E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

খণ্ড সুখ খণ্ড দুঃখ

২০১৫ মে ১৮ ১৩:৪৯:২৯
খণ্ড সুখ খণ্ড দুঃখ

সানোয়ার মনি



এই প্রথম জানলাম তার দুই পাটির দাঁত বাঁধানো। আজ ওয়াস রুমে গিয়ে দেখি বেসিনের উপর দাঁত। কী ব্যপার! কার দাঁত? এর মধ্যে শফিক ্ইউরিন্যাল থেকে বেরিয়ে এলো, একটু অন্য মনস্ক তাকিয়ে শান্ত বললো,স্যার আমার। আমি অবাক হয়ে শফিকের দিকে তাকিয়ে রইলাম । তাকে গালগুল ভাঙ্গা ঠকঠকে বুড়ো মনে হচেছা। দাঁত এমন জোয়ান মানুষকে মহূর্তেই বুড়ো বানিয়ে দেয় জানা ছিল না। বিষয়টি বড়ই দুঃখের কিন্তু আমার ভীষন হাসি পেতে লাগলো, তাই অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি সামাল দিলাম । শফিক আমার জুনিয়র কলিগ। তার পার্সনাল বিষয় নিয়ে এই ভাবে হাসা যায় না। তাতে আমার সিনিয়র ভাবটা মার খায়। তবে শফিকের ব্যপারটা একটু আলাদা । কারন গোপনে গোপনে আমি তার ঘটকালী করছি। এই দ্বায়িত্ব আমি নিয়েছি বউকে খুশি করার জন্য। আমার শালী মুমুর সাথে তার বিয়ে দেবার একটা মোটামুটি প্লান ইতিমধ্যেই আমরা করে ফেলেছি। আমরা হিসেব করে দেখেছি শফিক ভালো ছেলে, তার চাল চলন স্মাট, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি, আর যতদূর জেনেছি ঝামেলা মুক্ত পরিবার। কাজেই এই বিয়ে হতেই পারে। তবে বিষয়টা এখনও শফিককে বলা হয়নি। প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন গুলো বউ এর কথা মত টুকটাক আভাসে ইঙ্গিতে জেনে নিচিছ এবং প্রতিদিন তার এর নির্দেশ মত শফিকের সাথে হেসে হেসে কথা বলছি । একটুও বসগিরি দেখাচিছ না ।

দাঁতের ব্যপারটি আমাকে ভাবিয়ে তুললো। দাঁত নেই যে ছেলের তার সাথে কি ভাবে বিয়ে হয়! এই কথা এখন বউকে কি ভাবে বলি! আর আত্মিয় স্বজন শুনলেই বা কি বলবে। চিন্তার কথা। অস্বস্তি বাড়তেই লাগলো। ভাবলাম যা হবার হবে বলেই ফেলি। তাই রাতে বউকে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলেই ফেললাম। বউ শুনে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, মুখ ্এতটুক করে লম্বা নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে লাগল, মুমু মানবে না, কিছুতেই মানবে না । আমি বললাম তাহলে ক্ষান্ত দেই। বউ বললো, না এখনই বাদ দেবার দরকার নাই। আগে ভাব বুঝি । মুমুকে বলি, তারপর। কিন্তু তার আগে তুমি বিষয়টা ভালো মত জানো। ইয়াং ছেলে তার দুই পাটি দাঁত থাকবে না! নিশ্চয় ব্যাপার আছে। আমি বললাম কি ব্যাপার? বউ বললো কি ব্যাপার তা কি আমি জানি। কত ব্যাপারই তো থাকতে পারে । তুমি আগে জানো। ভালো মত খোঁজ নাও ।

