আসেনি। কেমন যেন লেগেছিল রূপালির। তার সকল কাজেই সেদিন ছিল কেমন এক শূন্যতা। মন বসছিল না কাজে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবারই চোখ যাচ্ছিল সামনের ডান দিকের শূন্য ডেস্কের দিকে। নিরবে পড়ে থাকা কর্ম-ব্যস্ততায় অভ্যস্ত থাকা মেশিনটা। ওই দিনই বুঝেছিল কিছু একটা হয়েছে তার।
এই কিছু একটা মনের ভেতর নিরবে-কষ্টে লালন করে বেড়াচ্ছিল রূপালি। একটুও বুঝতে দেয়নি কিছু। তবে এতদিনে দেখা শান্ত-চুপচাপ থাকা ছেলিটি; একটু পরে হলেও চোখ পড়ে রূপালির দিকে। রূপালির ভালো লাগতো, যখন নয়ন কাজের ফাঁকে তাকাতো তার দিকে। তখন কৃত্রিম রাগ ফুটতো রূপালির চোখে-মুখে। তবে মনে মনে তার ভালোই লাগতো। তা দেখে আবার মুচকি হাসতো নয়ন।
দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হতে থাকা এই যুবক নয়ন। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে বাবা থেকেও নেই তার।
অনেক আগেই অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে দেশান্তর। তার পর থেকে আর কোন খোঁজ নেয়নি তাদের। তারাও খোঁজ নিতে চায়নি তার। দরিদ্র পরিবারে মায়ের অশ্রু দেখতে দেখতে বড় হওয়া নয়নের বুকে জমাট বাধা কষ্ট তার মাকে নিয়ে। বাবা নামের প্রাণীটার নিষ্ঠুর আঘাতে আঘাতে রোগে জর্জরিত তার মায়ের জীবন সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করতে তার এই পোশাক কারখানায় তার কাজে আসা।
এই অভাবী সংসার-জীবনে কাজ করে অর্থ উপার্জন ছাড়া অন্য আর কি ভাবতে পারে সে। এ মনে যে সে ভালোবাসার ছায়াটুকু আসতে দিতে চায়না। চায় না সময় নষ্ট করতে। সময় নষ্ট না; আসলে মনের মাঝে একটা ভীতি কাজ করে তার। ভালোবাসার মায়াজালে জড়িয়ে টিকে থাকতে পারবে কি সে? এই চিন্তাটাই সব সময় তার।
কিন্তু ভালোবাসা তো চিন্তা-ভাবনা করে হয়না। এমনি এমনিই হয়ে যায়। কি ভাবে যেন মনের ভেতর তৈরি হয়ে যায় তা ধরা যায় না সহজেই।
তবে রূপালি তার নজর কেড়েছিল। প্রথম কাজে আসার পর থেকেই। কিন্তু প্রকাশ যাতে না পায় সেভাবেই ছিল সে এতদিন।
বছর পার হতে চললো তাদের দুজনের প্রণয়ের সময়। এরই মাঝে নয়নও নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো দুজনের সংসার তৈরি স্বপ্নে। বাড়িতে বলা হয়েছে তার। তার মা’র কোন অমত নেই। শুধু বলেছেন, আর ক’টা দিন যাক। নয়নও ভেবে রেখেছে আর কিছু দিন যেতো হবে তার। কল্পনা আর বাস্তবতায় বিস্তর ফারাক। তারপরও কল্পনাকে আশ্রয় করেই তো মানুষের বেঁচে থাকা।
চুপচাপ স্বভাবের নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে রূপালি বুঝতে পেরেছিল নয়ন নামের এই ছেলেটা তার মতোই দু:খী। দু:খী দুটি মনের মিলে রচনা হবে একটি মন। যে মনে দু:খের পাশাপাশি থাকবে সুখের পরশ।
একদিন নয়ন বলেছিল,‘ এই আমাকে যতটা দেখো, আমার ভেতরটা তেমন নয়। মুক্ত পাখির মতো বেঁচে থাকতে আমি পারি না। আমার চারদিক শক্ত শিকলে বাধা পড়ে আছে। ভালোবাসা আমি বুঝতে চাই না। বুঝতে চাই না তা নয়। আসলে ভয় হয়। ভালোবাসতে ভয় হয় রূপালি। আমার কষ্টের জীবনটায় চাই না সহজেই কাউকে জড়াতে। আর ভালোবেসে কাউকে ফিরিয়ে কিভাবে দেব আমি?’
নয়নের কথায় রূপালির সমস্ত সত্ত্বা কেঁপে উঠেছিল। ‘দরিদ্রতা নামের এই ভয়ংকর ব্যাধির কাছে ভালোবাসা পরাজিত হবে! না, ভালোবাসা স্বর্গীয়। দরিদ্রতাকে জয় করবে। বুঝতে পারার পর থেকে দেখে আসা সংসারের অভাব-অনটন। পরিশ্রম দিয়েই দূর করবো সব।’ নয়নকে বলেছি, ‘তুমি পাশে থাকলে, দু’জনে মিলে কষ্টকে দূর করার যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারবো।’ নয়ন মুচকি হেসেছিল। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম এক আত্মবিশ্বাসী চেতনা। চিকচিক করছিল মৃদ জলে ওর দু’চোখ। এ জল সাহসের! এ জল দরিদ্রতা জয় করার প্রেরণা!


