E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প

২০১৫ অক্টোবর ০৩ ১৫:৪২:২২
আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প







 

শৌহর

আজ রুপার বিয়ে। বিয়ে মানেই আনন্দ-উল্লাস, হৈ হুল্লোড়। কিন্তু রুপার বিয়েতে আজ তেমন কোনো ব্যাপার নেই। আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো এই বিয়েটাকে বলা যেতে পারে, উঠ ছুড়ি তোর বিয়ের মতো একটি ব্যাপার। লোকমুখে শুনেছি জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ এই তিন সৃষ্টি কর্তার হাতে। আমি বলি, সৃষ্টিকর্তা কী তার সৃষ্টি সম্পর্কে এতটাই উদাসীন? জীবনের প্রতিটি পরতে-পরতে এ তবে কার নিপুণ রচনার কারুকাজ ? জীবনের বাঁকে-বাঁকে সুখ আর দুঃখের অনুভূতির সাথে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি পরিস্থিতি তবে কার ইশারায় চলে?

কালের এই সংক্ষিপ্ত সফরে জীবনের কতো গল্প ! কতো চরাই উতরাই! সঙ্গীহীন অবস্থায় এই বিশাল পথ পারি দেওয়া কী এতটাই সহজ ? সঙ্গীহীন জীবনের মানেই বা কী থাকে? জীবনের এই রঙ্গ মঞ্চে প্রতিটি নারী ও পুরুষকে একজন সঙ্গী বেছে নিয়ে বিবাহ নামের একটি নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হতেই হয়। এই বন্ধন কার সাথে কবে কখন কীভাবে সংঘটিত হবে তা সম্পর্কে আদম জাত সামান্যই জানে। কারো ক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধনের এই ঘটন টা হয় খুব ধীরে আবার কারো ক্ষেত্রে চট জলদি। রুপার বিয়ের আয়োজনটা সত্যিই খুব চট জলদি হয়েছে।

বিয়ের ভাবনাটা রুপা প্রায় প্রতিদিন-ই নিয়ম করে ভাবে। ভাবাটাই স্বাভাবিক, একটি মেয়ের বয়স পঁচিশ পার হয়ে যাচ্ছে অথচ বিয়ে হচ্ছে না, এটা নিশ্চয় অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার। রুপার বয়স পঁচিশ নয় রীতিমতো সাতাশে গিয়ে ঠেকেছে। রুপার যারা বান্ধবী তাদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সমবয়সী সকলের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ তার হচ্ছে না, এটা যে কেমন একটা ভাবনা তা রুপার চেয়ে বেশি আর কে বুঝবে।

রুপার বান্ধবী কণার যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর। চোখে মুখে ক্ষাণিক আনন্দ ক্ষাণিক ভয় মিশিয়ে কণা কাঁদতে কাঁদতে রুপাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল। আমার খুব ভয় করছে রে। রুপার বয়সও তখন পনেরো কী ষোলো। বান্ধবীকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে তা তার জানা ছিল না। শুধু বলেছিল, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিই কী সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে? কণার মেয়ের বয়স এখন বারো। মাঝে মাঝেই কণা বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে, রুপার সাথে দেখা হয়। কণার মেয়ে সায়মা রুপাকে খালামনি-খালামনি বলে ডাকে। খালামনি বড় আদরের ডাক কিন্তু এই ডাক শুনতে রুপার কেমন যেন অস্তস্তি লাগে। কণার মেয়ের চেহারাটাও মাশাআল্লাহ্ খুব সুন্দর হয়েছে। বয়স বারো হলে কী হবে এখন থেকেই তার নাকি বিয়ের কথা আসছে। কণার মেয়ের বিয়ের কথা শুনলেই রুপার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কোথায় যেন কি একটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চায়। কেন এমন হয় রুপা তা জানে না। শুধু এটুকু জানে বুকের মধ্যে কীশের যেন একটা হাহাকার দীর্ঘ সময় ধরে করুন সুরে বাজতে থাকে। চুপসে যাওয়া জবা ফুলের মতো মনটা তার ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ইদানীং রুপা চোখের জল লুকাতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা হাজারও ঘটনার উপর মোটা চাদর বিছিয়ে নির্দ্বিধায় হাসতে পারে সে।