ভেবে ছিলাম শফিককে আর গণনায় নিব না । কথাবার্তা বসের মতেই বলব । তাকে দেখলেই হাসি খুশি ভাব ধরবো না। বিয়ে যখন হচেছ না তখন খামাকা অতো আন্তরিক হবার দরকারটা কি ! কিন্তু তা আর পারলাম না। ব্যাপার জানতে, শফিককে রুমে ডেকে চা খাইয়ে নরম সুরে জানতে চাইলাম কি ভাবে হলো? এই বয়সে তো দাঁত পড়বার কথা না! শুনে সে একগাল হেসে বললো - ঠিকই বলেছেন স্যার । বয়সের কারনে দাঁত পড়ে নাই । দাঁত গেছে পড়ে গিয়ে। পড়ে গিয়ে! অবাক হলাম। বললাম কোথা থেকে পড়লে। বললো হিমালয় থেকে। হিমালয় থেকে! কবে? আমার বিস্ময় বেড়ে গেল। বললো, ওই যে মে মাসে নেপাল গেলাম, সেই বার । সে বারতো আমিও ছিলাম, কউ শুললাম না তো কিছু । এতো বড় দুঘটনা হলো আর দলে থেকেও আমি জানলাম না। কেমন কথা! দেখলাম আমার বিস্ময়ে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাই কন্ঠ নামিয়ে মিনমিন বললো, জি স্যার বড় দুর্ঘটনা । তবে হিমালয় থেকে পড়ে না, ্এ্যাকসিডেন্টে, বাস উল্টে, ফরিদপুর থেকে ঢাকা ফিরবার সময় ।
আমার রাগ চড়লো । চড়বারই কথা । শালীর সাথে বিয়ে দিব বলে আন্তরিক ভাবে কথা বলি, কিন্তু আমি যে তার বস এইটাওতো ঠিক । সেই কথা সে মনে রাখবে না! এই রকম উল্টা পাল্টা কথা বলবে! রাগ আরও চড়তো, কন্টোল করলাম বউ এর কথা ভেবে, তবু পুরোপুরি গেল না খানিকটা রয়েই গেল, তাই গম্ভির হয়ে বললাম, তা হলে হিমালয় বললে কেন? শুনে সে খানিক ক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর ব্যথিত বললো, এ্যাকসিডেন্ট বললে কেউ শুনে না স্যার। আজকাল ্এ্যাকসিডেন্ট ঘরে ঘরে । বললে আরও উল্টো হয়, একটু খানিক শুনে কি শুনে না, তারপর শুরু করে তাদের ্এ্যাকসিডেন্টের গল্প তখন কাটা ফাটা দেখাবার জন্য পারলে জামা কাপড় খুলে ফেলে । আমি তাই লোক বুঝে তাদের মটিভ বুঝে তারপর বলি। আপনাকে স্যার আসল কারনটাই বলা উচিৎ ছিল, সরি স্যার বলে সে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার সরি শুনে, মাথা নিচু করা বিনয় দেখে সব রাগ জল হয়ে গেল, হেসে বললাম হিমালয় শুনলে লোকে কি বলে? দেখলাম এই কথা তে সে চাঙ্গা হয়ে উঠলো। বললো হিমালয় শুনলে লোকের উৎসাহ বাড়ে, জিঞ্জাস করে কী ভাবে পড়লেন? কত উচু থেকে পড়লেন ? ধরার কিছু পান নাই? অতো ঠান্ডায় ব্যাথা পাওয়া যায়? ইত্যাদী । আমি তখন রংচং লাগিয়ে হিমালয় দর্শনের পুরো গল্পটা শুরু করি। ভালোই লাগে। তবে স্যার সকলেই এক রকম না, কিছু আছে যারা হিমালয়ের মাহাত্বই¡ বুঝে না, কথার মাছ খানে ফস করে অন্য কথা বলে, সে দিন এই রকম একজন হঠাৎ বলে, আপনার দাঁতগুলো কি চাইনিজ। শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলবললাম না চাইনিজ না । দাঁত গুলো সব বেতুমিজ ।

শেষে বিয়ে আর হলো না। কিন্তু সেই বাবদ প্রথমে বউ এর কাছে পরে শালীর কাছে হেনস্তা হলাম । বউ এর কাছে হলাম কারন একসাথে অফিস করি, এক সাথে চা বিসকুট খাই, আর এই সামান্য জিনিষটা ধরতে পারলাম না, এই অপরাধে । আর শালী, সে আমার সাথে কথাবার্তা বলাই বন্ধ করে দিল। এতো বড় অপমান সে কি ভাবে সহ্য করবে! পারলে আমার দাঁত ভেঙ্গে এই অপমানের শোধ নেয় ।

