E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বপ্নদলের ‘চিত্রাঙ্গদা’-নারী পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্ক ও অন্তর্দ্বন্দ্বের মহাকাব্য

২০১৪ মে ১৩ ০৮:১৭:৪৫
স্বপ্নদলের ‘চিত্রাঙ্গদা’-নারী পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্ক ও অন্তর্দ্বন্দ্বের মহাকাব্য

পীযূষ সিকদার : স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বাঁচে। অথবা কেউ বাঁচে স্বপ্ন দেখিয়ে। আবার কেউ কেউ স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে যা সে দেখে অথবা দেখাতে চায় বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এও হয় অনেকেই জীবনে স্বপ্ন দেখে দেখে জীবনটা শূণ্য করে ফেলে। যাদের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে অথবা এখনো স্বপ্ন দেখে অথবা এখনো আমাদের স্বপ্ন দেখাতে পারে এমন একজন নাট্যজন জাহিদ রিপন। স্বপ্নদল (DREAMTEAM) থিয়েটারে স্বপ্নের বীজ পুতে পুতে সেই ১০ আগস্ট ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে 'ঐতিহ্য অন্বেষণে শৈল্পিক শুদ্ধতা' এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ফলবতী হয়েছে বাঙলার সুপ্রাচীন নাট্য-ঐতিহ্যের বিনির্মানে। শৈল্পিক শুদ্ধতা অর্জনে 'স্বপ্নদল' তথা জাহিদ রিপন নাট্যজীবন ও ব্যক্তি জীবনকে সমান্তরাল ভাবে দেখে।

আমরা ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে পড়তাম। ওই সময়েই আমি দেখেছি দূর থেকে ও যেন নাটকেই ঘর বেঁধেছে। জাহিদ রিপন ও নাটক আলাদা করার উপায় নেই। রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো সেখানে জাহিদ রিপন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নাট্য সম্পাদক নির্বাচিত হলো। ওর হাত ধরেই কলেজের বার্ষিক নাটকে আমার ডাক পড়লো। তারপর থেকেই ওর সাথে আমার নাট্যবাস। রিপন নাটকের টানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হয়। আমিও একই গুরুর পদে ভক্তি দিলাম। আমরা থাকতাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের ২২২ নং কক্ষে। ওর থিয়েটার ভক্তি ও চর্চা আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করতো। সেই মুগ্ধতা 'চিত্রাঙ্গদা' প্রযোজনার মধ্য দিয়ে আরো বেশী আলো ছড়ালো। যদিও আমি একই গুরুর শিষ্য কিন্তু আমি আমার বন্ধু জাহিদ রিপনের কাছ থেকে কম শিখিনি। শিখেছি কর্মযোগ। সেই যোগের প্রয়োগে জাহিদ রিপনের হাত ফলিয়েছে সেলিম আল দীনের 'হরগজ', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর', কাজী নজরুল ইসলামের গল্প অবলম্বনে 'পদ্মগোখরো', বাদল সরকারের 'ত্র্রিংশ শতাব্দী', আরব্য রজনী অবলম্বনে 'জাদুর প্রদীপ'(মাইমোড্রামা), কাজল রেখা, বিদ্যাপীঠ (পরিবেশ থিয়েটার) দেওয়ান গাজীর কিস্সা, ইঙ্গিত, সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি' বাংলা নাট্য ইতিহাসে এক একটি থিয়েটার যোগ।

স্বপ্নদলের একাদশ প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা'।এ প্রযোজনাটি সার্ধশত রবীন্দ্রবর্ষে স্মারক-প্রযোজনা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থানুকুল্যে নির্মিত হয়েছে।

আজ লিখতে বসেছি অথবা না লিখলে আমার ভেতরকার কথাগুলো বলা হবে না অথবা না লিখলেও যে ক্ষতি হবে মহাকালের-তা আমি মনে করি না। তবু লিখতে হলো আমাকে। আমার ভাললাগার জায়গা থেকে। চারিদিকে কলুষ, হত্যা, গুম, লোভ-তারই সমান্তরালে চলে শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে জাহিদ রিপন নির্দেশিত কাব্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা'। আমাকে ভাবায়। আমার মনে হয় ০৭ মে, ২০১৪ তারিখ মঞ্চায়িত কাব্যনাট্য দেখতে আসা সকল দর্শককেই ভাবিয়েছে! বাহ্যিক রুপ নাকি ভেতরের রুপ-তার আসল সৌন্দর্য্য!

