E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাহুল সাংকৃত্যায়ন

২০১৫ জুন ১৭ ১৫:০২:১৬
রাহুল সাংকৃত্যায়ন

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন ভারতের একজন স্বনামধন্য পর্যটক, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, মার্কসীয় শাস্ত্রে দীক্ষিত । তিনি তাঁর জীবনের ৪৫ বছর ব্যয় করেছেন বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাদাতা হিসাবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। বলা হয়েছে তিনি হিন্দি ভ্রমণ সাহিত্যের জনক। ভোলগা থেকে গঙ্গা তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ। বৌদ্ধ দর্শনে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁকে "মহাপণ্ডিত" আখ্যায়িত করেছিলেন।

তিনি ১৮৯৩ সালের ৯ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের পান্দাহা জেলার আজমগড় গ্রামের সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আজমগড় গ্রাম ছিল তাঁর মাতামহ রামশরণ পান্ডের বাড়ি। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল কেদারনাথ পান্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তার পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। তাই মাতামহের অভিভাকত্বেই তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছে। বাল্যকালেই মাতামহের কাছ থেকে উর্দূ শেখেন এবং গ্রাম্য একটি পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তার জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সেখানে তিনি অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। উর্দূতেই কেদারনাথের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। পরে তিনি কমপক্ষে ৩৬টি ভাষা শিক্ষালাভ করেছিলেন যথা : ভোজপুরী, হিন্দী ও সংস্কৃত ছাড়াও পালি, উর্দু, ফার্সি, আরবী, তামিল, তিব্বতী, সিংহলী, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান প্রভৃতি ভাষা জানতেন।

তাঁর মাতামহ একসময় সৈন্যদলে কাজ করতেন। মাতামহের সৈনিক জীবনের নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা ও বিভিন্ন দেশ দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে একবারে ছোটবেলায় তিনি হয়ে ওঠেন রীতিমত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তাই মাত্র দশ বছর বয়সেই (১৯০৭ সালে) তিনি পৃথিবী দেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে কাশীতে যান। কয়েকদিন পর কিছুদিনের জন্য বাড়িতে ফিরে আসেন এবং আবার সেই বছরই বাড়ি ছাড়েন। বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে রেলে কিছুদিন মার্কম্যানের কাজ করেন। তারপর এক দোকানে খাতা লেখার কাজ নেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করেন। এরপরে তিনি একটি মঠে সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করেন। ভোজপুরী, মৈথিলী, নেপালি, রাজস্থানী প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি এমনকি ফটোগ্রাফিও শিখেছিলেন। তিনি ভারতের সকল তীর্থ-ক্ষেত্রে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি মাদ্রাজে ছিলেন এবং তামিল ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়াও অন্ধ্র প্রদেশ, ব্যাঙ্গালোর, হাম্পি, কর্ণাটক প্রভৃতি স্থানেও ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ করেই তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন।

তিনি এমনকি তিব্বতের নিষিদ্ধ ভূমিতেও গিয়েছিলেন। কাশ্মীর, কার্গিল প্রভৃতি এলাকা দিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি তিব্বতে প্রবেশ করেন। ১৩শ খৃষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর নালন্দা ও বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় এর পাঠাগার পুড়িয়ে ফেলার পর ভারতে সেই অর্থে তেমন সংস্কৃত ভাষার কাজ খুঁজে পাওয়া যায় না। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিলো হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃত পুঁথি উদ্ধার করা। মূলত যেগুলো ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের উপর। তিব্বত থেকে তিনি পালি ও সংস্কৃতের মূল্যবান পুঁথি, বই ও কিছু চিত্রকর্ম নিয়ে আসেন। এগুলো নালন্দা ও বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ তিব্বতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাটনা জাদুঘরে এর একটি অংশ সংরক্ষিত আছে। তিনি তিন বার তিব্বত গিয়েছিলেন, তিব্বতীয় ভাষা শিখেছিলেন। তিব্বত-হিন্দী অভিধান রচনা করেছিলেন, যার শুধুমাত্র প্রথম অংশ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তিনি এরপর শ্রীলংকা, জাপান, কোরিয়া, চায়না, রাশিয়া, তেহরান, বালুচিস্তান প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।

মাত্র এগারো বছর বয়সে সন্তোষী নামের এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বিয়ে তিনি মেনে নিতে পারেননি, সারা জীবন সন্তোষীর সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখেননি। এরপর রাশিয়া গিয়ে তিনি লোলা নামের এক বিদুষী মহিলাকে বিয়ে করেন। এইখানে তিনি পুত্রসন্তানের জনক হন। কিন্তু রাহুল রাশিয়া ছেড়ে ভারতে চলে এলে লোলা রাহুলের সাথে আসতে রাজি হননি। এরও অনেক পরে ১৯৫০ সালে ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ।

