E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এ কাদের ভীড় ?

২০১৫ আগস্ট ০২ ১৬:৫৭:৪৩
এ কাদের ভীড় ?

আনিসুর রহমান আলিফ : তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হবার পর ছাত্রদের মন মানসিকতা থাকে হাই-এক্সপেকটেশানে একেবারে ভরপুর। সকাল-সন্ধ্যা মন দিয়ে পড়াশোনা করা, নিয়মিত কলেজে যাওয়া, আহা।

ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠা মানেই কিন্তু মোটামুটি বড় ভাই টাইপ একটা কিছু হয়ে যাওয়া। এই বড় ভাই নামের বড়ত্ব ধরে রাখতে হলে অনেক কিছুই করতে হয়। তার মধ্যে একটি হলো কম্পিউটার কেনা। ধুম ফেলে দিয়ে আমাদের মধ্যে যে ছেলেটি কম্পিউটার কিনলো সে আমার রুম মেট না, বলা চলে হোস্টেল মেট। নাম চপল। নামটি যেমন চপল কাজে কর্মেও সমান ভাবে তার চপলতা।

যতদূর মনে পড়ে এই হোস্টেলে আমাদের ব্যাচের মধ্যে চপলই সবার আগে কম্পিউটার কেনে। আমি বলছি ২০০২ সালের কথা। কম্পিউটার বস্তুটা আজকের মতো সকলের হাতে হাতে তখনও পৌঁছায় নি। যা হোক, চপল কম্পিউটার কিনবে, হোস্টেলে তাই আলাদা একটা গুঞ্জন। সাধারণ জেলা শহরে তখনও কম্পিউটারের শো-রুমগুলো আজকের মতো করে গড়ে ওঠে নি। সরাসরি ঢাকা থেকে কিনে আনতে হতো। সকলকে অবাক করে দিয়ে সত্যিই একদিন নতুন কম্পিউটার নিয়ে চপল হোস্টেলে উঠলো।

আহ্লাদে বুকখানা তার তখন বত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশ। হোস্টেলে অলিখিত কিছু নিয়ম-কানুন থাকে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে কোনো বর্ডার নতুন কিছু কিনলে অবশ্যই তাকে মিলাদ দিতে হবে। হোক সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খিষ্টান অথবা মুসলিম। মিলাদ দেওয়ার এই নিয়ম লঙ্ঘন করার ক্ষমতা কারো নেই, করলে তার দুর্ভোগের আর শেষ থাকে না। চপলের কম্পিউটার কেনার মিলাদ খেলাম। কী খেলাম তা এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না, কারণ হোস্টেলের সব গল্প ফাঁস করাটা মনে হয় ঠিক হবে না। যা হোক চপলের নতুন কম্পিউটার দিব্যি চলছে। চলছে মানে ধুম-ধাড়াক্কা চলছে।

সারাদিন উচ্চ শব্দে গান বাজানো আর রাত নামলেই মুভি। বড় ভাই হওয়ার এমন খুশিতে ফার্স্ট ইয়ারের সেই হাই-এক্সপেকটেশানগুলো যে কোথায় উড়ে গেলো তার খবর কে জানে। এদিকে চপলের রুম অন্য সকল বর্ডারদের কোলাহলে সবসময় গমগম করে। গান শোনা অথবা মুভি দেখার নেশায় চপলকে একটু খুশি করতে কারো কোনো কমতি নেই। চপলের হঠাৎ এমন পপুলারিটি দেখে আমাদের মনে যে ঈর্ষার দাবানল বয়ে যাচ্ছিলো না তা বলা মিথ্যা। ঈর্ষা বড্ড খারাপ জিনিস, একবার মাথায় চড়লে সহজে নামতে চায় না। ধীরে ধীরে আমাদের সহ্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করলো।

আমরা যার যার মা-বাবাকে নানা ভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কম্পিউটার কেনার জন্য রাজি করাতে শুরু করলাম। বাবাকে বোঝালাম, মানুষ একটা সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের অন্য সকলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে এখানে লোকে অসামাজিক বলে। নতুন যুগে আমাদের নব্য বিদ্বান ভাষা তারা কিছু বুঝলো, কিছু টুপ করে গিলে ফেললো।