সৌন্দর্য্যরে আড়ালে ঢাকা পড়ে মানুষের প্রকৃত মুখ। এ যেন মুখোশ। আমরা হাঁটি চলি বলি মুখোশে মুখোশে। সেই মুখোশ উন্মোচনের এক নিত্যপুরাণ জাহিদ রিপন নির্দেশিত 'চিত্রাঙ্গদা'।

১৮৯২ সালে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কাব্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা'। ১৯৩৬ সালে ৭৫ বছর বয়সে লেখেন নৃত্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা'। নৃত্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা' দেশে-বিদেশে নানা দলের মাধ্যমে মঞ্চায়িত হয়েছে। কিন্তু কাব্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা' আধুনিক মঞ্চে নিয়মিতভাবে মঞ্চায়নের তেমন কোন খবর পাই না। কিন্তু জাহিদ রিপন তথা তার 'স্বপ্নদল' সাহসভরে এ প্রযোজনাটি করেছে এবং নিঃসংকোচে বলা যায় এটি একটি শিল্পশিদ্ধ প্রযোজনা। সমান্তরালে ঢুকে যাই সমকালীন নর-নারীর প্রেম, চাওয়া, পাওয়া, না পাওয়া, বেদনা এক হয়ে মিশে যায় রক্তমাংসের মানব-মানবীতে যেখানে আছে প্রেম, দ্রোহ,অন্তর্দ্বন্দ্ব...আছে পাশাপাশি সম্মানাবস্থান।

'চিত্রাঙ্গদা' কাব্যনাট্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা উপাখ্যান অবলম্বনে কিছুটা রুপান্তর করে রচনা করেন। এই নাট্যকাহিনীতে দেখা যায় মহাবীর অর্জুন সত্য পালনের জন্য একযুগ ব্রক্ষ্মচার্যব্রত গ্রহণের নিমিত্তে বনে এসেছেন। চিত্রাঙ্গদা-মনিপুর রাজকন্যা। বনেরই মানসকন্যা। একদিন হঠাৎ বনের মধ্যে মহাবীর অর্জুনকে দেখে এবং তার প্রতি প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু মহাবীর অর্জুন বাহ্যিক রুপহীন চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করে। এতে চিত্রাঙ্গদা অপমানিত হয় এবং অন্তর্জ্বালায় জ্বলতে থাকে। নিজেকে ধিক্কার দেয়। এক সময চিত্রাঙ্গদা কামদেব মদন ও যৌবনের দেবতা বসন্তদেবের সহায়তা প্রার্থনা করে। চিত্রাঙ্গদার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। তাঁরা চিত্রাঙ্গদাকে এক বছরের জন্য অপূর্ব সুন্দরী করে দেন। অর্জুন প্রেমে পড়ে চিত্রাঙ্গদার। এক সময় চিত্রাঙ্গদার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে! অর্জুন কী প্রকৃতঅর্থে তাকে ভালবাসে নাকি তার বাহ্যিক রুপ-সৌন্দর্য্যকে তার অস্তিত্ত্বকে ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই চিত্রাঙ্গদার উপলব্ধি হয় বাহ্যিক রুপের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মানুষের চারিত্রশক্তি এবং এতেই প্রকৃতপক্ষে আত্মার স্থায়ী পরিচয়।

কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
'অনেক বছর আগে রেল গাড়ীতে যাচ্ছিলুম শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার দিকে। তখন বোধ করি চৈত্রমাস হবে। রেল লাইনের ধারে ধারে আগাছার জঙ্গল। হলদে বেগুণী সাদা রঙের ফুল ফুটেছে অজস্র। দেখতে দেখতে এই ভাবনা এল মনে যে আর কিছুকাল পরেই রৌদ্র হবে প্রখর, ফুলগুলি তার রঙের মরীচিকা নিয়ে যাবে মিলিয়ে-তখন পল্লীপ্রাঙ্গণে আম ধরবে ডালে ডালে, তরু প্রকৃতি তার অন্তরের নিগুঢ় রস সঞ্চয়ের স্থায়ী পরিচয় দেবে আপন অপ্রগলভ ফলসম্ভারে। সেই সঙ্গে কেন জানি হঠাৎ আমার মনে হল সুন্দরী যুবতী যদি অনুভব করে যে সে তার যৌবনের মায়া দিয়ে প্রেমিকের হৃদয় ভুলিয়েছে তা হলে সে তার সুরুপকেই আপন সৌভাগ্যের মুখ্য অংশে ভাগ বসাবার অভিযোগে সতিন বলে ধিক্কার দিতে পারে। এ যে তার বাইরের জিনিস, এ যেন ঋতুরাজ বসন্তের কাছ থেকে পাওয়া বর, ক্ষণিক মোহ-বিস্তারের দ্বারা জৈব উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার জন্য। যদি তার অন্তরের মধ্যে যথার্থ চরিত্রশক্তি থাকে তবে সেই মোহমুক্ত শক্তির দানই তার প্রেমিকের পক্ষে মহৎ লাভ, যুগল জীবনের জয়যাত্রার সহায়। সেই দানেই আত্মার স্থায়ী পরিচয়, এর পরিণামে ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, অভ্যাসের ধূলিপ্রলেপে উজ্জ্বলতার মালিন্য নেই। এ চারিত্রশক্তি জীবনের ধ্রুব সম্বল, নির্মম প্রকৃতির আশু প্রয়োজনের প্রতি তার নির্ভর নয়। অর্থাৎ এর মূল্য মানবিক, এ নয় প্রাকৃতিক। এই ভাবনাটাকে নাট্য-আকারে প্রকাশ-ইচ্ছা তখনই মনে এলো, সেই সঙ্গেই মনে পড়ল মহাভারতের চিত্রাঙ্গদার কাহিনী। এই কাহিনীটি কিছু রুপান্তর নিয়ে অনেক দিন আমার মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল। অবশেষে লেখবার আনন্দিত অবকাশ পাওয়া গেল উড়িষ্যায় পান্ডুয়া বলে একটি নিভৃত পল্লীতে গিয়ে।'