রুপার বান্ধবী ইতিরও বিয়ে হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক হলো। কণার মতো ইতিও মাঝে মাঝেই বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে। ইতির এখনও কোনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। ইতি গল্প করার ছলে বলে, আমার হাসবেন্ড খুবই শৌখিন। ও বলে, এখনই বাচ্চা-কাচ্চা নয়। আগে জীবনটাকে একটু উপভোগ করে নেই তারপর ভেবে দেখা যাবে। ইতি সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প করতে পারে। গত বছর বরের সাথে কক্সবাজারে গিয়ে কী কী দেখেছে, কেমন মজা করেছে এই সব গল্প শোনায়। রুপা তার চোখে মুখে কৌতূহলের ছবি এঁকে ইতির বলা গল্পগুলো শুনতে থাকে। একেক বার তার মনে হয় তার জীবনে হয়তো এমন দিন কখনই আসবে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে তার। তার কপালে কী আর ইতির হাসবেন্ড এর মতো তরুন যুবক জুটবে ? তরুন যুবকরা অল্প বয়স্ক মেয়ে খোঁজে। তাদের মন থাকে সাগরের মতোই উত্তাল। তারা তাদের সুন্দরী বউকে নিয়ে সাগরে পারে বেড়াতে যায়, হাসি তামাশা করে। রুপা মনে মনে ভাবে তার কপালে বিয়ে যদি থেকেও থাকে কিন্তু ইতির হাসবেন্ড এর মতো তরুন যুবক জুটবে না নিশ্চয়। মাঝ বয়সী কোনো পুরুষের মনে কী সমুদ্র দেখার সাধ জাগে?