৪.
এনাম মেডিকেলের এম্বুলেন্স এর সাইরেন আর রাস্তার ধুলায় ভারী হয়ে আছে এই এলাকার বাতাস। পাশেই অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। ইতিহাসের ঘৃণ্যতম সাক্ষী হয়ে বিদ্যালয়ের মাঠ জুড়ে পরে রয়েছে বড় বড় সাদা ব্যাগের সারি। পরম মমতায় সেই ব্যাগ সামনে রেখে বসে আছে অসংখ্য মানুষ। নির্বাক তাদের চাহনি। মাথার উপর রোদের কড়া তেজ।
ঘামে ভিজে যাচ্ছে সেই ব্যাগের মালিকেরা। কাজ শেষ হলে ব্যাগের ভারী বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। কেউ ছুটে আসছে, আবার যাচ্ছে। এসে দেখছে সারি বাধা ব্যাগের কোনটা তার। পেলে সেখানেই বসে যাচ্ছে, ব্যাগ সামনে রেখে। ঝরতে ঝরতে শেষ হয়ে শুকিয়ে যাওয়া দু’চোখ আবারও ভিজে যাচ্ছে তাদের। বুক ভেঙে আসছে বারবার। তবে নিজেকে বুঝ দিচ্ছে অনেকেই, পেলাম তো শেষ পর্যন্ত!
রহমত মিঞাকে আজ বড় অচেনা লাগছে। বুকের পাঁজর গুনতে পারা অথচ শক্ত সেই রহমত মিঞার বয়স আজ যেন বেড়ে গেছে অনেক। অনেকের মতো সেও বসে আছে সাদা একটি ব্যাগ সামনে রেখে। হারিয়ে যাওয়ার পাঁচ দিন পরে আজ দেখা মিলল তার যক্ষের ধনের।
ব্যাগে ভরে রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাগ কিভাবে নেবে সে! এ ব্যাগের ওজন যে এত ভারি! সে কী পারবে বয়ে নিতে! কিন্তু নিতে তো তাকে হবেই। এর জন্যই তো তার ক’দিনের নিরন্তর খুঁজে চলা।
কয়েক মিনিটের ব্যবধান। এরই মাঝে শেষ হয়ে গেছে অসংখ্য স্বপ্ন। স্বপ্নের কারিগর। নিজেদের স্বপ্ন, স্বপ্নই রেখে, আরো কয়েকজনের স্বপ্ন, বাঁচার আশার মৃত্যু ঘটিয়ে তারা আজ কোথায়? নরম, কোমল, কর্মচঞ্চল দেহটা তাদের মিশে গেলে কংক্রিটের সাথে।
মাথার উপর থাকা ছাদটা মেঝের কাছাকাছি নেমে আসার আগ মূহুর্তেও প্রবল দায়িত্ববোধ নিয়ে সকলেই ব্যস্ত ছিলো নিজের কাজে। আর নানা স্বপ্ন বুনতে ছিল সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে।
কোথায় গেলো দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে দারিদ্রকে জয় করে দুটি মনের ঘর বাধার বাসনা। কোথায় হারিয়ে গেলো সব হারানো বাবার এক মাত্র অবলম্বন তার মেয়েটি। কোথায় আজ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা স্বামী পরিত্যক্তা এক মায়ের সংসারের হাল ধরা অন্ধের যষ্ঠি।
বেলা বেড়ে যাচ্ছে। মাথার উপরের রোদ এখন পশ্চিমে হেলেছে একটু। গরমের তেজ কমেনি বরং বেড়েছে।
বিদ্যালয়ের মাঠের পাশের রাস্তায় দাঁড় করানো ঠেলাটার দিকে সাদা ভারি ব্যাগটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে রহমত মিঞা। আরো দু’জন কারা যেন ব্যাগটা বয়ে নিতে সাহায্য করছে তাকে।
ঠেলাগাড়িটা নিজের কোমরে বাধা গামছা দিয়ে ভালো করে মুছে বুক ভরা মমতায় তার উপর আলতো করে নামিয়ে দিল ভারি সাদা ব্যাগটা। যেন কোন নবজাতককে মা শুইয়ে দিলেন তুলতুলে কোন এক বিছানায়।
কপাল বেয়ে টপ টপ ফোঁটায় ঝরছে ঘাম। কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত একটু বাঁকা হয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ঠেলাগাড়িটা। যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। হঠাৎ মেঘ এসে আকাশটা ঢেকে দিয়ে গেলো। কিছুদূর যেতেই শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি। আকাশও কাঁদতে শুর করলো কান্নারত অসংখ্য মানুষের সাথে। ভিজতে লাগলো দহনে জ্বলতে থাকা রহমত মিঞা। ভিজিয়ে দিতে লাগলো ঠেলাগাড়ির উপর পরে থাকা সাদা ব্যাগে ভরা রূপালির নিস্প্রাণ দেহটি!

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test