স্বপ্নদল পাত্র-পাত্রীদের দ্বারা অসাধারণ দেহভাষা ও বাচিক অভিনয়ের দ্বারা 'চিত্রাঙ্গদা' কাব্যনাট্যটি দৃশ্যায়ন করেছেন। বৃত্ত থেকে বৃত্ত ভাঙ্গার এক ঐকান্তিক চেষ্টা প্রযোজনাটিতে লক্ষ্য করা গেছে। আবার বৃত্তেই যেন হাবুডুবু খায় মহাবীর অর্জুন অথবা চিত্রাঙ্গদা। অবশেষে চিত্রাঙ্গদার উপলব্ধি তাকে বৃত্ত থেকে বাইরে টেনে আনে। নতুন এক বোধ জন্ম নেয় তার ভেতর-বাহ্যিক নয় অন্তসৌন্দর্য্যই একজন নারীকে বড় করে তোলে। তাইতো চিত্রাঙ্গদাকে বলতে শুনি, 'আমি চিত্রাঙ্গদা। দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমনী। পূজা করি রাখিবে মাথায় তাও আমি নই। অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে পিছে সেও আমি নই। যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটের পথে দূরহ চিন্তার যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি করো কঠিন ব্রতের তব সহায় হতে, যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরি। আমার পাইবে তব পরিচয়।'

চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে (বর পাবার আগে) সোনালী রহমান অনবদ্য অভিনয় করেছেন। কী তার দেহ ভঙ্গিমায়, কী তার বচনে, কী তার চরিত্র সৃজনে। সোনালী রহমানকে সাধুবাদ দিই। যেন বা ছায়া দেখি আরেক ‘মঞ্চ কুসুম’- এর।
রুপান্তরিত চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে ফারজানা রহমান মিতার অভিনয়ও লক্ষ্য করবার মতো। মহাবীর অর্জুন চরিত্রে মোস্তাফিজুর রহমান ভালো করেছেন। তবে বীর হিসেবে অর্জুন চরিত্রটি তার আরো ভাববার অবকাশ রয়েছে। বসন্তদেবের (শিশির সিকদার) অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। যেন তিনি সত্যিই বসন্তের বার্তা নিয়ে এসেছেন আমাদের মাঝে। কামদেব মদন(হাসান রেজাউল)এর অভিনয়ও প্রশংসা করতে হয়। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনায় ফজলে রাব্বি সুকর্ণর আলো আঁধারের গল্প ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে আয়তকার সেটে বহুতল ব্যবহারের যৌক্তিক নাটমঞ্চ।

সর্বপোরি কাব্যনাট্যটির পোষাক, সঙ্গীত, সেট, আলো, কোরিওগ্রাফি সব মিলিয়ে এক অসাধারণ নাট্যক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে। যা বাঙালির হাজার বছরের ধারায় নাট্য ঐতিহ্যের আধুনিক রুপ। 'চিত্রাঙ্গদা' অনেকটা যাত্রার উপস্থাপন রীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু একটু গভীর ধ্যানে লক্ষ্য করলেই পাবো দর্শক ও অভিনেতৃগণের পারস্পরিক ক্রিয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয় না আমাদের এ এক পরীক্ষাগারে নির্মিত বাংলানাট্যেরই আধুনিক প্রয়াস।

এ ক্ষেত্রে নির্দেশক জাহিদ রিপনের ভাবনাটা এ রকম, 'রবীন্দ্রনাথ শুধু নাট্যকারই নন তিনি একজন নাট্যতাত্ত্বিকও বটে। ঐতিহ্যের ধারায় এই উপনিবেশ উত্তরকালে বাঙালির আধুনিক নাট্যরীতি কী হবে তার একটি দিক নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। আমরা এ প্রযোজনায় চেষ্টা করেছি তার একটি সম্ভাব্য ব্যবহারিক রুপ দিতে।'

স্বপ্নদল-এর চিত্রাঙ্গদা নাট্যটি ৩৪তম প্রদর্শনী শেষ করেছে।

'চিত্রাঙ্গদা' প্রযোজনার গ্রন্থিকগণ হলেন সোলালী রহমান, ফারজানা রহমান মিতা, মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান রেজাউল, শিশির সিকদার, সামাদ ভূঞা, মাধূরী বেপারী সুমি, এনামুল হক শাহীন, সাইফুন নেসা জেবু, রেজাউল মওলা নাবলু, হিটলারম্যান রাজু, তানভীর শেখ, শারিফা রিমু, আলী হাসান, সাইদ মাহবুব প্রমুখ।

জয় হোক স্বপ্নদলের, জয় হোক জাহিদ রিপনের, জয় হোক 'চিত্রাঙ্গদা'র। এক রুপ থেকে আরেক রূপে চলুক স্বরূপ সন্ধান।

(পিএস/অ/মে ১৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test