পরিবারে রুপার আরো দু’টি বোন আছে। রুপা খেয়াল করেছে ছোট বোন দু’টি তার সাথে আগের মতো আর মেলামেশা করে না। মন খুলে হাসে না। আগে যেমন মনের কথাগুলো খুব সহজেই বলে ফেলতে পারতো এখন কিন্তু তারা কেমন যেন চাপা স্বভাবের হয়ে গেছে। কথা বার্তায়ও স্পষ্ট তাচ্ছিল্লের ভাব। রুপা বোঝে, সময় মতো বড় বোনের বিয়ে না হলে তাদের অবস্থাও হয়তো একদিন তার মতই হবে। কিন্তু বিয়ে না হলে সে কী করবে? গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? আমি বিয়ে বসতে চাই, আমাকে কেউ বিয়ে করুন? এ এমন এক ব্যাপার যা যেচে কাউকে বলাও যায় না। মা-বাবাও তো চেষ্টা কম করছেন না। আত্মীয়-স্বজনরাও কতবার কতো ছেলে আনল কিন্তু কেন যেন হচ্ছে না। রুপার যে বড় ধরনের কোনো দোষ-ত্রুটি আছে তাও কিন্তু নয়। মা ইদানীং রুপার প্রতি ছোট-খাট ব্যাপারেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। দৃষ্টি নীচের দিকে নামিয়ে পাটায় পেঁয়াজ-মরিচ পিষতে পিষতে ঝাঁজালো কণ্ঠে বলেন,
-আমার কপালটাই খারাপ। ঘরে তিন-তিনটা উপযুক্ত মেয়ে, অথচ বিয়ে দিতে পারছি না। আমার চেয়ে কষ্টে এই পৃথিবীতে আর কে আছে ?
মায়ের কথায় রুপা কোনো কথা বলে না। মা বলে চলেন,
-নিশ্চয়ই তোকে কেউ জাদু-টোনা করেছে। শুনেছি চান্দ্রায় এক ফকির বাবা আছে। তার তদবিরে নাকি সব হয়। সামনের শনিবারেই তোকে নিয়ে যাবো।
মায়ের এমন কথায় রুপা কিচ্ছু বলে নি। বাধ্য মেয়ের মতো ফকির বাবার কাছে গেছে। ফকির বাবা হাতে-গলায় তাবিজ পড়িয়ে দিয়েছে, পানি পড়া দিয়েছে। নিয়ম মেনে রুপা পানি পড়া খেয়েছে। ফজরের আজান শুনে মধ্য পুকুরে নেমে এক নিশ্বাসে ডুবও দিয়েছে। একবার এক ওঝা রুপার সমস্ত শরীরে শরিশার তেল কুলি করে দিয়েছিল। নিজের ভাগ্যের কাছে মাথা নত করে মুখ বুঁজে সব সহ্য করেছে সে। এত কিছু করেছে তবুও কিছুতেই কিছু হয়নি। ছেলে পক্ষ নিয়মিত তাকে দেখতে এসেছে আর বাজারের দোকানে শাড়ি দেখার মতো করে দেখে চলে গেছে। বড় মামা ছেলে পক্ষের কাছে পছন্দের ব্যাপারটা জানতে চাইলেই তারা পাকা ক্ষরিতদারের মতো বলেছে, আর একটু দেখি। বার-বার বিয়ে ভেঙে যায় বলে, গ্রামের বয়স্ক নারীরা রুপাকে দেখলেই অলক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বলে সরে গিয়েছে। বাঁকা মুখে যা আসা উচিত নয় তাও বলেছে। রুপা সব মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। অভ্যাস মানুষকে সব করতে শেখায়। দীর্ঘ দিনের অবহেলা তার মধ্যে এই ব্যাপারগুলোকে মেনে নেওয়ার মতো একটি অভ্যাসের জন্ম দিয়েছে। এখন মাঝে মাঝে নিজেকে সত্যিই অলক্ষ্মী বলে মনে হয় তার।