বাড়ির লোকজন তো কম্পিউটার জিনিসটা কী তা ইতোপূর্বে কখনও দেখেই-নি। তাদের মতে কম্পিউটার তখন আজকের যুগের এলিয়েনের থেকে কম কিছু নয়। তারা ভাবতো, নতুন যুগ পড়েছে, তার উপর ছেলে কলেজে পড়ে, আজকালকার ছেলেদের বুঝি কম্পিউটার ছাড়া পড়াশোনাই হয় না। তাদের এরূপ চিন্তা-ভাবনার মাঝে আমরা আরো একটু রঙ চড়িয়ে বিষয়টাকে মস্ত এক আলু বানিয়ে ফেলতাম। এ আলু এমন যে, কোনো ভাবেই সেদ্ধ হতে চায় না। যা হোক কম্পিউটার কিনবো ঠিক হলো। কিন্তু কেমন জিনিস কিনতে হবে, কেমন তার দাম, কোথা থেকে কিনব ? এই সব চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার রুমমেটও দেখলাম কম্পিউটার কিনবে কিনবে করছে। আমি বললাম, তাহলে তো ভালই হয় একসাথে যাওয়া যাবে। আমার রুমমেট বললো,
-চল, চপলের সাথে কথা বলি।
এতদিন চপলকে তার কম্পিউটারের দাম কতো তা বলতে সাহস হয়নি। আজ আমাদের সেই সাহস অর্জিত হয়েছে। চপলের চেয়ে আমরা কম কীসে ? বললাম,
-দোস্ত আমরা কম্পিউটার কিনবো। দাম কেমন? কোথা থেকে কিনব বুঝতে পারছি না, তুই যদি একটু হেল্প করিস তো খুব ভালো হয়। চপল বললো,
-কম্পিউটারের দাম তো অনেক, পঞ্চাশ-ষাট হাজার লাগবে।
তখনকার দিনে পঞ্চাশ ষাট হাজার কিন্তু বেশ মোটা অংকের টাকা। পঞ্চাশ ষাট হাজার মানে ফরিদপুর শহরে তখন দুই কাঠা জমি। আমরা বললাম,
-সমস্যা নেই, বাড়ি থেকে রাজি হয়েছে। চপল বললো,
-খুব ভালো কথা। আইডিবিতে আমার এক আঙ্কেলের দোকান আছে। আঙ্কেল খুব ভালো। আঙ্কেলই আমাকে সবচেয়ে কম দামে সবচেয়ে ভালো জিনিস দিয়েছে। আমরা বললাম,
-দাম কতো নিয়েছে? চপল বললো,
-ষাট হাজার। আমি বললাম,
-এই না বললি পঞ্চাশ হাজারেও হবে।
-হ্যাঁ, তা হবে। কিন্তু আমারটা তো সবচেয়ে ভালো।
আমার রুমমেট বললো, তোর আঙ্কেল সবচেয়ে কম দাম রাখলো তার পরেও ষাট হাজার!
তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি। চপলের চতুরতাটা ছিলো রোমান যুগের দ্বী-ধার তলোয়ারের মতো। ওটা যেতেও কাঁটে ফিরতেও কাঁটে। মানে দাম সবচেয়ে কম কিন্তু অংকটা একটু বেশি।

আমাদের সময় এমন চপল প্রতিটি হোস্টেলেই দু-চারটি করে থাকতো। কিন্তু আজকের সমাজটা অনেক বেশি ফার্স্ট। এ যুগে চপলের দৌড়াত্ব এতটাই বেড়েছে যে পথে ঘাটে চলাটা প্রায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। জানি এরা ছিলো, আছে আর থাকবে। কিন্তু তাদের ব্যাপকতা যে এতো বৃদ্ধি পাবে এটা বুঝিনি। আজকাল চপল হওয়াটা যেন একটা স্টাইল মানে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সময় চপলদেরকে কেউ তেমন একটা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আজ যেন চপল হয়ে চপলদের দলে না ভীড়তে পারলেই বরং কেউ দাম দিতে চায় না। অথচ চপলদের ভেতরটা কিন্ত পুরোটাই ফাঁপা। দেখতে শ্রীলংকা হলে কী হবে ভেতরে পুরোটাই লবডংকা। মুখে তাদের খই ফোঁটার মতো বড় বড় কথা। আর বলবেই বা না কেন ?