দিন ঘুরতে ঘুরতেই শফিকের সাথে যোগাযোগ হালকা হয়ে গেল। একদিন সে জেলা শহরে বদলী নিয়ে চলে গেল। আমি হেড অফিসে এ সেকশন ও সেকশন করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে অফিসের কাজে সে হেড অফিসে আসে, দেখা হয়, জিঞ্জাস করি, বিয়ে সাদী কিছু হলো ? উ্ওরে না বলে। বুঝতে পারি এই দাঁতই তাকে ভুগাচেছ। এক দিন বলেই ফেললাম, বলবার দরকার কি! বিয়ে হোক তখন বলো, দেখবে পরে সব ঠিক হয়ে গেছে। বলে তাতো পারি না স্যার, দাঁত ঠক ঠক করে। থামানো য়ায় না। কি বলে এই সব! কেমন হেয়ালী হেয়ালী লাগতে লাগলো, দেখলাম সে সিরিয়াস কন্ঠ ভারী করে হতাস বললো, একবার কনে পক্ষকে না বলে অনেক দূর এগিয়ে ছিলাম, কিšতু যেই মুহূর্তে বিয়ে করতে রওনা দিব, ঠিক সেই মুহূতের্, দাঁত ঠক ঠক করে বাজতে শুরু করল, সেকি ঠকঠকি মনে হলো দুই পাটি দাঁত বাড়ি খেতে খেতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে পড়বে। কোন মতেই থামানো যাবে না। সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল, বিশেষতঃ যারা এই না জানিয়ে বিয়ে দেবার দলে ছিল। তারা এর মধ্যে এক অশুভ ইঙ্গিত খুজে পেল, তাদের মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেল, বিয়ে শাদী মাথায় উঠলো। বর বেশে যাবার কথা ছিল দুলহানের বাড়ি তা না গিয়ে গেলাম দাঁতের ডাক্তারের কাছে, তিনি চেয়ারে শুইয়ে টান মেরে দাঁতের পাটিদ্বয় খুলে ফেললেন তারপর মুখের মধ্যে এক গাদা গজ ঢুকিয়ে নাকি সুরে টেনে টেনে বলতে লাগলেন, নাক দিয়ে নিশ্বাস নিন, নাক দিয়ে নিশ্বাস নিন । ততক্ষনে সব জানাজানি হয়ে গেছে, বিয়ে ভেঙ্গে খানখান ।

এই ভাবে বছর কয়েক কেটে গেল, এর মধ্যে শালীর বিয়ে হয়ে গেল এবং বিয়ের এক বছর পর তারা আমেরিকা চলে গেল। ফোনে যোগাযোগ হয়, শুনতে পাই তারা ভাল আছে। কিন্তু এই ভাল বেশীদিন চললো না, এক দিন রাত দুপুরে ফোন এলো শুনলাম তারা ্এ্যাকসিডেন্ট করছে, অবস্থা বেশী ভাল না। আমেরিকা অনেক দূর ইচছা করলেই ছুটে যাওয়া যায় না। উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দিন কয়েক পর খবর পেলাম তারা ভাল আছে তবে দুজনেরই দুই পাটি দাঁত উড়ে গেছে, বড় ড্যামেজ হয়েছে, সারতে সময় লাগবে আর সারলেও নকল দাঁত লাগিয়ে চলতে হবে সারাটা জীবন ।
আমেরিকায় দাঁতের চিকিৎসা ব্যয় বহুল, বাংলাদেশে করালে সস্তা হতে পারে, এই আশাতে তারা ডাক্তারের রির্পোট, এক্স-রে প্লেট সহ যাবতীয় কাগজ পত্র কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিল। কুরিয়ারে শালীর একটা চিঠি ছিল, পড়ে বুঝলাম একে বারে ভেঙ্গে পড়েছে, ফোকলা দাঁত নিয়ে বাকি জীবন তাদের কি ভাবে কাটবে সেই দুঃখের বর্ণনা চিঠিকে ভারী করে তুলেছে।

মনে মনে যুত সই ডাক্তার খুঁজতে লাগলাম। তখন একদিন হঠাৎ শুনলাম শফিকের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে তার মতই, তারও দুই পাটি দাঁত নাই, বছর দেড়েক আগে তাদের একটা বাচ্চাও হয়েছে। সেই বাচচাকে এখন তারা দাঁত খুলে ভয় দেখায়। বাচচা খলবল করে হাসে। খবর এনেছিলো হাবিব সে শফিকের ব্যাসমেট, আমার হাতে একটা ছবি ধরিয়ে বললো দেখুন স্যার কেমন তিন ফুকলা হাসতাছে। এই ছবি আমি অফিসের পত্রিকায় দিব, আপনি স্যার দয়া করে এর জন্য একটা ক্যাপসন লিখে দিন। আমি ছবির দিকে চেয়ে রইলাম সত্যিই দেখবার মত ছবি, তিন দাঁত শূন্য মানুষ, পৃথিবীর সব দুঃখ বেদনাকে হেসে উড়িয়ে দিচেছ। ভাবলাম এই হাসিকে ফোকাস করেই ক্যাপসনটা লিখি, কলম নিয়ে সেই রকমই ভাবতে লাগলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন জানি কিছুই লিখতে পারলাম না, চুপচাপ বসে বসে শালীর পাঠানো কাগজ পত্র গুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। কিছুই বুঝলাম না কিন্তু তাতেই কেন জানি চোখে জল আসতে লাগলো । এই ভাবে কত সময় ছিলাম জানি না যখন হুস হল তখন উঠে দাড়ালাম এবং রির্পোট, এক্স-রে প্লেট ইত্যাদী ভালো মত ব্যাগে ঢুকিয়ে ডাক্তারের খোঁজে বের হলাম ।



(/এসসি/মে১৮,২০১৫)


পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test