রুপাদের বাড়ির পাশেই মজনু চাচার বাড়ি। বাড়ির সামনে মজনু চাচা লাউয়ের বেশ একটা ঝাড় বানিয়েছেন। জৈব সারের প্রভাবে লাউ গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছে। লকলকে ডগাগুলো সবুজ পাতা মেলে মাচার চারি-ধারে ঝুলে পড়েছে। মজনু চাচার লাউ গাছের পাতাগুলো খুবই পুষ্ট। গরম ভাতের সাথে লাউ পাতার ভর্তা খেতে রুপার বেশ লাগে। বেশি করে মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে প্রচণ্ড ঝাল করে ভর্তা। রুপা মাচার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। রুপাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মজনু চাচা বলেন,
-কীরে রুপা? লাউ পাতা নিবি?
রুপা মুখ দুলিয়ে বলেছে,
-হ্যাঁ।
-তো নিয়ে যা না, তোর যা লাগে।
মজনু চাচা রুপাকে ছোট বেলা থেকেই বেশ স্নেহ করেন। সম্মতি পেয়ে রুপা গাছে হাত দিতে যাবে এমন সময় মজনু চাচার স্ত্রী ঘর থেকে রা রা করতে-করতে বেরিয়ে এসে চাচাকে বলেছেন,
-তোমার আক্কেল হবে আর কবে? ওকে গাছে হাত দিতে দিলে কোনটা মনে করে? এতো যখন দরদ তখন নিজে ছিঁড়ে দিলেই তো পারতে। হায় হায় রে আমার লাউ গাছের সর্বনাশ হয়ে গেলো রে। আমার লাউ গাছে কী আর লাউ ধরবে?
চাচির অমন কথায় রুপা তার চোখের পানি সেদিন আর ধরে রাখতে পারেনি। বাঁধ ভাঙা সেই জল দু’কুল ছাপিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিল চারিদিক। মাঝে মাঝে নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না তার। মন চায় যে কোনো উপায়ে আত্মহত্যা করতে। কিন্তু মন যা চায় তা কি করা যায় ? রুপা জানে তাকে সব সহ্য করতে হবে। তাকে যন্ত্রণাদায়ক বিষের মতো এই জীবনটাকে বহন করেই সামনের দিকে চলতে হবে। মনকে সান্ত্বনা দেয় সে, নিয়তির উপর তো কারো কোনো হাত থাকে না, তারও নেই।
গত দুই-তিন বছর হলো কোনো ছেলে পক্ষ রুপাকে দেখতে এলেই ওর মধ্যে অন্য রকম একটা কষ্ট কাজ করে। কষ্টটা যে কেমন তা হয়তো সে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। মানুষের মন কাচের মতো নয় যে এক আঘাতেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এ এমন এক জিনিস যাকে একটু একটু করে ভাঙা যায়। প্রতিবার মন ভাঙার কষ্ট বুকের মধ্যে কোথায় যেন চাপা পড়ে চোখের জলে পরিণত হয়ে কোথায় কোথায় ঝরে পড়ে ! একেক বার রুপা ভেবেছে সে আর কোনো ছেলের সামনে দাঁড়াবে না। কিন্তু ছোট বোনদের কথা ভেবে, মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির থাকতে পারে নি। প্রতিবারই সে জোর প্রস্তুতি নিয়েছে, নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে। বাজারের পণ্য দেখার মতো করে ছেলে পক্ষের লোকেরা ঘুরে ফিরে তাকে দেখেছে, প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেছে। রুপা তাদের অপ্রাসঙ্গিক-অবাস্তব সেই সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তরও দিতে চেষ্টা করেছে। তবুও শেষ-মেষ কেন যেন বিয়েটা হয়নি।

বিয়ে না বসলে কী হবে? স্বামীর সংসার না করলে কী হবে? নিজের মতো করে কী জীবনটাকে খরচ করতে পারবে না সে? যেটুকু লেখাপড়া শিখেছে তা দিয়ে নিশ্চয় ছোট খাট একটা চাকরি জুটে যাবে। কতো মেয়েই তো শহরে যেয়ে চাকরি করছে। রুপার এমন কথা শুনে মা তাকে বোঝায়,
-এই পৃথিবীতে নারী হয়ে জন্ম নিলে তাকে সংসার করতে হয়, এটাই নিয়ম। নারী পুরুষের মতো নয়, নারী শারীরিক ভাবে কমজোর, নারীর আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় আর সেই আশ্রয় আসে স্বামীর কাছ থেকে। স্বামী ছাড়া নারীর জীবন সম্পূর্ণ হয় না। মায়ের এমন কথায় রুপার কষ্টটা আরো এক ডিগ্রি বেড়ে যায়। স্বামী ভাগ্য না থাকলে সে কী করবে ? নিজেকে খুবই তুচ্ছ মনে হয় তার।

রুপার চেহারাটা কিন্তু কুশ্রী নয়। এক দেখায় বলতে গেলে বেশ মিষ্টি চেহারা। মাথায় অনেক চুল আছে, খোঁপা করলে তালের মতো বড় একটা খোঁপা হয়। চোখের মণি দু’টোও বেশ ঘন আর কালো। ছোট্ট মুখখানিতে মাঝারি গোছের সরু নাক। গায়ের রংটাও উজ্জ্বল শ্যামলা। বাংলাদেশে উজ্জ্বল শ্যামলা মানেই ফর্সা। রুপা কার কাছে যেন শুনেছিল রং যদি হয় মিশিয়ে সাদা-কালো, আহা, তাহা অতি মনোরম, উহাই প্রকৃত ভালো। রুপার মধ্যে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি ভালো?