আমরা এমন একটা জায়গায় বাস করি যেখানে চাপা মারলে কারো মুখে কোনো ঘা হয় না অথবা পুলিশেও ধরে না। তাই চপলদের দল যে দিনে দিনে ভারি হবে সেটাই স্বাভাবিক। আজকের সমাজে যার মুখে জোর নেই সে যেন নানস্মার্ট দুর্বল। সবল দুর্বলের কথা বলতে গিয়ে প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর একটি কথা মনে পড়ে গেল।

তিনি বলেছেন- এ এমন একটা সমাজ যেখানে বেয়াদবদেরকে মনে করা হয় সবল আর বিনয়ীকে দুর্বল। এই যখন সমাজের চোখ তখন প্রতিদিন হাজার হাজার বিনয়ীরা চপলদের দলে যোগ দেবেই। চপল হওয়ার মধ্যে কিন্তু বেশ মজা আছে। এখানে মনে মনে যত ইচ্ছা কলা খাওয়া যায় কাউকে কোনো পয়সা দিতে হয় না।

আমি এমন বেশ কিছু চপলকে দেখেছি যাদের পরিণতি হয়েছে খুবই ভয়াবহ। আজ এ মিথ্যা, কাল সে মিথ্যা বলতে-বলতে এক সময় তারা এতটা মিথ্যার মধ্যে তলিয়ে যায় যে, শেষে তাদের খোঁজ কোনোভাবেই আর পাওয়া যায় না। মিথ্যুক হিসাবে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা পালায় সমাজ থেকে, দেশ থেকে এক সময় পৃথিবী থেকে। চকচকে ইমিটেশনে যখন মরিচা ধরে ততদিনে তারা সমাজের আয়নায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এক কাপুরুষ হিসাবে আবিষ্কার করে। নিজেকে তখন একটু ঘসে মেজে চকচকে করতে গেলেও তারা বুঝতে পারে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এতদিনে সমাজ তাদেরকে চি‎িহ্নত করে ফেলেছে।

তারা হতাশ হয়ে পড়ে। চপলতা করে সময় নষ্ট করার দরুন তাদের না থাকে কোনো ডিগ্রি, না তাকে কোনো দক্ষতা। ঝড়ে বগ মরার মতো দু’একজনের বরাতে কোনো ডিগ্রি জুটলেও সমাজ ততদিনে তাদেরকে আরো বড় ডিগ্রি দিয়ে বসে থাকে। সমাজের চোখে তারা বাটপার, চাপাবাজ, জোচ্চোর। সময় ফুরিয়ে আসে, সমাজে তাদের আর কোনো ঠাঁই থাকে না। নিজেকে শুদ্ধ করার শত চেষ্টা করলেও অভ্যাস তাদের পিছু ছাড়ে না। সত্যি কথা বলতে গেলেও সেটা হয়ে যায় মিথ্যা। হতাশা, দুশ্চিন্তা তাদেরকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়। এত সব দুশ্চিন্তা ভুলে থাকতে, এত সব বঞ্চনা থেকে একটু রেহাই পেতে তারা বেছে নেয় নেশার ভয়ঙ্কর জগৎ। আর যায় কোথায় ? এবার নেশার টাকা জোগার করতে চুড়ি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি। একসময় তাদের লাশ পাওয়া যায় রেল লাইনের ধারে অথবা হাসপাতালের নর্দমার পাশে।

ইস্, সেই ফার্স্ট ইয়ারের অ্যামবিশান, হাই-এক্সপেকটেশনগুলো এক নিমিশেই কোথায় উড়ে গেলো ! ঝরে পড়ে গেলো কতো না-ফোঁটা ফুল। একটু ভুলের জন্য, ইয়ার্কির ছলে সেই ছোট-ছোট মিথ্যার জন্য আজ তারা কোথা হতে কোথায় চলে গেলো ! সমাজ বড় নিষ্ঠুর। কষ্ট হয়, সত্যিই খুব কষ্ট হয়। চপলদের চপল হয়ে ওঠার আগেই তাদের এই চপলতার বিষয়টাকে যদি সমাজ ঘেন্না করতো। কিন্তু আজকের ব্যস্ত সমাজ তা করে না। উপরন্তু চায়ের দোকানে বসে মজা লুটেতে ব্যস্ত। ইস্, তাদেরকে বোঝানোর কতো উপায় ছিলো। অথচ তেমন করে কখনও কেউ তাদেরকে কিছু বলে নি। আমরা আজ যে যার যার নিজেদের ঘর পরিস্কার করতে ব্যস্ত। বাইরে আবর্জনার পাহারে আমাদের পরিস্কার করে রাখা ঘরটি কতক্ষণ তাদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখতে পারবে তা আমার জানা নেই।
আজ সুশীল সমাজের কাছে আবেদন, আপনারা যদি তাদের এমন আচরণকে ঘৃনা করতেন, তাদেরকে বোঝাতেন, এটা একটা অসুখ, বিকৃত মানসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাহলে হয়তো এই ভীড়টা একটু কমতো।

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test