বাল্যকাল ও প্রথম যৌবনে রাহুল ছিলেন ঈশ্বর-বিশ্বাসী ও ধর্মচর্চায় মনোযোগী। তবে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও ধর্মচরণে কখনো অন্ধতাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। যুক্তিশীলতা ছিল তাঁর একান্ত মানস-বৈশিষ্ট্য। সেই মানস-বৈশিষ্ট্যের দরুনই বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে এক সময় ঈশ্বর ও ধর্মের নির্মোহ পরিত্যাগ করে হয়ে ওঠেন দ্বান্দিক বস্তুবাদী। ১৯১৩ সালে বিশ বছর বয়সে ছাপরা জেলার পরসা মঠের মহান্তের শিষত্ব গ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম হয় রামোদার দাস। মহান্তের মৃত্যুর পর তাঁর গদির উত্তরাধিকারী রূপে লক্ষ লক্ষ টাকা ভোগের সুযোগ লাভ করেছিলেন। কিন্তু ভোগসুখের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা ছিল তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ। তাই অনায়াসে তিনি মহান্তের গদি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি আর্য সমাজের সাথে পরিচিত হন এবং বেদ অনুসারী আর্যসমাজের ভাবধারাকে সত্য বলে মেনে কিছুদিনের জন্য আর্যসমাজী হয়ে যান।

আর্যসমাজে অবস্থান করেই গভীরভাবে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি উপলব্ধি করেন যে বেদ-বিরোধী বৌদ্ধ মতবাদই হচ্ছে প্রকৃত সত্যের ধারক। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে) নাম ধারণ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। আজীবন এই নামটি তিনি পরিত্যাগ করেননি এবং এই নামেই তিনি স্বনামধন্য ও বিশ্বনন্দিত। বৌদ্ধ দর্শনে বুৎপত্তি লাভ করার পরই তিনি একান্ত নিষ্ঠার সাথে মার্কসবাদের দর্শন অধ্যয়ন করেন এবং মার্কসবাদকেই তাঁর জীবনদর্শন রূপে গ্রহণ করেন। আমৃত্যু তিনি এই দর্শনের অনুসারী ছিলেন। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই জীবন ও জগতের সকল কিছুই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে চলেছিলেন। তাঁর ভাষ্যে-

“আমি কোনো এক সময় বৈরাগী ছিলা, পরে আর্যসমাজী হয়েছিলাম, বৌদ্ধ ভিক্ষু হই, আবার বুদ্ধের ওপর অপার শ্রদ্ধা রেখেও মার্কসের শিষ্য হয়েছি।”

তিনি ২০ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি প্রতিদিন তার দিনলিপি রাখতেন সংস্কৃত ভাষায়। এটি পরে তাঁর আত্মজীবনী লিখতে কাজে লেগেছিলো। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ভোজপুরী, তবে তিনি মূলত সংস্কৃতেই লেখালেখি করতেন। এছাড়াও হিন্দী ব্যবহার করতেন। তিনি ছিলেন একজন ভারতবিশারদ। ভ্রমণ, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের উপর তার অনেক গ্রন্থ আছে। এর মাঝে কিছু জীবনী ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। লেখক জীবনের পরের দিকে মৌলিক কাজ অব্যাহত থাকলেও গ্রন্থ সম্পাদনা, অভিধান সঙ্কলন ইত্যাদি তুলনামুলকাভাবে বেশি করেছেন। এ সময় তিনি সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতাদের জীবনী রচনায় মনোযোগ দেন। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা’। এটি রচনার পর ভারতের হিন্দীভাষী প্রায় সমস্ত অঞ্চল থেকে তাঁকে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো।

জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তার কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। । পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় এবং তিনি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যান। কিছুদিন কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসা চলার পর তাঁকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে সাত মাস তাঁর চিকিৎসা চলে। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আর পুনরুদ্ধার হয় না। ১৯৬৩ সালের ২৩ মার্চ তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ১৪ই এপ্রিল ৭০ বছর বয়সে তাঁর মহা প্রয়ান ঘটে।

বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে রাহুলের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রাহুলের যেমন বাঙ্গালিদের জন্য ছিল গভীর ভালোবাসা, বাঙ্গালিদেরও তেমনি রাহুলের প্রতি রয়েছে অন্তহীন প্রীতি ও শ্রদ্ধা। পশ্চিমবঙ্গে রাহুলকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশ রাহুল চর্চায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিককালে এখানেও বেশ সচেতনতা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধসমাজের সুধীবৃন্দ বাংলাদেশে রাহুলচর্চায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছেন। ঐ সমাজের তরুণ লেখক জগন্নাথ বড়ুয়ার ‘মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবন ও সাহিত্যকর্ম’ গ্রন্থটি ২০০৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত রাহুলের বিশ/পঁচিশটি গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দর্শন-দিগদর্শন (১ম ও ২য় খন্ড), বৌদ্ধ দর্শন, মানব সমাজ, ভোল্গা থেকে গঙ্গা, সিংহ সেনাপতি, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ, তিব্বতে সওয়া বছর, কিন্নর দেশে, মাও সে-তুং, বিস্মৃতযাত্রী, ইরান, জয় যৌধেয়, স্মৃতির অন্তরালে, বহুরূপী মধুপুরী, ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান-পতন, সপ্তসিন্ধু, ইসলাম ধর্মের রূপরেখা, অগ্নিস্বাক্ষর, উত্তরাংশ, মধুর স্বপ্ন, পুরানো সেই দিনের কথা (সতমী কে বচ্চে), কনৈলা কী কথা, রাম রাজ্য ও মার্কসবাদ, নতুন মানবসমাজ, আমার লাদাখ যাত্রা, কমিউনিজম ও ভবিকাল এবং পাঁচখন্ডে লিখিত আত্মজীবনী ‘আমার জীবন যাত্রা’ ইত্যাদি।

গ্রন্থনা : পরিতোষ বড়ুয়া লিমন

তথ্যসূত্র : দর্শন-দিগদর্শন (১ম খন্ড) ও ইন্টারনেট

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test