একবার এক যোতিশি রুপার হাত দেখে বলেছিল, স্বামী ভাগ্য তার খুব ভালো, তবে সময় লাগবে। বয়সের বেড়াজাল রুপার ধৈর্যের বাঁধে আঘাত হেনে বলেছে আর কবে আসবে সেই সময়? তার ভাগ্যের গ্রহ-নক্ষত্র কবে রাহুর কড়াল গ্রাস হতে মুক্ত হবে ? কবে তার জন্য বয়ে আনবে শুভ সংবাদ।

শুভ সময় আর শুভ সংবাদ মানুষের জীবনে খুবই অল্প সময়ের জন্য আসে। ক্ষুদ্র এই একটি ক্ষণের জন্য মানুষের কতো হা হুতাশ ! কতো অপেক্ষা ! কতো আয়োজন ! রুপার জীবনে ফেলে আসা কষ্টের সেই দীর্ঘ দিনগুলো এই একটি ক্ষণে, এক ঝটকায় বদলে যাবে ! এটা রুপা কখনও ভাবতেও পারেনি। সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রুপার ঘরে আজ এসেছে সেই দিন। ঐ ঘরে বসে আছে তার হবু বর, আর এই ঘরে সে। এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হয়তো আজ শানাই বাজছে। মহিলারা গোল হয়ে বসে পানে চুন মিশিয়ে গাইছে গীত। কিন্তু রুপার বাড়িতে আজ কোনো শানাইয়ের মনকাড়া সুর বাজছে না, কেউ গীতও গাইছে না। কিন্তু তাতে রুপার কোনো আক্ষেপ নেই। তার মনের গহিনে এতদিন ধরে যে দরজাটি বন্ধ হয়ে ছিল, আজ তার আগল খুলে গেছে। সেই দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে আসছে ঐশ্বর্যের সোনালি আলো, সুগন্ধী ফাল্গুনি বাতাস। ঐ দরজার ওপারে আজ কতো হৈ হুল্লোর, কতো আয়োজন! হায় ! এই আয়োজনটাকে সে যদি কাউকে দেখাতে পারতো।

রুপাকে আজ বিয়ের সাজে সাজানো হচ্ছে। বান্ধবীদের মতো সেও আজ এই সাজে সেজেছে। আজ রুপার পাশে তার বান্ধবীদের কেউ নেই। ছোট বোন আর ছোট বোনের বান্ধবীরাই তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আজ রুপার অনেক সুখের দিন, অনেক আনন্দের দিন। দীর্ঘ দিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্টের কালো মেঘগুলো আজ সাদা মেঘে রুপান্তরিত হয়ে কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে। রুপার মনের আকাশে আজ চনমনে সোনালি সূর্য। চারিদিক শুধু আলো আর আলো। রুপা আজ লাল শাড়িতে সেজেছে। জরির ওরনায় ঘোমটা করে সে আজ বরের হাত ধরে বেরিয়ে যাবে তার পিত্রালয় ছেড়ে। গ্রামের সেই বয়স্ক নারীদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে সে আজ মিশে যাবে বরযাত্রীদের ভীড়ে। যারা প্রতিনিয়ত অলক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বলে তাকে অপমান করতো, আজ তাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে। বুঝিয়ে দেবে, সে মোটেও অলক্ষ্মী নয়, তার কপালেও আছে স্বামীর সোহাগ। আজ রুপা মজনু চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। চাচার লাগানো সেই লাউ গাছ থেকে একটি ফুল ছিঁড়ে আনবে কোনো অনুমতি ছাড়াই। চাচি দূর থেকে হয়তো সবই দেখবেন কিন্তু আজ তার আর কোনো কিছু বলার থাকবে না।

রুপার কাছে আজ সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক খুঁজতে সে চারিদিকে চোখ মেলে তাকায়। ঐ তো দেখা যাচ্ছে, মজনু চাচা বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত, রান্না-বান্না ঠিক মতো হচ্ছে কিনা দেখাশোনা করছেন। এইতো তার কাছে বসেই ছোট বোন দু’টো তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। কপালে তরল চন্দনের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা এঁকে সাজাবে ? নাকি সাধারণ সাজেই সাজবে তাদের বড় বোন? মাঝে মাঝেই মামাকে বর পক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখো যাচ্ছে, তার হাতে সরবতের পাত্র। পাশের বাড়ির বাচ্চা ছেলে মেয়েরা উঠানে ছোটাছুটি করছে। রুপা ভাবতে থাকে, এ হয়তো স্বপ্ন। যদি স্বপ্ন হয় হোক না। বাস্তবে না হলেও এমন একটি স্বপ্নও তার জন্য কম কিছু নয়। মাওলানা সাহেব ছেলের বিস্তারিত বলে রুপাকে যখন কবুল বলতে বললেন, রুপা চোখ বড় বড় করে মাওলানা সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হতে লাগল, এতো স্বপ্ন, সে কি কবুল বলবে ? হঠাৎ পিঠের কাছটায় কেমন একটা চিমটি কাটার তো যন্ত্রণা। রুপা পাশ ফিরে দেখল, বড় মামি। মামি নিচু গলায় বললেন, বলো কবুল। স্বপ্ন নয় তাহলে ! সত্যিই আজ তার বিয়ে হচ্ছে ! অস্ফুট কণ্ঠে রুপা বললো, কবুল।
আজ রুপার সমস্ত মুখখানিতে সুখের এক মসৃণ প্রতিচ্ছবি খেলা করছে। ছোট বোনদের চোখে-মুখেও আনন্দের হাসি। মাঝে মাঝেই তারা জড়িয়ে ধরছে তাদের বড় বোনকে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে কী সব বলছে, আর হাসতে হাসতে একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরছে। বিবাহ এমন-ই এক ব্যাপার এটা ঘটতে শুরু করা মাত্রই বর-বধূ সহ তাদের আশে-পাশে যারা থাকে তাদের মধ্যেও অভাবনীয় আনন্দের এক আবেশ ছড়িয়ে পড়ে।

রুপার আজ সত্যিই অনেক আনন্দ। এত হাসি এত আনন্দের মাঝেও আজ কিন্তু একজনের মুখে কোনো হাসি নেই, আনন্দ নেই। তিনি হচ্ছেন রুপার মা। রুপার বিয়ে হচ্ছে না দেখে এতদিন সবচেয়ে বেশি যিনি চিন্তিত থেকেছেন আজ তার মুখে আনন্দের কোনো ছাপ নেই। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে না রুপা। কেন মা তার মুখটা অমন অন্ধকার করে রেখেছেন ? রুপা নিচু স্বরে মা কে ডেকে বলে,
-মা তুমি খুশি হওনি।
রুপাকে জড়িয়ে ধরে মা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-অনেক খুশি হয়েছিরে মা, অনেক খুশি হয়েছি।
-তাহলে মুখটা ওমন কালো করে রেখেছ কেন?
-এখন তুই বুঝবি না। যখন তোর মেয়ে হবে আর তোর সামনে দিয়ে এভাবে বরের হাত ধরে চলে যাবে তখন বুঝবি।
রুপা বোঝে, এই দীর্ঘ সাতাশটি বছর যারা তাকে লালন-পালন করেছেন আজ তাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে অচেনা অজানা একজনের সাথে। নিশ্চয় পিতা-মাতার কাছে এটা অনেক কষ্টের একটা ব্যাপার। তবুও এই কষ্টের মধ্যেই তারা কীশের যেন সুখ খুঁজে পায়। এভাবেই নিশ্চয় পূর্ণাঙ্গ হয় একজন মানুষের জীবনধারা। আজ থেকে ঐ অচেনা অজানা মানুষটিই হবে তার সবচেয়ে একান্ত অভিভাবক, তার জীবন সাথি, তার শৌহর।

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test